Advertisement
০২ মে ২০২৪
Women Cricket

অকারণ পথরোধের চেষ্টা

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা বোধ হয় মনে করছে, রূপান্তরকামী নারীরা তথাকথিত নারীদের কোথাও ছাপিয়ে যাবেন খেলায়। যদিও এমন প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি।

—প্রতীকী ছবি।

ভাস্কর মজুমদার
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৩২
Share: Save:

সরোজ দে পরিচালিত কোনি ছবিতে (লেখক মতি নন্দী) কিশোরী কনকচাঁপা পালকে ক্ষিদ্দা সাঁতারের চাম্পিয়ন বানিয়েছিলেন। সে যুদ্ধ সহজ ছিল না। মেয়ে হওয়ার পাশাপাশি কোনি ছিল গরিব, বস্তিবাসী। তাই জলে নামার আগেই তাকে হারিয়ে দেওয়ার প্রকরণ মজুত ছিল চার পাশে। মেয়েদের খেলায় অসমতা আজও শেষ হয়নি। সম্প্রতি তাতে যোগ হয়েছে আর একটি মাত্রা— রূপান্তরকামী নারীদের বহিষ্কার। ‘খেলায় বিশুদ্ধতা, নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও অন্তর্ভুক্তি রক্ষা করতে’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা সম্প্রতি রূপান্তরকামী নারীদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তথাকথিত ‘জৈবিক’ পুরুষ থেকে যাঁরা নারীতে পরিণত হয়েছেন, বা হওয়ার পথে আছেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত কোনও ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

এই নিষেধাজ্ঞা ক’জনের স্বপ্ন রুখে দিল, সেই সংখ্যা গুনলে হবে না। এর পিছনের মনোভাবটি বিবেচনা করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্র ধরে নেয়, লিঙ্গযৌন-পরিচয় জন্মেই নির্ধারিত হয়ে যায়, সেখানে আর কোনও সম্ভাবনার স্থান নেই। রূপান্তরকামিতা আসলে ‘খোদার উপর খোদকারি’। যে লিঙ্গচিহ্ন নিয়ে আমাদের জন্ম, তাতে সন্তুষ্ট থাকাই ধর্ম। এর থেকে নড়চড় হওয়ার স্বাধীনতা নেই। এই মত অনুসারে মনুষ্যশরীর ব্যক্তির নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পত্তি। লিঙ্গ যে আসলে শুধু দেহচিহ্ন দিয়ে স্থির হয় না, এক্সওয়াই-এক্সএক্স ক্রোমোজ়োমের দ্বৈত দিয়ে যৌনচেতনা ও জীবনদর্শনকে ধরা যায় না, সেই সত্যটা সকলে এড়িয়ে যান। এক লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গের রূপান্তরও একরৈখিক নয়। রূপান্তরকামী নারী বলতে পুরুষের ‘নারী সেজে থাকা’ যাঁরা মনে করেন, তাঁরা কি বোঝেন যে তাঁরা রূপান্তরকামীদের প্রতারক মনে করছেন, তাই বিদ্বেষেরই পরিচয় দিচ্ছেন? রূপান্তরকামী নারী ‘আসলে পুরুষ’ নয়, সে আসলে নারীই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থাকেও তা উপলব্ধি করতে হবে।

বিশুদ্ধতা বা ন্যায্যতার যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, অন্তত মেয়েদের খেলাতে তা তো আজও অধরাই রয়েছে। উচ্চ পুরুষ হরমোন (টেস্টোস্টেরন) থাকলে মহিলা খেলোয়াড়রা ভর্ৎসিতই হয়ে এসেছেন খেলার দুনিয়ায়; সে সিমোন বাইলস হোন, ভেনাস উইলিয়ামস বা পিঙ্কি প্রামাণিক। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে নতুন নিয়ম, মেয়েদের খেলায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি লিটার রক্তে ‘টেস্টোস্টেরন’-এর মাত্রা ২.৫ ন্যানোমোল ছাড়ালে তাঁরা বাদ পড়বেন। বহু মেয়ে রূপান্তরকামী না হয়েও বাদ পড়ছে। অন্তত ছ’মাস টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কম রেখে তবেই খেলায় আসতে হচ্ছে মেয়েদের। এই সিদ্ধান্তের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কতটুকু? দক্ষিণ আফ্রিকার দু’বারের অলিম্পিক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ক্যাস্টার সেমেন্যা, বুরুন্ডির ফ্রান্সিন নিয়নসাবা, নামিবিয়ার ক্রিস্টিন এমবোমার মতো খেলোয়াড়দের কেরিয়ার বিপন্ন। এঁরা কেউ রূপান্তরকামী নন। তাঁরা হয় অন্য খেলায় যাচ্ছেন, না হলে খেলা ছেড়ে দিচ্ছেন। রূপান্তরকামী নারীদের খেলায় নিষিদ্ধ হওয়া নারীবিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা বোধ হয় মনে করছে, রূপান্তরকামী নারীরা তথাকথিত নারীদের কোথাও ছাপিয়ে যাবেন খেলায়। যদিও এমন প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। কিন্তু হরমোনের প্রশ্নেই যদি নারীর খেলা আর পুরুষের খেলার বিভাজন হয়, তা হলে এটাও জেনে রাখা ভাল যে রূপান্তরকামী নারীদেরও টেস্টোস্টেরন-মাত্রা কমিয়েই সে খেলায় অংশ নেওয়ার বিধি মানতে হবে। ন্যায্যতার দোহাই দিয়ে রূপান্তরকামী নারীদের ‘মেয়েদের খেলা’ থেকে বাদ দেওয়ার মনোভাব মেয়েদের স্বার্থরক্ষার নামে আসলে তাঁদের অপমানিতই করে, কারণ তা মেয়েদের প্রকৃতিগত ভাবে দুর্বল ভাবে, তাঁদের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়।

এক জন নারী এক জন রূপান্তরকামী নারীকে (বা পুরুষকে) হারিয়ে দিতে সক্ষম কি না সেটা হার-জিতেরই প্রশ্ন, যেটা খেলায় হয়েই থাকে। প্রশ্ন হল, সমানাধিকারের সুযোগটা নারী-পুরুষ-রূপান্তরকামী নির্বিশেষে সব খেলোয়াড়ই পাচ্ছেন কি না। যে কোনও খেলোয়াড়কে যদি তাঁর লিঙ্গ-যৌনতার দোহাই দিয়ে বাদ দেওয়া হয়, তা হলে তা অন্যায় হবে। রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য আলাদা খেলা বা দল তৈরি করাটা সম্ভব নয়, সমীচীনও হবে না। তা হলে তাঁরা যাবেন কোথায়? তাঁদের খেলার অধিকার খর্ব হলে খেলা জিনিসটারই তো মান্যতা থাকে না। খেলা যে আদর্শগত ভাবে ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, লিঙ্গ— সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

খেলার মধ্যে এই তথাকথিত নারী বনাম রূপান্তরকামী নারীদের অকারণ দ্বৈরথ গড়ে তোলার চেষ্টা ও তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পিছনে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের অঙ্গুলিহেলন। নইলে খেলায় মেয়েদের প্রতি অন্যায্যতা তো কম নেই— তা সে সমান বেতন হোক, পুরুষ কোচের হাতে হেনস্থা, মহিলা কোচের অভাব। সেগুলো নিয়ে তো সংস্থাগুলিকে সরব হতে দেখা যায় না।

কত রকম আর্থ-সামাজিক বাধা কাটিয়ে তবে খেলায় এসে পৌঁছতে পারছেন মেয়েরা, তা নিয়েও কথা হয় না। রূপান্তরকামী নারীদের অংশগ্রহণই কেবল অন্যায্য বলে মনে হচ্ছে। সাইক্লিং, সাঁতার, অ্যাথলেটিক্স, এমনকি দাবাতেও রূপান্তরকামী নারীরা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছেন। খেলাধুলায় আজও নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকার নেই। আজ যদি সমস্ত খেলা লিঙ্গনিরপেক্ষ হত, তা হলে রূপান্তরকামী মানুষদের হেরে বসে থাকতে হত না মাঠে নামার আগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE