E-Paper

আছি সুখে হাস্যমুখে

আমাদের দু’চোখ এই দু’রকম খবরের মধ্যে মনপসন্দ বেছে নিতে ধস্তাধস্তি করে রোজ। উৎসব জিতে যায়। রক্তমাখা ছবিগুলোর জন্য মন-কেমনকে লাথি মেরে অন্য সত্তাটা বলে ওঠে, ওদের হচ্ছে তো তোর কী!

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৮

—প্রতীকী ছবি।

গায়ে জার্সি। দুই গালে, চিবুকে, কব্জিতে জাতীয় পতাকার স্টিকার। মেয়েদের চোখের পাতার উপরে চকচক করছিল ত্রিবর্ণের চিকচিক গুঁড়ো। চলন্ত মেট্রোয় পনেরো সেকেন্ড পর পর সেলফি, হাতের মুদ্রায় দেখানো ভি-চিহ্ন গিলছিল স্মার্টফোনের ক্যামেরা। একটু পরেই ম্যাচ শুরু ইডেন গার্ডেনসে, বিশ্বকাপ! পাশেই খবরের কাগজে ডুবে থাকা সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, “ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধ মোলায়েম সবুজ ঘাসে। এর থেকে অনেক বড়, বিচ্ছিরি একটা যুদ্ধ চলছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, জানো?” প্রশ্ন শুনে ঈষৎ ভ্যাবাচ্যাকা দলটা। এক জন বলল, “আপনি একটু বেশি জেনে ফেলেছেন মনে হচ্ছে, দাদু।”

খবরের কাগজের পাতায় শব্দছক, দিন কেমন যাবে কিংবা কোন হলে কোন সিনেমা-র মতোই নিয়মিত হয়ে উঠছে যুদ্ধের খবর। ইজ়রায়েল আর হামাসের মধ্যে এই যুদ্ধ হচ্ছে কেন, তার শেষ কবে, তা নিয়ে ক’জনের মাথাব্যথা আছে জানি না। পাতা ওল্টোনোর সময় চকিতে দেখে নিই মৃত্যুমিছিলের সংখ্যা: কাল পর্যন্ত ন’হাজার ছিল, রাতে গাজ়ায় মিসাইল হানায় যোগ হল সাড়ে তিনশো... আহত ৩৩ হাজারেরও বেশি। প্রাণ গেছে যাঁদের, অধিকাংশই মহিলা ও শিশু। ঘুমোতে যাওয়ার সময় আচমকা মিসাইল হানায় শেষ হয়ে গেছে একই পরিবারের চল্লিশ জন! বেঁচে গিয়েছেন যে মানুষটি, তিনি কাঁদতে কাঁদতে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছেন, “আমার মায়ের পেটের ভিতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছিল।” বলেছেন, “আমিও শেষ হয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত।” আমরা পড়তে পড়তে পরের খবরে চলে যাই।

‘দেওয়ালি মহাবাচত অফার’ বা ‘নেভার বিফোর সেভিংস’-এর পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন চেটেপুটে খাওয়ার সময় কোনও কোনও দিন চোখে পড়ে, একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকা শিশুর ছবি। একটি চোখ গিয়েছে চিরতরে, ছোট্ট কপালে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। এই তো আমার প্রিয় ব্র্যান্ডের ফোনের নতুন মডেল, জব্বর ডিসকাউন্ট দিচ্ছে! এক গাদা পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটা হাত, নিথর। ‘বডি’টা টেনে বার করার চেষ্টা করছেন কয়েকজন। আরিব্বাস, সাড়ে পাঁচ হাজারের জুতো এত কমে, কেয়াবাত! কপাল চাপড়াচ্ছেন সন্তানহারা কোনও মা, পাশে দাঁড়ানো লোকটা বাবা-ই হবে হয়তো। দু’দিনের মধ্যে মাল্টিপ্লেক্সে টিকিট বুক করলে বাটার পপকর্ন ফ্রি!

আমাদের দু’চোখ এই দু’রকম খবরের মধ্যে মনপসন্দ বেছে নিতে ধস্তাধস্তি করে রোজ। উৎসব জিতে যায়। রক্তমাখা ছবিগুলোর জন্য মন-কেমনকে লাথি মেরে অন্য সত্তাটা বলে ওঠে, ওদের হচ্ছে তো তোর কী! ইডেনমুখী না হলেও মেট্রোর সেই উন্মত্ত জনতার আমিও তো এক জন— সুখযাপনের জার্সিতে জড়িয়ে রাখি শরীর, ফেসবুকে অমরত্ব প্রত্যাশা করি। বন্ধুদের টাইমলাইন দেখি, বুর্জ খলিফার চূড়ায় বসে শূন্যে দু’হাত বাড়িয়ে পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করছে স্কুলজীবনের বন্ধু। সদ্য কেনা দামি গাড়ির গায়ে হাত রেখে কেউ লিখেছে, ‘আমার দ্বিতীয় সন্তান’। শহরের কোন পাঁচতারা হোটেলে সবচেয়ে ভাল সুশি পাওয়া যায়, জানতে চেয়ে আকুল আবেদন এক বান্ধবীর। মরিশাস তাইল্যান্ড না মলদ্বীপ, নিউ ইয়ার’স ইভ কোথায় কাটাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না অন্য এক বন্ধু। পাল্লা দিয়ে কিছু লিখতে এই হাতও নিশপিশ করে, হয়তো আরও জমকালো কিছু লিখতে পারব কাল।

নিজেকে আরও ভাল দেখানো ছাড়া এই জীবনের কোথাও তো আর কোনও যুদ্ধ নেই। মৃত্যুসংখ্যা আকাশ ছুঁলেও কী-ই বা যায় আসে আমাদের? শহরে কিছু যুদ্ধবিরোধী মিছিল হয়, মিছিলে হাঁটবেন কথা দিয়েও পরিচিতজন পরিকল্পনা বাতিল করেন শেষ মুহূর্তে: “মিছিলের তারিখ জানার পরেই চে গেভারার ছবিওয়ালা টি-শার্টের অর্ডার করেছিলাম অনলাইনে, পেলামই না ঠিক সময়ে!” অগ্রজ এক সাংবাদিক বলছিলেন, কাগজের প্রথম পাতায় রক্তমাখা শিশুর ছবি, ধ্বংসলীলার ছবি ছাপতে কি আমাদেরও ভাল লাগে! কিন্তু একটা সামাজিক কর্তব্য আছে। সকালে গরম চায়ের সঙ্গে বিস্কুটে কামড় দিতে দিতেও মানুষ যেন বোঝেন, আমরা ভাল থাকলেও ভাল নেই বিশ্বচরাচর। আবার এক অনলাইন পত্রিকায় কর্মরত এক বন্ধু বলছিল, ‘ভিউ’-এর বাজারে লাস্যময়ী নায়িকার সমুদ্রস্নানের খবরের পাশে কুঁকড়ে থাকে ‘গাজ়ায় এক দিনে মৃত তিনশোরও বেশি’।

চোখ বুজে থাকার মধ্যে যে আনন্দ, তা আমরা শিখে নিচ্ছি প্রতিনিয়ত। কানে ইয়ারফোন গুঁজে শুনছি বব ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’, আরও কত হাজার মরলে জেগে উঠব জানি না। জেগে ওঠার মানে কি মনখারাপ? মনোবিদরা আশঙ্কা করছেন, এমন খবরে আমাদের তন্দ্রা এলেও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা বার্তা দেবে শীতঘুমের। এক জনের কথায়, “মোবাইলে বা প্লে-স্টেশনে পাঁচ বছর বয়সেই শিশু যে গেম খেলছে তাতে মানুষ মারলে পয়েন্ট বাড়ে; যত মৃত্যু তত পুরস্কার। পর্দায় রক্ত ছিটকে পড়ে, গেম-এর ও-পারে কেউ বলে, চলো খেলা যাক ‘লেভেল টু’। মানে, আরও রক্ত।

এরই মধ্যে আরও ক’টা ক্ষেপণাস্ত্র হানা হল গাজ়ায়? চলুন, খবরটা খুঁজতে থাকি। খবরের ‘ওরা’ও খুঁজতে থাকুক, ওদের হাত, পা, শরীরের বাকি অংশটা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Israel Palestine Conflict Violence

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy