Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
‘যাকে পাবি তাকে ছোঁ’
Mithun Chakraborty

দুয়ারে বিজেপি: ‘ক্ষুব্ধাশ্রম’ রাজ্য রাজনীতির নতুন ঠিকানা

কে কী খাবেন, তার মতো কে কোন দলকে সমর্থন করবেন, সেটাও এক জন ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২১ ০৫:২৭
Share: Save:

বিজেপির সভামঞ্চে মিঠুন চক্রবর্তীর আবির্ভাব ভোটের বাংলায় অবশ্যই এক মুচমুচে সংযোজন। নরেন্দ্র মোদীর ওই সভায় মিঠুন থাকবেন, সেটা আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। তবে তিনি সেখানে কী অবতারে প্রকাশ পাবেন, তা বোঝা যায়নি। পদ্ম-লাঞ্ছিত গৈরিক ধ্বজা হাতে নিয়ে মিঠুন নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি বিষধর গোখরো, যার এক ছোবলেই ছবি! লোকে বলে, পদ্মবন নাকি সাপের পছন্দের ঠিকানা।


কে কী খাবেন, তার মতো কে কোন দলকে সমর্থন করবেন, সেটাও এক জন ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়। কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেউ যদি কারও উপর কোনও ‘চাপ’ সৃষ্টি করেও থাকেন, তা উভয় তরফে অন্দরের বোঝাপড়া। যত ক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিরূপাত্মক কোনও প্রমাণ হাতে না আসে, তত ক্ষণ প্রকাশ্যে সবটাই অভিযোগ এবং অনুমান বলে ধরতে হবে। মিঠুন চক্রবর্তীর বিজেপি-যোগ সম্পর্কেও এ কথা আপাত ভাবে প্রযোজ্য।


তবে কিনা সময়! সেটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর তাতেই বিজেপির একটি নীল নকশা ফুটে ওঠে। যেখানে বাংলার ‘মুখ’ খুঁজতে মরিয়া বিজেপির চেহারা প্রকট হয়। মাঠের ‘দাদা’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে না পেয়ে তড়িঘড়ি পর্দার ‘দাদা’ মিঠুন চক্রবর্তীকে তুলে ধরার প্রয়াস হিসেবে সমগ্র ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করার যুক্তিগ্রাহ্য সুযোগও থাকে।


মিঠুনকে অবশ্য সঠিক অর্থে প্রবাসী বাঙালি বলতে হয়। কলকাতা বা বাংলায় তিনি স্থায়ী ভাবে থাকেন না কয়েক দশক। পেশাগত বা অন্য কারণে এলে হোটেলে ওঠেন। কাজ সেরে ফিরে যান।


তবু উত্তর কলকাতার এই পুরনো বাসিন্দাকে নিয়ে আমবাঙালির বাড়তি আবেগ থাকা স্বাভাবিক। কারণ, তিনি নিজের পেশায় যথেষ্ট সাফল্য ও জনপ্রিয়তা দুই-ই অর্জন করতে পেরেছেন। এবং তা দীর্ঘ দিন বেশ জোরদার ছিল। ‘ডিস্কো ডান্সার’-এ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী যত নেচেছে, বাংলা নেচেছে তার চেয়ে বেশি। চুলের মিঠুন-ছাঁট বাংলার ‘গুরু’ভক্ত যুবকদের মাথায় চড়েছে সবার আগে।


তাঁর এই চটুল জনপ্রিয়তাকে জ্যোতি বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতির তারকারাও তাই ‘ব্যবহার’ করেছেন নিজেদের অঙ্কে। বস্তুত মিঠুনই তাঁদের সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাই সিপিএমের রাজত্বে তিনি পার্টির ‘গণনেতা’ সুভাষবাবু মারফত জ্যোতিবাবুর ঘরে পৌঁছে তাঁদের ‘কাছের লোক’ হয়েছেন। প্রণববাবুর লোকসভা কেন্দ্রে গিয়ে তাঁর হয়ে কংগ্রেসের মঞ্চে প্রচার করেছেন। মমতা ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে মিঠুনের। যা গড়ায় তৃণমূলে রাজ্যসভার সদস্য হওয়া পর্যন্ত। যদিও সারদাকাণ্ডের জেরে দু’বছরের মধ্যে সাংসদ পদ ছেড়ে দেওয়ার সময় মিঠুন নিজ উদ্যোগেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সুতরাং, দল-রং নির্বিশেষে ‘সঠিক’ সময় অনুযায়ী ক্ষমতার বৃত্তে মিঠুন একটি পরিচিত চরিত্র। অভিনয়ে দক্ষতা থাকায় সাপ-বেজি-ওঝা, যে কোনও ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিতেও পটু। তাই এখন তাঁর বিজেপিতে যোগদান কিছুটা আকস্মিক লাগলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং কিছু দিন আগে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত তাঁর বাড়িতে দেখা করতে যাওয়ার পরে মিঠুন রাজনীতিতে যোগ দেবেন না বলে যে ঘোষণা করেছিলেন, সেটাই হয়তো ছিল চিত্রনাট্য!


তবে যেটা সবথেকে বেশি চোখে লাগে, তা হল বিজেপির হাল। দেখেশুনে মনে হয়, যেন কানামাছি খেলা চলছে সেখানে। ‘যাকে পাবি তাকে ছোঁ...’ অবস্থা! এমনিতেই পদ্ম-শিবির ক্রমে ‘ক্ষুব্ধাশ্রম’ হয়ে উঠেছে। সহায়হীন বয়স্কদের জন্য যেমন বৃদ্ধাশ্রম, ‘ক্ষুব্ধ’ তৃণমূলদের জন্য তেমনই দুয়ারে বিজেপি! একেবারে হাত বাড়ালেই ‘বন্ধু’ হাজির।


তৃণমূল ভাঙার প্রক্রিয়া অবশ্য শুরু হয়েছে অনেক আগে। ইতিমধ্যে ওজনদার নেতা-মন্ত্রীরা অনেকে ‘জোড়া ফুল’ ছেড়ে পদ্ম ফুল হাতে নিয়ে নতুন দলে দায়িত্ব ও ভোটে প্রার্থিপদ পেয়ে গিয়েছেন। প্রার্থী হওয়ার অপেক্ষায় আরও অনেকে। এই বার তৃণমূলে টিকিট না পাওয়াদের সঙ্গে নিয়ে দল ভারী করছে বিজেপি। বয়োভার বা শারীরিক সক্ষমতার বিষয় সেখানে গৌণ। ফলে আশি-নব্বই, অসুস্থ সবাই স্বাগত!


শাসক তৃণমূলে ভাঙনের বহর বাড়লে বিজেপি যে তার ‘সুবিধা’ আদায় করতে চাইবে, তা স্বাভাবিক। সে দিক থেকে দেখলে দরজা খুলে রাখা তাদের দিক থেকে অবশ্যই উপযুক্ত পদক্ষেপ।


কিন্তু এটাও তো ঠিক, নিজের দলে টিকিট না পেয়ে যাঁরা প্রতিপক্ষের ঘরে ‘পুনর্বাসন’ পেতে চলে গেলেন, তাঁদের ক্ষমতালোভী অবয়ব গোপন রইল না। এতে ব্যক্তির গৌরব বাড়ে, না কি আশ্রয়দাতাদের, সেই প্রশ্নও থেকে যায়। সঙ্ঘ পরিবার থেকে আসা বিজেপির নেতাগণ এবং দলের পুরনো কর্মী-সমর্থকেরাই বা এ সব কী ভাবে দেখেন?
এ তো গেল সাধারণ স্তরের কথা। রাজ্যবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য তাদের একটি জাঁদরেল ‘মুখ’-ও তো দরকার। এমন এক জন, যাঁর ‘বাঙালি’ এবং ব্যক্তিগত— দুই পরিচিতিই জোরদার। কারণ দলীয় নেতৃত্ব এটা বিলক্ষণ বোঝেন, মোদী-অমিত শাহেরা প্রচারে যত ঝড়ই তুলুন, বাংলায় মমতার বিপরীতে একটি ‘মুখ’ খাড়া করা জরুরি। সৌরভের ‘বিকল্প’-এ সত্তর বছরের যুবক মিঠুন এখন তাঁদের সেই ঘুঁটি। বিজেপি নেতারা অবশ্য এখনও দাবি করে যাচ্ছেন, কোনও ‘মুখ’ ছাড়াই তাঁরা ভোটে যাবেন। যেমন হয়েছিল প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা এবং দেশের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তরপ্রদেশে। বঙ্গভাষী ত্রিপুরায় সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে সেখানকার রাজ্য সভাপতি বিপ্লব দেবকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। আর চমকপ্রদ ভাবে উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির পরাজয়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হয় পাঁচ বারের সাংসদ যোগী আদিত্যনাথকে।


কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে বিজেপির গায়ে লেপ্টে আছে হিন্দি বলয়ের তকমা। তাই ভোটের দায়ে এখানে একটি বাঙালি ‘মুখ’ তুলে ধরতে বিজেপি কতটা দিশাহারা, সেটা এখন বেশ স্পষ্ট। মঞ্চে মিঠুনকে নিয়ে স্বয়ং মোদীর মাতামাতিও এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।
তবে তার অর্থ কখনও এই নয় যে, বিজেপি জিতলে ওই ‘মুখ’-ই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। বরং এটাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, তখনও সঙ্ঘের ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হবে, তাঁদের ‘অনুশাসিত’ কেউ বিবেচনায় প্রাধান্য পাবেন। তাই কিছু দিন আগে পর্যন্ত সৌরভকে ঘিরে এবং গত কয়েক দিন মিঠুনকে নিয়ে অন্য যত গুঞ্জন ছিল বা আছে, তার বাস্তব ভিত্তি জোরালো নয়। দশ বছর মমতার সরকারে চুটিয়ে মন্ত্রিত্ব করার পরে ভোটের ঠিক আগে দল বদলানো শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়রাও একই যুক্তিতে দৌড়ে পিছিয়ে থাকবেন বলেই মনে হয়।
তা হলে কী করবেন মিঠুন? বাংলার ভোটে তাঁকে কী ভাবে ‘কাজ’-এ লাগাবেন মোদী-শাহেরা?


দৃঢ় অনুমান হল, তাঁকে বেশি করে প্রচারের কাজে লাগানো হবে। তাঁর আমজনপ্রিয়তাকে যত দূর সম্ভব ব্যবহার করে সভাসমাবেশে লোক টানার চেষ্টা হবে। তিনি মমতা ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে কথা বললে এক সময়ের ‘ঘরের লোক’ হিসেবে তাঁর বক্তব্যকেও শুভেন্দু-রাজীবদের মতো ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলা যাবে। লোককে তা ‘বোঝানো’ সহজ হবে।


প্রকৃতপক্ষে কী হবে, কত ধানে কত চাল হবে, সে সব পরের কথা। রাজনীতির মঞ্চে মিঠুন চক্রবর্তী আজ নবকলেবরে সত্যিই কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন, তা-ও কার্যক্ষেত্রে বোঝা যাবে। তবে নখ-দাঁত থাক বা না-থাক, ‘গোখরোর ছোবল, চিতার খাবল’ শুনতে লোক জুটতেই পারে। ভক্তদের ‘মহাগুরু’ বলেই রেখেছেন, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়।’ মজা লোটার এই তো সময়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Narendra Modi Mithun Chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE