Advertisement
০৬ মে ২০২৪
পাকিস্তানে বিষবৃক্ষ রোপণ হয়েছে বহু দিন, এখন ফল ফলছে
Pakistan

গণতন্ত্রের সঙ্কটপ্রহর

৫ অগস্ট ইমরান খান নিজে ঢুকলেন জেলে, আরও এক বার। ট্রায়াল কোর্ট তাঁর তিন বছরের জেলবাস ধার্য করেছিল, পরবর্তী রায়ে তাঁর চোদ্দো বছরের কারাদণ্ড স্থির হল।

pakistan

পরীক্ষার্থী: জাতীয় নির্বাচনের প্রচারে বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারি, করাচি, ৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

আয়েশা জালাল
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫২
Share: Save:

৯ মে, ২০২৩। পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। রায়ট-নিয়ন্ত্রণের পোশাক পরিহিত আধা-সামরিক বাহিনী সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা দেশের সুপারস্টার ক্রিকেটারের বাড়ি ঘেরাও করল। গোটা দেশে যেন আগুন জ্বলে গেল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর এক অদৃষ্টপূর্ব আক্রমণের মুহূর্ত সূচিত হল যখন এই ঘটনার প্রতিবাদে রাওয়ালপিন্ডিতে জনতা চড়াও হল আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স (জিএইচকিউ)-এর উপর। পুড়িয়ে দেওয়া হল পেশোয়ারের রেডিয়ো পাকিস্তান স্টুডিয়ো। পুলিশ অফিসার ও নেতারা নিহত হলেন। লাহোরে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তার বাড়ি (যা আগে ছিল স্বয়ং মহম্মদ আলি জিন্নার বাসস্থল) ভেঙে পোড়ানো হল। ইমরান খানের পার্টি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এই ঘটনার সঙ্গে নিজেদের দায় অস্বীকার করে জানাল: নির্ঘাত বিদেশি উস্কানি আছে এর পিছনে। তা সত্ত্বেও অবশ্য পিটিআই-এর বহু সদস্য গ্রেফতার হলেন, মেয়েরাও— তাঁদের অনেকেই এখনও জেলে।

৫ অগস্ট ইমরান খান নিজে ঢুকলেন জেলে, আরও এক বার। ট্রায়াল কোর্ট তাঁর তিন বছরের জেলবাস ধার্য করেছিল, পরবর্তী রায়ে তাঁর চোদ্দো বছরের কারাদণ্ড স্থির হল। কোনও সরকারি পদে তিনি বসতে পারবেন না, এও আদালতের রায়। তবে জেলের ভিতর থেকেই নিজের সমর্থক বাহিনীর মনোবল ও দলশক্তি বাড়াতে তিনি সচেষ্ট থাকলেন— আগামী কাল সে দেশের জাতীয় নির্বাচন, তার পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও অসামরিক সরকারের মধ্যেকার ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্কের রেখচিত্র মোটামুটি চেনা। তবে ইমরান খানের ঘটনাকে তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক বলতে হবে। ইমরান খান হলেন পাক সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট-এর ‘ফেলড এক্সপেরিমেন্ট’, ব্যর্থ পরীক্ষা। এর পর কী হবে? সেনাকর্তারা কি আরও নতুন পরিকল্পনা নিয়ে ‘মাঠে’ নামবেন, না কি ব্যারাকে ফিরে যাবেন? গণতন্ত্রের বাঁচার কি সম্ভাবনা আছে সে দেশে? না কি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা ‘ডিপ স্টেট’কে পরাস্ত করতে পারবে গণতন্ত্রকামী লিবারাল সমাজ?

এ সব প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই বলেই হয়তো বিষয়টাকে এক বার ফিরে দেখা যেতে পারে। ১৯৫৮ সাল থেকে অব্যাহত সামরিক কর্তৃত্বের শিকল ভাঙল যখন ২০০৮ সালের জন-নির্বাচিত সরকার ২০১৩ সালে প্রথম বারের জন্য আর এক নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে সফল হল! সেটা ছিল এক বিরাট মাইলফলক। কিন্তু দুর্ভাগ্য— মাত্র চার বছর পরই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফকে যখন সুপ্রিম কোর্ট বরখাস্ত করল, তার পিছনে আবার
দেখা গেল দৃঢ় সামরিক সমর্থন। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা দফতরের ব্যবস্থাপনায় ঘটল এক ‘কোরিয়োগ্রাফড’ নির্বাচন, ক্ষমতায় এলেন ইমরান খান।

অর্থাৎ, ২০১৩-১৮’র মধ্যে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল, খুব দ্রুত। ২০০৮-১৩ সময়কালে যে মিশ্র বা ‘হাইব্রিড’ সরকারে সামরিক বিভাগ ও অসামরিক প্রশাসন হাত মিলিয়ে চলেছিল, সেটা একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়তো কাজ চালিয়ে যেতেও পারত। কিন্তু পরিস্থিতি সে রকম রইল না। প্রথমে সেনাকর্তাদের চোখে ইমরান খান পছন্দসই ব্যক্তিই ছিলেন— পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল)-এর নওয়াজ় শরিফের তুলনায়। ২০১৩-তে জাতীয় স্তরে পিএমএল(এন) জিতলেও পাখতুন-প্রধান খাইবার পাখতুনখোয়ায় জয় পেল পিটিআই। তার পর থেকেই শুরু হল ইমরান খানের ধর্না, প্রতিবাদ আন্দোলন। তিনি সঙ্গী পেলেন ইসলামি বুদ্ধিজীবী নেতা তাহির-উল-কাদরিকে। নাগরিক সমাজের একাংশে কাদরি ছিলেন বেশ ক্ষমতাশালী, নওয়াজ় শরিফ ও তাঁর ভাই পঞ্জাব-নেতা শাহবাজ় শরিফের জব্বর প্রতিপক্ষ। তবে খান-কাদরি আন্দোলন জনতার মন টানল না। এর মধ্যেই ঘটে গেল পেশোয়ারে পাবলিক স্কুলে সন্ত্রাসী হানা, যাতে মারা গেল ১৫০টি শিশু।

যে দেশে ‌গণতন্ত্র প্রথম থেকেই সামরিক-নিয়ন্ত্রিত পুতুল, জাতীয় পার্লামেন্টকে বলীয়ান করা সেখানে একটা অতি জরুরি কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু কে তা করে। পাকিস্তানে সকলেই জানে এবং মানে যে ক্ষমতায় পৌঁছনোর সহজতম পথ হল সামরিক বাহিনীকে তোষণ করা। ২০১৭-য় নওয়াজ় শরিফকে সরানোর সিদ্ধান্তের পর পরই ইমরান খান হয়ে গেলেন যেন পাক সেনাবাহিনীর হাতের ধারালো অস্ত্রের মতো। ‌এক দিকে পিটিআই-এর সমাজমাধ্যমপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে, অন্য দিকে প্রবাসী পাকিস্তানিদের সাহায্য নিয়ে, ইমরান খান নওয়াজ় শরিফের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতি ‘আখ্যান’ তৈরি করলেন। শরিফ আর পিপিপি-র বিরুদ্ধে জনমনে বিক্ষোভ ওস্কানো হল পুরো মাত্রায়। এবং জনমোহিনী রাজনীতির এই ঘরানার পিছনে রইল সামরিক নেতাদের পূর্ণ সমর্থন— ২০১৮ সালে এল ইমরানের নির্বাচনী সাফল্য।

তবে, পার্লামেন্টে সংখ্যাগুরু সমর্থন যে প্রধানমন্ত্রীর পিছনে, তাঁকে সরানো সহজ নয়। যে ভাবে সে কাজটা করা হল, পাকিস্তানের বিচারবিভাগের কলঙ্ক অনেকটাই বাড়ল তাতে। সেই বিচারবিভাগীয় ‘অভ্যুত্থান’-এর পিছনে রইল সংবাদমাধ্যমের প্রচার, শরিফ কত খারাপ লোক ইত্যাদি। ভোটের দিন, সেনার টহল রইল পথে পথে। পঞ্জাবে সেটাও যথেষ্ট হল না, ভোটগণনায় হস্তক্ষেপ করতে হল, যাতে পিটিআই-এর জয় নিশ্চিত করা যায়। তবু পাকিস্তানের ৩৩৬ সদস্য সম্বলিত পার্লামেন্টের ১৪১ সদস্য (৪২ শতাংশ) আসে যে পঞ্জাব প্রদেশ থেকে, তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে রইল পিটিআই (৬৭) আর পিএমএল(এন) (৬৪)-এর মধ্যে। ফলে এ বার সামরিক বাহিনীর পক্ষে অসামরিক ছাড়া অন্যান্য পথের কথাও বিবেচনা করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। ইমরান খানকে প্রবল নিয়ন্ত্রণে রাখা হল। এরই মধ্যে একটা বিপজ্জনক চাল চাললেন ইমরান, পঞ্জাবে এক জন অতি দুর্বল শাসককে শাসনভার দিলেন। যাতে তিনি কোনও ভাবেই তাঁর নেতৃত্বের পথে কোনও চ্যালেঞ্জ হয়ে না ওঠেন। ক্রমশ সেই উসমান বাজ়দার এমন দুর্নীতিসাগরে নিমজ্জিত হলেন যে, দেশের সর্বাপেক্ষা সুশাসিত প্রদেশটি তলিয়ে যেতে বসল। সামরিক হেডকোয়ার্টার্সে বেজে উঠল অ্যালার্ম। এত দিন ধরে লালনপালন পোষণতোষণ করবার পর ইমরান খানের ডানা ছাঁটতে শুরু করল সেনা কর্তৃপক্ষ— যাদের আর একটা উদ্বেগ ছিল পিটিআই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন (যাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর চিন, সৌদি আরব ও তুর্কিয়ে)। শেষ অবধি ইমরান খান পদচ্যুত হলেন ১০ এপ্রিল, ২০২২।

ইমরান খান দাবি করলেন, তিনি আমেরিকার চক্রান্তের শিকার। দেশের আমেরিকা-বিরোধী মেজাজকে তিনি কাজে লাগাতে চেষ্টা করলেন। কিছুটা লাভও হল। বিরাট প্রতিবাদ মিছিল মিটিংয়ের আয়োজন শুরু হল। কিছু দিনের মধ্যেই অবশ্য বোঝা গেল, বিষবৃক্ষের ফল ফলছে— যে সেনার হাতে এক দিন ‘ইমরান খান প্রোজেক্ট’ অত্যন্ত সফল ভাবে রূপায়িত হয়েছিল, তারাই এখন তাঁকে মূলে ছেঁটে ও কেটে ফেলার ব্রতে বদ্ধপরিকর। তারকা-নেতা গ্রেফতারের পর যে সব প্রশ্ন খুচরো ভাবে থেকে গেল, তা হল, সেই যে ৯ মে-র দাঙ্গাহাঙ্গামা, তা ‘পরিচালনা’র অপরাধে কি সামরিক আদালতে তাঁর বিচার হবে, না কি অসামরিক? প্রথমটা একটু গোলমেলে: অসামরিক নেতার বিচার কি সামরিক আদালতে হওয়া বৈধ? আবার দ্বিতীয়টা হলে সন্ত্রাসের অভিযোগে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, সেটাও কি বাঞ্ছনীয়? হাজার হোক, ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা, আজও। তা ছাড়া স্মৃতি এখনও টাটকা, ১৯৭৯ সালে জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মিলিটারি-সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট। পাকিস্তানের জনমানসে সে দাগ আজও মিলায়নি। ৪৫ বছর পরে, আবার?

এ সবের মধ্যে আগামী কাল জাতীয় নির্বাচন। কত দূর স্বাভাবিক, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক হতে পারে এই ভোট? শুধু তো সেনা নয়, বৃহৎ পুঁজিপতিরা আছেন সেনাবাহিনীর পিছনে। অর্থনৈতিক সংস্কার না হলে পাকিস্তানের চূর্ণবিচূর্ণ সামাজিক স্থিতি কিছুতেই ফিরতে পারে না, শাসনব্যবস্থার হাল পাল্টাতে পারে না, বৈধ নির্বাচনী রাজনীতিও হতে পারে না। লক্ষণীয়, ১৯৭৩ সালে সংবিধান শাসন গ্রহণের পর পঞ্চাশ বছর ধরে এই দলিলটিকে কেবল অমান্য করতেই ব্যবহার করা হয়েছে, মান্য করার জন্য নয়। সেনা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, এক দিকে ভারতের উস্কানি, অন্য দিকে আফগানিস্তানে তালিবান প্রত্যাবর্তনের ফলে সেনাবাহিনীর বাজেটই বেশি বাড়ানো দরকার, ও সব অর্থনৈতিক সংস্কার পরে হবে। ২০২৩-২৪’এর বাজেটে ১৫.৭ শতাংশ বরাদ্দ বেড়েছে প্রতিরক্ষায়, সঙ্গে লম্বা হয়েছে রাজনীতিকদের সামরিক নিয়ন্ত্রণে রাখার দড়ি। কয়েক দশক ধরে পাকিস্তান নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে লাভা-উদ্গিরণ করে চলেছে, তবে এই মুহূর্তে তার সঙ্কটটা— অভূতপূর্ব। ভোটের পথেই এগোতে হবে, কিন্তু কেবল ভোট দিয়েই সমাধানে পৌঁছনো অসম্ভব। অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। জাতীয় আয় বাড়াতে হবে, ধনিক সম্প্রদায়ের আয়কর বাড়াতে হবে, সন্ত্রাসের জুজু দেখিয়ে অন্য খরচ কমাতে হবে। মানুষ এখনই বড় পরিবর্তন চায়, কিন্তু নেতারা কি মানুষের সেই অর্থনৈতিক দাবিটি শুনতে পাচ্ছেন? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক নেই। ইমরান খান একটা ভয়ঙ্কর কাজ করেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির সঙ্গে সমস্ত আলাপচারিতা বন্ধ করে দিয়েছেন। বহু সামাজিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে তলিয়ে যাওয়া পাক রাজনীতির স্থিতি ও ভারসাম্য না ফিরলে সমাজ বা অর্থনীতির গতির অভিমুখই বা পাল্টাবে কী ভাবে।
২০০৬ সালে পিপিপি আর পিএমএল(এন) নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একটা চার্টার তৈরি করেছিল, সেটা দিয়েই জেনারেল মুশারফকে ক্ষমতাচ্যুত করা গিয়েছিল। খুব জরুরি হয়ে উঠেছে তেমন কিছু। গণতান্ত্রিক মত মেনে দলগুলো যদি সেই জায়গায় না আসতে পারে, তবে কর্তৃত্ববাদী ‘ডিপ স্টেট’ সে দেশে গণতন্ত্রের শেষ আশাটিকেও পিষে নির্মূল করে দেবে। হয়তো সে দিন বেশি দূরে নেই।

সংক্ষেপিত। মূল প্রবন্ধ: জার্নাল অব ডেমোক্র্যাসি (জানুয়ারি ২০২৪)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pakistan Election Imran Khan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE