Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Maharana Pratap Museum

‘রাজসিংহ’, আর এক বার

মিউজ়িয়মে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মহারানার জীবনের উপরে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখার বন্দোবস্ত। মূল বিষয় আকবরের সঙ্গে প্রতাপের দ্বন্দ্ব।

Maharana Pratap Museum

—প্রতীকী ছবি।

আকাশ বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪ ০৭:২০
Share: Save:

রানা প্রতাপের বাহন চেতকের সমাধিমন্দির যেখানে, সে গ্রামের নাম বালিচা। নিকটেই মহারানা প্রতাপ মিউজ়িয়ম। দেখলাম, গোটা দেশ থেকে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এসেছে রাজস্থান সফরে, ‘দেশকে চিনতে’! তারা ভারতকে চিনছে, কোনও না কোনও গাইডের জবানিতে। তাঁর ভাষ্যে জানছে রাজস্থানের ইতিহাস, দুর্গ ভাঙা-গড়ার ইতিবৃত্ত, নানা রহস্যের গলিঘুঁজি। দেশকে জানার জন্য তার অতীতকে তো জানতে হবেই। নানা দুর্গ চত্বরে নিত্যদিন অগুনতি গাইডের বয়ানে অতীতের গল্প শুনছেন অসংখ্য ভ্রমণার্থী। এবং তাই নীরবে হয়ে উঠছে এক চলমান মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন যন্ত্র।

মিউজ়িয়মে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মহারানার জীবনের উপরে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখার বন্দোবস্ত। মূল বিষয় আকবরের সঙ্গে প্রতাপের দ্বন্দ্ব। সে ছবিতে প্রতাপের সর্বশরীর ধীরোদাত্ত বীরত্বের আলোয় উজ্জ্বল। আকবর নিখাদ ভিলেন। সম্মুখসমরে বিজয়ী আকবরের সেনাপতি, বাহিনীও চিত্রিত এমন করে, যাতে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে দর্শকের মনে। শেষে নিয়মরক্ষার্থে উল্লেখ— এই যুদ্ধকে অনেকে মনে করেন দুই সম্প্রদায়ের যুদ্ধ। আসলে তা নয়। যুদ্ধে মহারানার প্রধান সেনাপতি ছিলেন জাতিতে মুসলিম পাঠান সেনানায়ক হাকিম খাঁ সুরি আর আকবরের প্রধান সেনাধ্যক্ষ অম্বরের মহারানা মান সিংহ। হলদিঘাটির সেই যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন হাকিম খাঁ সুরি এবং তাঁর আফগান সেনারা। মোগল বাহিনীর হাতে। হাকিম খাঁ সুরি-র বীরগাথা আজও উজ্জ্বল রাজস্থানে। তাঁর কামান চালানো মূর্তি রানা প্রতাপের মূর্তির অনতিদূরে শোভা পাচ্ছে উদয়পুরের ফতেহ সাগর হ্রদের পাড়ে। তাঁকে পীরের আসনে বসিয়ে প্রতি বছর মেলাও বসে হলদিঘাটিতে।

স্বজাতি নিয়ে আত্মগৌরব অন্যায় নয়। রাজপুতানার বীরত্বও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু পুরোপুরি অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে মোগল আনুগত্য স্বীকারের ইতিবৃত্ত। মেহেরানগড়ের প্রদর্শনীতে দিব্য শোভা পাচ্ছে শাহজাহান প্রেরিত মৈত্রী উপহারের তরবারি, সিংহাসন, হাওদা। কিন্তু আর পাঁচটা জায়গার মতোই এ ক্ষেত্রেও দুর্গ ধ্বংসের দায় একতরফা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘শত্রু’ মোগলদের উপর। তারাই লুটপাট করে এখান থেকে খুলে নিয়ে গেছে সোনা, ওখান থেকে হিরে-জহরত-মাণিক্য! প্রায় সর্ব ক্ষেত্রে সময়-কাল নির্বিশেষে অপরাধীর নাম আলাউদ্দিন খিলজি। ক্ষেত্রবিশেষে ঔরঙ্গজেব। কোনও রাজবংশের উৎস হিসেবে দেখানো হচ্ছে শ্রীরামচন্দ্রের পুত্রদের, কোনও রাজবংশের ক্ষেত্রে পাণ্ডবভ্রাতাদের, কোনওটির বেলায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণর যদুবংশকে। প্রায় প্রতিটি দুর্গে ভাঙা মূর্তি দেখিয়ে বলা হচ্ছে— সব মোগলদের ‘হাজারে-হাজারে’ মন্দির ধ্বংসের নিদর্শন। খিলজি থেকে আলমগির— মুসলমান শাসক মাত্রই পরিচয় মোগল! ভাঙা মূর্তি হিন্দু ধর্মে পূজা হয় না বলে এগুলো নাকি এ ভাবে রাখা! সচেতনতা ভিন্ন চোখে পড়বে না অধিকাংশ মূর্তিই দেবমূর্তি নয়। মন্দির গাত্রের বা ওই জাতীয় কোনও ভাঙা স্মারক। তার মধ্যে বিপুলসংখ্যক জৈন মূর্তিও বিরাজমান। প্রায় প্রতিটা দুর্গেই নাকি অধুনা মুখবন্ধ সুড়ঙ্গপথ আছে। তার উপযোগিতার ব্যাখ্যা— মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইষ্টদেবতাকে নিয়ে রাজার পলায়ন বা সমজাতীয়। সম্পূর্ণ অনুচ্চারিত থাকছে ভ্রাতৃঘাতের রক্তে পিছল রাজপুতানার আত্মঘাতী অন্তঃপুরের কাহিনি।

চিতোরের পদ্মাবতী-উপাখ্যান সত্য না কল্পনা— অমীমাংসিত থাকলেও একটি ছোট্ট চতুষ্কোণ ভূমিখণ্ডকে দশহাজারাধিক রাজপুত জেনানার জহরব্রত পালনের পবিত্র প্রান্তর বলে প্রদর্শিত হয়ে চলেছে আগত দর্শনার্থীদের কাছে। সেই বিশ্বাসই মস্তিষ্কে সঞ্চিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম-নগর, মাঠ-পাথার, বন্দরে। পাশেই ইতিহাসসম্মত মীরা বাইয়ের মন্দির। কৃষ্ণময় মীরার শ্বশুরকুলের ইষ্টদেবতাকে মেনে সূর্যসাধিকা না হতে পারার ফল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে— বংশীধরমূর্তিতে বিলীন হয়ে যাওয়ার মিথকে বাস্তব ধরে।

মহারানা প্রতাপ মিউজ়িয়মের স্মারক-বিপণিতে বিক্রি হচ্ছিল একটা বই। জেমস টড-এর দ্য অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ় অব রাজস্থান। মূলত যে বইকে ভিত্তি করে রাজসিংহ লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তখন বোঝা সম্ভব ছিল না যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা টড সাহেবের এই বই কেমন করে রচনা করছে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’র তাত্ত্বিক ভিত্তি। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বহু শতাব্দীর, এমনটা সাব্যস্ত করা ছিল কল্পনা-বাস্তবের মিশেলে গড়া এই ‘ইতিহাস’ লেখার মূল অভিসন্ধি। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র ভেবেছিলেন আর্ম, টড, মানুচি প্রমুখের উপর নির্ভর করলে পক্ষপাতদোষ থাকবে না। ঔপনিবেশিক ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যমূলক অভিপ্রায় সম্পর্কে সচেতনতা তখনও গড়ে ওঠেনি। রাজপুত-মোগলের বিরোধাখ্যান লেখার পিছনে বঙ্কিমচন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘হিন্দুদিগের বাহুবল’ প্রদর্শন। কিন্তু ‘বিজ্ঞাপন’ থেকে ‘উপসংহার’-এ বার বার বলেছিলেন পাশের সত্যটাও: ‘হিন্দু হইলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না... ভাল মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।... যখন মুসলমান এত শতাব্দী ভারতবর্ষের প্রভু ছিল, তখন রাজকীয় গুণে মুসলমান সমসাময়িক হিন্দুদিগের অপেক্ষা অবশ্য শ্রেষ্ঠ ছিল।’

টড নেই। ট্র্যাডিশন আছে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্ররা বিলুপ্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Maharana Pratap Rajasthan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE