Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
দেশের ‘জাগ্রত নাগরিক’দের বিরুদ্ধে সঙ্ঘীয় আক্রমণ
Mohan Bhagwat

এ বার মার্ক্স ও আম্বেডকর?

মোহন ভাগবতের ভাষণে উঠে এসেছে যুদ্ধ, সন্ত্রাস থেকে শুরু করে জলবায়ু সঙ্কট পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কথা।

প্রচারক: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত বক্তৃতা দিচ্ছেন, নাগপুর, ২৪ অক্টোবর।

প্রচারক: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত বক্তৃতা দিচ্ছেন, নাগপুর, ২৪ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:২৩
Share: Save:

বিজয়াদশমী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাদিবস। শস্ত্রপূজা সহযোগে প্রতি বছর নাগপুরে সঙ্ঘের মুখ্যালয়ে এই দিনটি পালিত হয়। এই উপলক্ষে সরসঙ্ঘচালক যে ভাষণ দেন, তাকে সঙ্ঘের পথ-নির্দেশিকা বলা যায়। মোদী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর গোড়ার দিকে এই ভাষণে সরকারের প্রতি অভিভাবকের কিছু পরামর্শও থাকত। আজকাল সেই পরামর্শ প্রশংসামূলক প্রচারের রূপ নিয়েছে। আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে এ বারের ভাষণ হয়ে উঠেছে শুধু সঙ্ঘের কর্মী বাহিনী নয়, জনগণের উদ্দেশে সরাসরি নির্বাচনী আহ্বান। ২০২৫-এ সঙ্ঘের শতবর্ষ, সরকারি ক্ষমতায় আসীন থেকে ও বলীয়ান হয়েই সঙ্ঘ এই শতবর্ষ উদ্‌যাপন করতে চায়।

মোহন ভাগবতের ভাষণে উঠে এসেছে যুদ্ধ, সন্ত্রাস থেকে শুরু করে জলবায়ু সঙ্কট পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কথা। ভারতের যাবতীয় সমস্যাকে এই বৈশ্বিক সঙ্কটের ভারতীয় সংস্করণ হিসাবেই তিনি চিহ্নিত করেছেন। বিশেষত মণিপুর তাঁর চোখে এক বিদেশি ষড়যন্ত্র। বিদেশি ষড়যন্ত্র হোক অথবা দেশজ সংঘাত, নির্মম সত্য হল— প্রায় সাত মাস ধরে মণিপুর জ্বলছে আর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সেই আগুন নেবাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। যে সরকার নিজের দেশে সংঘাতের সমাধান করতে পারে না, কেন ইউক্রেন বা প্যালেস্টাইনের প্রশ্নে সমাধানের জন্য বিশ্ব সেই সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকবে, এই রহস্যের কোনও ব্যাখ্যা ভাগবত দেননি। বিশ্বমঞ্চে মোদী সরকারের প্রচারের বিপরীতে কানাডাতে শিখ সম্প্রদায়ের এক নেতার হত্যার ব্যাপারে ভারত সরকারের হাত থাকার অভিযোগের প্রশ্নে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড আজ কানাডার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ইজ়রায়েলের তাঁবেদারি করতে গিয়ে আরব দুনিয়া থেকে ভারত আজ প্রায় বিচ্ছিন্ন— কাতারের মতো মিত্র দেশে ভারতীয় নৌবাহিনীর আট জন আটক প্রাক্তন কর্মীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে এখন মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে।

দেশের যাবতীয় সমস্যার পিছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র খোঁজা এবং দেশের ভিতরে সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বর ও প্রতিবাদ আন্দোলনকে সেই বিদেশি ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করা— স্বৈরাচারী শাসনের এ এক অতি পরিচিত রণনীতি। জরুরি অবস্থা পর্যায়ে তদানীন্তন কংগ্রেস শাসনকে এই রণনীতি অনুসরণ করতে আমরা দেখেছি। ক্ষমতায় এসে সঙ্ঘশিবির এই রণনীতিকে এখন তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আক্রমণের প্রধান ধারা করে তুলেছে। বিরোধীদের পাকিস্তান যেতে বলা দিয়ে এই অভিযান শুরু হয়েছিল। আজ পাকিস্তান ছাড়াও বিরোধীদের কখনও চিন, কখনও অতীতের ঔপনিবেশিকতার বা সুবিধা অনুযায়ী পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসাবে ছাপ মেরে দেওয়ার অভিযান চলছে। মতাদর্শগত ভাবে আরএসএস চিরকাল মার্ক্সবাদকে প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে এসেছে। এই ধারাতেই আবিষ্কার হয়েছে আর্বান নকশাল থেকে অতি সম্প্রতি কলমধারী নকশাল তকমা। এ বার ভাগবতের ভাষণে আমরা পেলাম নতুন শব্দবন্ধ— সাংস্কৃতিক মার্ক্সবাদী এবং জাগ্রত নাগরিক।

ভাগবতের মতে, এই স্বঘোষিত সাংস্কৃতিক মার্ক্সবাদীরা ১৯২০ সালের পর থেকেই মার্ক্সকে ভুলে গিয়েছেন। মার্ক্সবাদীরা অবশ্যই নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করে পরিচয় দেন না। তবে গত একশো বছর ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে সাংস্কৃতিক মার্ক্সবাদী শব্দ ব্যবহারের একটি পরিচিত ইতিহাস আছে। সে প্রশ্নে আসার আগে জানতে ইচ্ছে করছে, ১৯২০ সালের আগের মার্ক্সবাদীদের সম্পর্কে ভাগবত কি তা হলে এখন অন্য মত পোষণ করছেন? ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইস্তাহার বা ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব সবই তো ১৯২০ সালের আগের মার্ক্সবাদ!

১৯২০ সালের পর থেকে যেটা হয়েছে, তা হল ফ্যাসিবাদের উত্থান। ফ্যাসিবাদ তখন থেকেই মার্ক্সবাদকে কখনও ইহুদি বলশেভিকবাদ বা কখনও সাংস্কৃতিক মার্ক্সবাদ নামে অভিহিত করে আক্রমণ শাণিয়েছে। অতি দক্ষিণপন্থীদের সেই বহুব্যবহৃত ভাষাকেই ভারতে এ বার আমদানি করেছেন মোহন ভাগবত— কেন? পাঠক জানেন, গান্ধীহত্যার পর নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পেতে আরএসএস একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়েছিল, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হল তাদের ঘোষিত মতাদর্শ। কট্টর রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, উচ্চবর্ণের ও পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী আধিপত্য, চরম সংখ্যালঘুবিদ্বেষ— এই হল সঙ্ঘের তথাকথিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান। সঙ্ঘ চায় এই সমস্ত প্রশ্নে তাকে যেন কোনও প্রতিরোধের মুখে না পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে আর্বান নকশাল ধুয়ো তুলে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলনকে নিশানা বানানোর পাশাপাশি প্রগতিশীল লেখক-গবেষক-অধ্যাপক সমাজকে কোণঠাসা করতে সাংস্কৃতিক মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে আজ তাই এই কুৎসা অভিযান। ভাগবতের ভাষণের পাশাপাশি তাই দেখা যায় জেএনইউ-তে কর্তৃপক্ষের মদতে সঙ্ঘের উদ্ধত শোভাযাত্রা।

আজ এ দেশে নিপীড়ন ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আলোড়ন দানা বাঁধছে। জাতভিত্তিক জনগণনা এবং সংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ও সুযোগের দাবি দেশ জুড়ে এক কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসাবে উঠে এসেছে। নারী-নির্যাতনের ভয়াবহতার বিপরীতে নারী-স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের প্রশ্নে নারী-আন্দোলন আজকের এক ক্রমবর্ধমান সামাজিক বাস্তবতা। লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে এলজিবিটি ও রূপান্তরকামী সমাজের জোরালো কণ্ঠ এবং সমলিঙ্গ প্রেম ও বিবাহের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের সহানুভূতি রক্ষণশীল মোড়লদের বিচলিত করে তুলেছে। সতীপ্রথা রুখতে ও বিধবাবিবাহ চালু করতে রামমোহন-বিদ্যাসাগরকে যেমন তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়, হিন্দু মহিলার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হিন্দু কোড বিল আনার ফলে আম্বেডকরকে যেমন খলনায়ক বানিয়ে দেওয়া হয়, আজও ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’-এর পাশাপাশি সমাজ রসাতলে যাচ্ছে আওয়াজ তুলে রক্ষণশীল শিবির একই ভাবে পথ আগলে দাঁড়াতে চাইছে। তাদের উৎসাহ দিতেই ‘তথাকথিত জাগ্রত নাগরিক’দের বিরুদ্ধে ভাগবতের এই বিষোদ্গার।

মজার কথা, একই সঙ্গে ভাগবত আজকাল শুধু আগামী দু’শো বছর সংরক্ষণ মেনে নেওয়ার কথাই বলছেন না, সংবিধান সভার বৈঠকে আম্বেডকরের শেষ দু’টি ভাষণও সবাইকে পড়তে বলছেন। ভাগবতের ধারণা, ভারতের হিন্দু ঐতিহ্যের প্রবক্তা হিসাবে আম্বেডকরকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে। সংবিধান সভায় প্রদত্ত আম্বেডকরের ভাষণ অবশ্যই সবার পড়া উচিত। এই ভাষণের ছত্রে-ছত্রে আম্বেডকর বলেছেন সংবিধানের পথে শুধু সরকার নয়, সমাজকে পরিচালনা করতে পারলেই আধুনিক ভারত গড়ে উঠবে, যার চাবিকাঠি হল স্বাধীনতা, সাম্য ও বন্ধুত্বের সুদৃঢ় ও সম্মিলিত ভিত্তি। এক নাগরিক এক ভোটের প্রতিশ্রুতিতে মুগ্ধ হয়ে আটকে না থেকে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করার আহ্বান জানিয়েছেন আম্বেডকর। রাজনীতিতে অন্ধভক্তি ও ব্যক্তিপূজা কী ভাবে গণতন্ত্রের আবরণে একনায়কতন্ত্রকে ডেকে আনে, সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন সদ্যোজাত স্বাধীন গণতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিককে।

ভাগবত আমাদের সংবিধান সভায় আম্বেডকরের ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আসুন, আমরাও তাঁর স্মৃতিকে একটু উস্কে দিই। সংবিধান যখন গৃহীত হচ্ছে, তখন সঙ্ঘের মুখপত্রে খোলাখুলি এই সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। প্রধান অভিযোগ, এই সংবিধানে ভারতীয়তার কোনও ছাপ নেই, মনুস্মৃতির আদলে এ সংবিধান লেখা হয়নি। আজও আম্বেডকরের সংবিধানকে ইংরেজদের সংবিধান হিসাবে চিহ্নিত করে অমৃতকালে নতুন সংসদ ভবনে নতুন সংবিধানের রব তুলে চলেছে সঙ্ঘ শিবির। ১৯৪৯-এর নভেম্বরে সংবিধান গ্রহণের সাত বছরের মাথায় আম্বেডকর প্রয়াত হন। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে সংবিধানে ঘোষিত ধর্মপরিবর্তনের অধিকারকে প্রয়োগ করে সঙ্ঘের মুখ্যালয় নাগপুরে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাদিবস বিজয়াদশমীতেই লক্ষাধিক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দুধর্ম ছেড়ে নতুন বৌদ্ধধর্ম বা ধম্মকে বেছে নিয়েছিলেন আম্বেডকর। হিন্দুত্বের মোড়কে এ-হেন আম্বেডকরকে পোরা যাবে কি? ধর্মের নামে সামাজিক নিপীড়ন ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অদম্য স্পর্ধা হিসাবেই আম্বেডকর বেঁচে আছেন এবং থাকবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mohan Bhagwat RSS
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE