Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ভারতীয় অর্থনীতির ক্লাসরুম আর আমাদের দেশকাল
Society

ওরা মেনে নেয় না সব কিছু

ধর্ষণে মুক্তিপ্রাপ্ত দাগি অপরাধীরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, উপমহাদেশের নারী অবমাননার ইতিহাসে সে কথা নতুন নয়।

দেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নিতে গেলে ধর্মপরিচয় লাগত না।

দেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নিতে গেলে ধর্মপরিচয় লাগত না।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ ০৪:৩৮
Share: Save:

সে এক অন্য ভারত ছিল। বেশি দিন আগের কথা নয়। হয়তো এক দশক অথবা তার একটু বেশি। দেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নিতে গেলে ধর্মপরিচয় লাগত না। শিল্প সৃষ্টি করতে হলে, সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে সামাজিক স্বীকৃতি এক রকমের প্রয়োজনীয় থাকলেও, তার ধর্মীয় রূপ ছিল না। শিক্ষায়, পাঠ্যক্রমেও ছিল না সেই কটু গন্ধ।

ধর্ষণে মুক্তিপ্রাপ্ত দাগি অপরাধীরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, উপমহাদেশের নারী অবমাননার ইতিহাসে সে কথা নতুন নয়। তবে একটি বিশেষ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কৃতিত্বে নারকীয় অত্যাচারের শাস্তি স্বাধীনতা দিবসে নিঃশর্ত মুক্তি ও সংবর্ধনা, অত্যাচারের এই রকম লজ্জাজনক ধর্মীয় রং ছিল না।

তাই নতুন পাঠ্যক্রমের (যার গালভরা নাম সিবিসিএস (চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম) অন্তর্ভুক্ত নতুন শিক্ষানীতি বা নিউ এডুকেশন পলিসি (এনইপি) পড়াতে গিয়ে স্নাতক স্তরের অর্থনীতির ছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইতস্তত করতে হয়।

“ম্যাম, ক্লাস টুয়েলভের পলিটিক্যাল সায়েন্সের সিলেবাস থেকে নাকি পুরো ডেমোক্র্যাসি চ্যাপ্টারটাই বাদ চলে গিয়েছে? কেন ম্যাম? সিলেবাস কমাবার জন্য? কিন্তু আরও বড় বড় তো কত চ্যাপ্টার আছে, এগজ়িকিউটিভ, ইলেকশন— সেগুলো বাদ গেল না কেন?” কিংবা, “আমাদের সিলেবাস থেকে কি কিছু বাদ যাবে ম্যাম? সবাই বলছে প্ল্যানিং, জমি বণ্টন সব বাদ যাবে। সত্যি ম্যাম?”

করোনার ভয়ের কিছুটা কাটিয়ে, আর কিছুটা সঙ্গে নিয়েই জমজমাট কলেজ এখন। অনলাইন পড়াশোনার বদভ্যাস কাটিয়ে মেয়েরা আবার পুরনো ছন্দে। তাই ক্লাসরুম প্রশ্নে মুখর। “এ বার থেকে সব স্কুলে নাকি হিন্দিতে লেখাপড়া করতে হবে? এনইপি-তে মাল্টিলিঙ্গুয়ালিজ়ম বলে নাকি লেখা আছে— ক্লাস ফাইভ অবধি ইংরেজি নয়, অন্য ভাষায় পড়তেই হবে? কেন ম্যাম?”

সন্তানের অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে অভ্যস্ত থাকি আমরা বাবা-মায়েরা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কিছুটা কৌতূহল নিবৃত্তি, কিছুটা পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব থাকে আমাদের। একই ভাবে, শিক্ষক অধ্যাপক হয়েও আমরা চেষ্টা করি তাদের উত্তর দেওয়ার। কিন্তু একই ক্লাসে যে আছে আহেলি আর আয়েশা, কিংবা অমৃতা আর রেহানা? কী ভাবে বলব যে, একটি ধর্মসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এমন বিদ্বেষ যে, তাদের বইয়ের পাতা থেকে পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। “মোগল ইন্ডিয়ার ইতিহাস নাকি বাদ চলে যাবে ম্যাম? বাবর, আকবর কেউ থাকবে না? কেন ম্যাম?”— এই প্রশ্নের উত্তরে অতএব মৌন থাকা ছাড়া উপায় কী?

ওরা কিন্তু চিন্তিত নয়। আহেলিও নয়, আয়েশাও নয়। এখনও ওদের নরম আলোর মুখে হাসি। ওরা এক সঙ্গে টিফিন খায়, পুজো আর ইদের ছুটি— দুটোতেই একে অপরের বাড়ি যায়। টিচার্স ডে’তে সাজগোজের সময় একে অপরের লিপস্টিক ব্যবহার করে। তাদের কী করে বলি যে, এক বিশেষ সম্প্রদায়ের অংশ বলে আলাউদ্দিন খিলজি থেকে বাবর, আকবর থেকে মুর্শিদকুলি খান— সবাইকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যে সব স্থাপত্য— তা তাজমহল হোক বা লাল কেল্লা, বা কুতব মিনার, আমাদের দেশের মানচিত্র থেকে আলাদা করা যায় না, তাদের নির্মাণ যাঁদের— সেই শাহজাহান বা কুতবউদ্দিন আইবককে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

কোনও মতে ঢোক গিলে, আয়েশা বা রেহানার চোখে চোখ না রেখে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু চোখ এড়ায় না যে, উত্তর শুনে রেহানার মুখটা কালো হয়ে গেল।

যেমন শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত আইন বা রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট বিষয়ে যখন বলতে হয় যে, নামীদামি স্কুলেও দারিদ্রসীমার নীচের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি নেওয়া বাধ্যতামূলক, কমবয়সি স্পষ্ট চোখেরা প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু ছাত্রী অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক পারিবারিক অবস্থান থেকে এলেও, অন্য রকম ছাত্রীও যে নেই, তা নয়। তারা ভালই জানে, নিয়ম যা-ই হোক, বাস্তব আদৌ তেমনটা নয়।

কবি-বর্ণিত সেই আঠারো বছর বয়সের থেকে এক দুই বছর মাত্র বড় হবে তারা। সুতরাং তারা জানলেও, মেনে নেয় না সব কিছু।

ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারা রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্টে ভর্তি হওয়া দলিত ছাত্রের গল্প শোনায় তারা যে, এই আইনের সাহায্যে স্কুলে ভর্তি হতে পারলেও সুযোগ পায় না সামনের বেঞ্চে বসার। ক্লাসে কোনও বর্জ্য থাকলে, বা উচ্চতর অবস্থানের কোনও সহপাঠী কোনও কিছু ফেললে তাকে গিয়ে পরিষ্কার করতে হয় সেই আবর্জনা। এক সঙ্গে বসে জল খেতে, খাবার খেতে পারে না সে।

আবার যেমন, পঞ্চায়েত পড়ানোর সময়, গ্রামে রাস্তা সারানোর জন্য তাদের কোথায় গিয়ে ধর্না দিতে হয়, মহিলা পঞ্চায়েতের প্রধানের পরিবর্তে কেমন তার স্বামী অফিসে আসেন— এ সব গল্প থামতে চায় না মোটেই। উত্তরবঙ্গের মেয়েটি বলে, তাদের ওখানে অবস্থা অনেক ভাল নদিয়ায় তার বন্ধুর গ্রামের পঞ্চায়েতের থেকে।

“কাজ করানোর জন্য চাঁদা তুলে এক্সট্রা পয়সা দিতে হয়— তবে সে তো সব জায়গাতেই দিতে হয়। তাই না ম্যাম?”

অর্থনৈতিক তত্ত্ব, সমসাময়িক বাস্তব ইত্যাদি দিয়ে অপ্রস্তুত অবস্থাকে পেরিয়ে যেতে হয়।

আর আমরা ভাবি, অন্তত ওরা যাতে না মেনে নেয়, অন্তত ওরা যেন চেষ্টা করে বদল আনার— যেটুকু বদলের চেষ্টা আজও করা যায়।

কিছুটা আশা, কিছুটা দীর্ঘশ্বাসে শেষ হয় ভারতীয় অর্থনীতির ক্লাসগুলি। “পরের ক্লাসে আমাদের বিষয়— ভারত সরকারের প্রচলন করা নতুন হেলথ স্কিম। কে কে জানো, হাত তোলো।”

অর্থনীতি বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Politics Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE