E-Paper

‘প্রতিভার লিঙ্গ হয় না’

একই শিল্পে যখন ‘মেয়েদের নাচ’ আর ‘ছেলেদের নাচ’ বলে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ থাকে তখন আশঙ্কা হয় যে, এর মধ্যে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে নারীবিদ্বেষ, এবং কখনও-কখনও অবশ্যই সমকাম-বিদ্বেষ।

ভাস্কর মজুমদার

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪৭
করণ জোহরের রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি-তে (ছবিতে একটি দৃশ্য) নায়িকার বাবা চন্দন চট্টোপাধ্যায় (টোটা রায়চৌধুরী) এক জন নৃত্যশিল্পী।

করণ জোহরের রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি-তে (ছবিতে একটি দৃশ্য) নায়িকার বাবা চন্দন চট্টোপাধ্যায় (টোটা রায়চৌধুরী) এক জন নৃত্যশিল্পী। —ফাইল চিত্র।

নাচিয়ে— পুরুষ? করণ জোহরের রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি-তে (ছবিতে একটি দৃশ্য) নায়িকার বাবা চন্দন চট্টোপাধ্যায় (টোটা রায়চৌধুরী) এক জন নৃত্যশিল্পী। ভারতে পুরুষ নৃত্যশিল্পীর জীবন যে অনেক সময়ই ব্যথাতুর, এমন ইঙ্গিত এই ছবি বহন করে। আমাদের চার পাশের শিল্পীদের অভিজ্ঞতাও তার সাক্ষ্য দেয়। বিশেষত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পের উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে যে, ছেলেদের নাচকে ‘পুরুষোচিত’ হয়ে উঠতে হবে। এমন হয় কারণ ভারতের এই নৃত্যধারাগুলি নারী-পুরুষ লিঙ্গপরিচয়ের দ্বারা খুব বেশি রকম নির্দিষ্ট (জেন্ডার্ড)। অতীতে দীর্ঘ দিন শ্রেণিচেতনাও প্রবল ছিল— তখন নাচ করা ছিল শুধুমাত্র ‘খারাপ’ মেয়েদের কাজ। ভদ্রবাড়ির ‘ভাল’ মেয়েরা কখনওই নৃত্যচর্চার অধিকার পেতেন না। নৃত্যশিল্পকে দেহব্যবসার সমার্থক ভাবা হত। সেই যুগ পার করে আসা গিয়েছে, আজ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরাও নাচ শেখেন এবং মঞ্চে নাচ করেন। তবে সব দেওয়াল এখনও ভাঙেনি— নৃত্যশিল্পের সঙ্গে এমন একটা ধারণা জুড়ে আছে যে নাচ করা পুরুষের কাজ নয়। পুরুষ যদি নাচ করে তবে সে ‘মেয়েলি’ হয়ে উঠবে, সারাক্ষণ এই আশঙ্কা দেখা যায়। হয় নৃত্যশিল্পকেই ‘পুরুষোচিত’ হয়ে উঠতে হবে, আর নাহয় পুরুষ নৃত্যশিল্পের চর্চা করবে না। যে সব পুরুষ নাচের চর্চা করবে, তাদের উপর নেমে আসবে সামাজিক হেনস্থা। এই হেনস্থার কাহিনি বহু সাহিত্য এবং সিনেমাতে বিধৃত।

অথচ, ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যের আদিগুরু ভগবান শিবের নটরাজ রূপ। তাঁর তাণ্ডব মোটামুটি সব ক’টি শাস্ত্রীয় নৃত্যধারাতেই আলোচিত ও অভিনীত হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যরূপে কালীয় নাগের মাথার উপর নৃত্যকেও শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলি নৃত্য-পরিকল্পনার প্রেরণা হিসাবে গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ পৌরাণিক কাহিনিতে পুরুষের নাচ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করত। হয়তো সে-কারণেই মহাদেব এবং শ্রীকৃষ্ণের নাচকে ‘পুরুষের নাচ’ বলে ধরা হয়। সেই নাচের রূপটি প্রধানত ‘তাণ্ডব’— বিক্রমের প্রদর্শন। আর নারীর নাচ হবে কমনীয়।

একই শিল্পে যখন ‘মেয়েদের নাচ’ আর ‘ছেলেদের নাচ’ বলে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ থাকে তখন আশঙ্কা হয় যে, এর মধ্যে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে নারীবিদ্বেষ, এবং কখনও-কখনও অবশ্যই সমকাম-বিদ্বেষ। শুধু নৃত্য নয়, যে-কোনও শিল্পেই পুরুষ ‘মেয়েদের মতো’ হয়ে উঠতে পারবে না-ই বা কেন, এ প্রশ্ন কি কখনও আমরা করেছি? কেন কেউ ‘মেয়েলি’ হলে গেল গেল রব উঠবে? তার কারণ, পুরুষরা নিজেদের মেয়ে বলে দেখাতে লজ্জা পায়— পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা আসলে ‘নিকৃষ্ট’ জাতি। ‘মেয়েদের মতো’ যে কোনও জিনিসই অতএব ঘৃণ্য এবং ত্যাজ্য। তাই মেয়েলি পুরুষ ঘৃণার ও উপহাসের পাত্র। আর সে যদি নাচের চর্চার মতো ‘মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট’ কাজ করে, তবে তার সামাজিক হেনস্থা, কখনও-কখনও হিংসাও যেন স্বাভাবিক— এমনই মনে করা হয়। ভারতে বহু পুরুষ নৃত্যশিল্পী নিজের পরিবার, পরিজন, শিক্ষাঙ্গন— সর্বত্র এমন হেনস্থার ও হিংসার সম্মুখীন হয়েছেন। হয়তো বলা হয়েছে, ‘ছেলে হয়েছিস খেলাধুলা কর। মেয়েদের মতো নাচ করে কী করবি?’

ভারতীয় নৃত্যশিল্পের ইতিহাসে পুরুষশিল্পীই গুরুর ভূমিকা পালন করেছেন বেশি। নৃত্য পুরস্কারের ক্ষেত্রেও (যথা, সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার) তালিকায় পুরুষ নৃত্যশিল্পীরা বেশির ভাগই ‘শিক্ষক’। অন্য দিকে নারী নৃত্যশিল্পীরা প্রাথমিক ভাবে ‘পারফর্মার’। ফলে প্রায়ই দেখা যায়, পুরুষ নৃত্যশিল্পী একক শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে না হতে ‘গুরু’ হয়ে গিয়েছেন। তিনি শেখাবেন, ‘পারফর্ম’ করবে ছাত্রীরা।

ওড়িশির কেলুচরণ মহাপাত্র, কথকের বিরজু মহারাজ প্রমুখ সর্বজনশ্রদ্ধেয় নৃত্যগুরুদের অনেকেই অবলীলায় রাধা কিংবা অন্যান্য নায়িকার লাস্য মূর্ত করে তুলেছেন তাঁদের নাচে। সে সব সম্পদ ভিডিয়োতে ধরাও রয়েছে উত্তরপ্রজন্মের জন্য। তবু পুরুষ শিক্ষকদের একাংশ তাঁদের পুরুষ ছাত্রদের নির্দেশ দেন, “শক্ত হয়ে ছেলেদের মতো নাচো!” নৃত্যকে ‘পুরুষোচিত’ বানাবার তাগিদে অহেতুক জিমন্যাস্টিক বা অন্যান্য শরীরচর্চার উপাদান ঢুকিয়ে নৃত্যশৈলীগুলিতে একটি অদ্ভুত মাত্রা যোগ করার চেষ্টা চলে, যা টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিযোগিতামূলক নৃত্যানুষ্ঠানগুলোয় আমরা প্রায়শই দেখতে পাই।

রকি অউর রানি ছবিটিতে চন্দন চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটিকেও হেনস্থার শিকার হতে হয়, তা-ও আবার মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়িতে। বাড়ির পুরুষমানুষ এক জন নৃত্যশিল্পী, এ কথা শুনে হবু জামাইয়ের বাড়ির নানা লোক হেসে ওঠে, টিটকিরি করতে ছাড়ে না। চন্দন সব সহ্য করে নেয়। ও এত দিন সব সহ্য করেই এসেছে। আজ আর কোনও গালই তার গায়ে লাগে না। তবে চন্দন হবু জামাই রকিকে বলে, ‘হুনার কা কোই জেন্ডার নেহি হোতা’ (প্রতিভার কোনও লিঙ্গ হয় না)। সংলাপটি প্রণিধানযোগ্য। ভারতের সমাজ যে দিন এই সত্যকে উপলব্ধি করবে এবং অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারবে, সে দিন কোনও পুরুষ নৃত্যশিল্পীকে মানুষের অহেতুক ঘৃণা ও উপহাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না। সে দিন তাঁরা আপন আনন্দে নাচের ছন্দে এক সার্থক জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dance Talent

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy