Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Saraswati

তিনি শুধু ‘ছোটদের দেবী’ নন

এই ভাবমূর্তির ফলে তিনি যে এক জন অতি গুরুত্বপূর্ণ তান্ত্রিক দেবী, সেই বিষয়টি প্রায় জনমানসের অন্তরালে চলে গিয়েছে।

রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:০৪
Share: Save:

বর্তমানে সরস্বতী যে ভাবে স্কুল-কলেজ-বাড়ি-পাড়ার ক্লাবে বিদ্যা, সঙ্গীত, নৃত্য ও চারুকলার দেবী হিসেবে পূজিতা হন, তাতে তাঁর একটি ছাত্র ও বিদ্যার্থীদের দেবী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। অনেকটা শিশু-কিশোর পাঠ্য বইয়ের মতো। যদিও হাল আমলে তাতে দেশি প্রেমদিবস বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র ছোঁয়া লেগেছে। দোল নয়, এই শ্রীপঞ্চমীই নাকি আমাদের আসল বসন্তোৎসব।

এই ভাবমূর্তির ফলে তিনি যে এক জন অতি গুরুত্বপূর্ণ তান্ত্রিক দেবী, সেই বিষয়টি প্রায় জনমানসের অন্তরালে চলে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রণাম মন্ত্রের মধ্যেই দেবীর তান্ত্রিক পরিচয় রয়েছে “ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।” মহাচীনাচার-এর সঙ্গে যুক্ত নীল সরস্বতীই ভদ্রকালী। সরস্বতীর নানা মূর্তি এবং তাদের প্রতিমাতত্ত্বের সন্ধানে শাস্ত্রের শরণাপন্ন হলে, বিদ্যাদেবী সংক্রান্ত নানা চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। হিন্দু তন্ত্রে তাঁর স্থান অষ্ট তারিণীদের মধ্যে।

“তারা চোগ্রা মহোগ্রা চ বজ্রকালী সরস্বতী/কামেশ্বরী চ চামুণ্ডা ইত্যষ্টো তারিণীগণাঃ।।” কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-এর বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে কালী, দুর্গা, লক্ষ্মীর সমান সংখ্যক ধ্যানমন্ত্র রয়েছে সরস্বতীর। কারণ সহজ: সাংখ্য দর্শনের মতোই জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে তন্ত্রে। প্রপঞ্চসার তন্ত্রে সরস্বতীকে ভারতী নামে সম্বোধন করে বলা হয়েছে তাঁর শক্তি— মেধা, প্রজ্ঞা, প্রভা, বিদ্যা, ধী, ধৃতি, স্মৃতি, বুদ্ধি ও বিদ্যা। তন্ত্রসারে দেবী বর্ণেশ্বরী বলে অভিহিত। বর্ণ মানে অক্ষর। তন্ত্রে অক্ষরের মূর্তি আছে। সরস্বতীর ছয় অঙ্গ বর্ণমালার সমস্ত বর্ণ। স্বরবর্ণের বৈষ্ণব মূর্তিদের মধ্যে সরস্বতী হলেন বিষ্ণু সঙ্কর্ষণের শক্তি। বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁর যোগ।

বর্ণেশ্বরীর ধ্যান অনুযায়ী, তাঁর ডান হাতে একটি তীক্ষ্ণ তরবারি থাকে। কিন্তু সরস্বতী তো যুদ্ধের দেবী নন! তাঁর হাতে তরবারি কেন? উত্তর খুঁজতে বৌদ্ধ তন্ত্রের পাতা ওল্টাতে হবে। সরস্বতী একমাত্র দেবী, যাকে বৌদ্ধ তন্ত্র আত্তীকরণ করেছে কোনও রকম নামের পরিবর্তন ছাড়াই। তাঁর হংসবাহন, পুস্তক বীণার লাঞ্ছন, মোটামুটি একই আছে। সাধনমালায় সরস্বতী পঞ্চবুদ্ধের অনুষঙ্গ ছাড়া স্বতন্ত্র দেবদেবীদের অন্তর্গত। তিব্বতি বৌদ্ধ গ্রন্থে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সরস্বতী হিন্দু এবং বৌদ্ধ দুই সম্প্রদায়ের পণ্ডিতদের উপাসিত। তাঁকে নিয়ে কোনও বিরোধ নেই। তিব্বতি ভাষায় সরস্বতীর নাম ‘ইয়েং চেনমা’, (ছবিতে) যার মানে হল সুমধুর কণ্ঠের দেবী। সাধনমালায় তাঁর পাঁচটি রূপকল্পনা পাই— মহাসরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী, বজ্রশারদা, আর্য সরস্বতী, এবং বজ্র সরস্বতী। মহাসরস্বতীর মূর্তি বিহারের নালন্দা এবং ওড়িশার রত্নগিরির প্রত্নক্ষেত্রে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বর্ণেশ্বরীর সঙ্গে মিল হচ্ছে বজ্র সরস্বতীর।

বজ্র সরস্বতীর তিনটি মাথা এবং গায়ের রং লাল। তাঁর হাতেও তরবারি। বর্ণেশ্বরী কিংবা বজ্র সরস্বতীর তরবারি অসুর দমন বা দানব দলনের জন্য নয়। এই তরবারির প্রতীকী অর্থ হল, অ-জ্ঞানের অন্ধকারকে ছিন্ন করা, অ-বিদ্যার কুয়াশাকে ভেদ করা। বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্ব অনুসারে জ্ঞানের দেবতা মঞ্জুশ্রীর অন্যতম লাঞ্ছন হল তরবারি, বিশেষ করে অরপচন মঞ্জুশ্রীর। অ-র-প-চ-ন হল বীজমন্ত্র। সুতরাং, জ্ঞান ও বর্ণের সংযোগ, তন্ত্র ও বীজমন্ত্রের সংযোগের উপর আবারও জোর দেওয়া হল।

নেপালের নেওয়ারি বৌদ্ধ আচারে মঞ্জুশ্রীর সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক খুবই নিবিড়। মঞ্জুশ্রীর মন্দিরে সরস্বতী পূজিতা, সরস্বতীই মঞ্জুশ্রীর শক্তি।

জৈন ভাস্কর্যে প্রচুর সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। জৈনরা কার্তিক মাসের শুক্ল পঞ্চমীতে সরস্বতীর পুজো করে, যাকে বলা হয় জ্ঞানপঞ্চমী। জৈন ধর্মীয় সাহিত্যে সরস্বতীর অভিধা: ‘শ্রুতদেবী’। ‘শ্রুতভক্তি’, ‘শ্রুতপূজে’, ‘শ্রুতসুন্দর ব্রত’, ‘শ্রুতজ্ঞান ব্রত’ ইত্যাদির উল্লেখ থেকে শ্রুতদেবীর গুরুত্ব সহজেই বোঝা যায়। জৈনধর্মে সরস্বতী হলেন ষোড়শ বিদ্যাদেবীর প্রধানা। তাঁকে দিয়ে পূজারম্ভ হয়।

দিল্লির জাতীয় সংগ্রহালয়ে রাজস্থানের বিকানের থেকে প্রাপ্ত মার্বেল পাথরের একটি অপূর্ব সুন্দর চতুর্ভুজা সরস্বতী মূর্তি সংরক্ষিত আছে। এর সূক্ষ্ম কারুকাজ মনোরম এবং বিস্ময়কর। মূর্তিটি ১২০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দের। এখানে তিনি চতুর্ভুজা এবং অক্ষমালা, পুস্তক যথাযথ লাঞ্ছন ধারিণী। কিন্তু জৈন সরস্বতীর একটি বিশেষত্ব হল তিনি ময়ূরবাহনা। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর পূজা-পার্বণ গ্রন্থে বলেছেন পুরাণে তন্ত্রে হংসবাহনা সরস্বতীর উল্লেখ অপেক্ষাকৃত কম। সরস্বতী বহু বার বাহন পরিবর্তন করেছেন। মেষ, সিংহ, ময়ূর ও হংস, এই চারটি প্রাণী সরস্বতীর বাহনরূপে কল্পিত হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস-এ লিখেছেন, “বাঙলা দেশের কোথাও কোথাও সরস্বতী পূজার দিনে এখনও ভেড়ার বলি ও ভেড়ার লড়াই সুপরিচিত।” নলিনীকান্ত ভট্টশালীও এই মত সমর্থন করেছেন।

দক্ষিণ ভারত ও মহারাষ্ট্রে ময়ূরবাহনা সরস্বতীর মূর্তি ও ছবি পাওয়া যায়। কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয়ে সিংহবাহনা বাগেশ্বরী মূর্তি আছে। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ বারাণসীর কাছে সরস্বতী মন্দিরে সিংহবাহনা বাগেশ্বরী সরস্বতী মূর্তির উল্লেখ করেছেন। এই চার বাহনের মধ্যে কে আগে কে পরে তা বলা মুশকিল। তবে বৈদিক সূত্র বলছে, সিংহ এবং মেষ সরস্বতীর আদি বাহন ছিল। পরবর্তী কালে সিংহ দুর্গার বাহন হল, কার্তিকেয় নিলেন ময়ূর। তাই ব্রহ্মার শক্তি হিসেবে সরস্বতীর ব্রহ্মার বাহন হাঁসকেই বেছে নিলেন। খিদিরপুরে হংসবাহনা মনসা বা সরস্বতীর মূর্তি আছে। একই মূর্তিতে দুই দেবী কৃষ্ণপক্ষে ও শুক্লপক্ষে আলাদা করে পূজিতা হন।

অতএব সরস্বতীকে কেবলমাত্র বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী ভাবলে সরলীকরণ করা হবে। তাঁর মধ্যে একটি জোরালো উর্বরতার অনুষঙ্গ রয়েছে। বৈদিক নদী, শ্রীপঞ্চমী তিথির ‘শ্রী’ অর্থাৎ লক্ষ্মীর ইঙ্গিত, পূজার উপাদানে পঞ্চ শস্য (ধান, যব, সাদা সর্ষে, মুগ ও মাষকলাই) উর্বরতার দেবীর পরিচয় বহন করে। সরস্বতী এক বহুস্তরীয় দেবী, যিনি যথার্থই বিচিত্ররূপিণী।

টেগোর ন্যাশনাল ফেলো, ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়াম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

goddess Saraswati
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE