Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Animal Movie

সময়ের বিষে স্নাত আখ্যান

কী আছে এই সিনেমায়? অ্যানিমাল অনেকটা যেন এক মারকাটারি ভিডিয়ো গেমের মতো, ভুল বা ঠিকের তোয়াক্কা না করে যে ছবি সিনেমাহলে বসে থাকা মানুষের মন ভুলিয়ে রেখেছে কয়েক ঘণ্টা।

ছবি: সংগৃহীত।

মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৭
Share: Save:

বছর শেষের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত চলচ্চিত্র একশো কোটি টাকা বাজেটে বানিয়ে প্রায় আটশো কোটির ব্যবসা ছুঁয়েছে। টিভি বা ওটিটি-তে মুক্তির ভরসায় বসে না থেকে জনতা হলমুখী হয়ে হাউসফুল করিয়েছে এই ছবিকে। ছবির গান ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে মিম হয়েছে ছবির বিভিন্ন মুহূর্ত। মানে, একেই সাধারণ ভাবে বলা হয়ে থাকে ব্লকবাস্টার হিট।

কী আছে এই সিনেমায়? অ্যানিমাল অনেকটা যেন এক মারকাটারি ভিডিয়ো গেমের মতো, ভুল বা ঠিকের তোয়াক্কা না করে যে ছবি সিনেমাহলে বসে থাকা মানুষের মন ভুলিয়ে রেখেছে কয়েক ঘণ্টা। একটি ছেলে কী ভাবে তার বাবার ভালবাসা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যায়— আক্ষরিক অর্থেই— ‘মরিয়া যাইতেও’ এই নায়ক দ্বিধাবোধ করেন নাই। এক মধ্যতিরিশের মানুষের, যার নিজের সংসার যথেষ্ট সুখের, তার এই ‘বাবা প্রেম’ খুব স্বাভাবিক নয়। সেই মানসিক টানাপড়েনের কাহিনি। আর সেই বেচারা বিষাক্ত মানুষটির চরিত্রে রণবীর কপূর।

সভ্যতার শুরু থেকে যত মহাকাব্য তার মূল কিন্তু বীরগাথা বা পৌরুষের উপাসনা। মানব থেকে মহামানবের উত্থানের রাস্তাটা জমি, নারী, পিতৃসত্য রক্ষার সিঁড়ি বেয়ে। সে নিরিখে সব মহাকাব্য যা পুরুষের রচনা, যত বীরগাথা যা পুরুষের ভাবনা— সবেরই মূলে আছে পুরুষতন্ত্রের বীজ। আর আজ— উত্তর-আধুনিক সমাজে পুরুষতন্ত্র যত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তত বেশি সে তার জায়গা করে নিচ্ছে বিনোদনে। বাস্তবে তার প্রয়োজন ফুরোলেও মনের মধ্যে তাই তার রেশ থেকেই যাচ্ছে, এমনকি বেড়ে যাচ্ছে। কয়েক দশক আগে যে পদ্ধতিতে পুরুষোত্তমের কাঠামো একটি মানুষকে আম আদমি থেকে পুরুষসিংহ বানাত, এখন তারই নাম ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’। পুরুষের চোখে পবিত্রতা আর তার প্রতিরক্ষা এখন আরও জরুরি এক ধারণা। সুরক্ষার নামে সেই পুরুষ নারীকে তার সম্পত্তি মনে করে তার চার পাশে টেনে দেয় লক্ষ্মণরেখা, তার কাছে ভালবাসার প্রকাশ করতে অপর পক্ষ নতজানু হয়ে বশ্যতা স্বীকার করবে অথচ যে নিজের বহুগামিতাকে বৃহত্তর স্বার্থ বলে বাঁধবে যুক্তির বেড়ায়, যে মনের কথা বলতে না পেরে নেশার আশ্রয় নিলেও মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে নারাজ, সহজ ভাষায় যে পুরুষ পৌরুষের বিষে বিষাক্ত!

আজকের সমাজে— নারী ক্রমশই আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর, নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন। এ দিকে সেই সমাজেই একটা ছেলেকে ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়েছে নারীকে সুরক্ষার নামে বশে রাখা তারই কাজ। সুতরাং সে যখন দেখছে কিছু নারী তার অনুমতি চায় না, সুরক্ষা চায় না, পুরুষটি তার জীবনদর্শন সুরক্ষিত করতে অন্য রকম মেয়েটিকে যেনতেনপ্রকারেণ অসুরক্ষিত বোঝাতে উঠে পড়ে লাগছে। বাস্তবে বাড়ি, অফিস, বাজার-হাটে আজ যে এত আগ্রাসন, অ্যানিম্যাল তারই প্রতিফলন।

শুধু অ্যানিম্যাল কেন, তিন-চার হাজার বছরের চেপে বসা ধারণাগুলো এখন জায়গার অভাবে জমিয়ে বসছে রুপোলি পর্দার আরও অনেক মাল্টিভার্স-এ। ২৫-৩০ বছর আগের স্পাইডারম্যান আর আজকের স্পাইডারম্যান অনেকটাই আলাদা। ২০০২-এর স্পাইডারম্যান দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করলেও তাকে প্রবল পুরুষ মনে হত না। কিন্তু মার্ভেল ইউনিভার্স-এর স্পাইডারম্যানকে বার বার তার বীরত্বের প্রমাণ দিতে হয়, দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয় তার পৌরুষের মানদণ্ডে। হাল আমলে ব্লকবাস্টার হিট হওয়া স্বদেশি বিদেশি— অনেক সিনেমাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে এই লিঙ্গবৈষম্য।

মুশকিল হল, আলোচ্য ছবির নির্মাতা যে-হেতু অর্জুন রেড্ডি বা কবীর সিংহ-খ্যাত পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গা, অনেকেই তাঁর নারীদ্বেষের আন্দাজ পেতে আর হলমুখো হননি। আর সেখানেই সমস্যা। লিঙ্গবৈষম্যের বিতর্কে হারিয়ে যাচ্ছে আরও বিষাক্ত এক জিনিস! এই সিনেমার পরতে পরতে অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে পরিচালক বুনে দিয়েছেন ইসলাম-বিদ্বেষ ও পুঁতে দিয়েছেন একনায়কতন্ত্রের জয়পতাকা।

ছবির খলনায়ক এক ধর্মান্তরিত মুসলমান। অন্য দিকে সাদাকালো স্টেজে উঠে বক্তৃতা দিচ্ছেন রণবিজয় রূপী রণবীর, পিছনে স্বস্তিক চিহ্ন। চার পাশে কর্মচারীদের সোজা করে ধরে থাকা মুষ্টিবদ্ধ হাতে বিজয়োল্লাস দেখে এক জনের কথাই মনে পড়ে যায়— অ্যাডল্‌ফ হিটলার। হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈনকে এক করতে পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গা অনায়াসে সরিয়ে দিয়েছেন মুসলমান আর খ্রিস্টানকে। আর সেই সনাতন আস্ফালনের বিজয়গাথায় তাঁর লক্ষ্য পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাত, মরাঠা।

বলিউডের দিকে যখন উঠছে নেপোটিজ়মের, স্বজনপোষণের অভিযোগ— সেই সময় বলিউডি বলয়ের বাইরে তেলুগু পরিচালকের পর পর দু’টি হিন্দি ছবি সুপারহিট। আরও তিনটি বড় মাপের হিন্দি ছবির কথা ভাবছেন পরিচালক। সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন তাঁর ছবি বিতর্কিত, তাই সে ছবি এড়িয়ে চলা উচিত। প্রশ্ন এখানেই। এমন ছবিকে এড়িয়ে চলে লাভ বেশি, না ক্ষতি? ‘মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত’ নায়ক এবং মৌলবাদী রাজনৈতিক বিশ্বাস— এই সব কিছুকে এক সুরে গেঁথে পরিচালক বলিউডে নিজের খুঁটি পুঁতছেন কী ভাবে, তা কি আমাদের আরও ভাল করে জানা বোঝা দরকার নয়?

সংস্কৃতির রাজনীতিই এঁদের হাতিয়ার। সেই রাজনীতিকে চিনতে হবে না আরও খুঁটিয়ে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bollywood Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE