E-Paper

বিশ্বসাহিত্যের মুকুটমণি

জার্মান রোম্যান্টিকরা শকুন্তলায় খুঁজে পান ভারতীয় সভ্যতার নির্যাস। ১৯০৩ সালে স্টেজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় শকুন্তলা অভিনয়ের একটি দীর্ঘ সমালোচনা-মূলক নিবন্ধ মেলে।

মল্লারিকা সিংহ রায়

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৪০
Shakuntala

আশ্রমকন্যা: রাজা রবি বর্মার আঁকা দুষ্মন্তের চিন্তাচ্ছন্ন শকুন্তলার ছবি। উইকিমিডিয়া কমন্স।

কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ জার্মান ভাষায় প্রথম অনূদিত হয় ১৭৯১ সালে। ইয়রগ ফরস্টার-কৃত সেই অনুবাদটি পড়ে মহাকবি গোয়টে বলেছিলেন যে বিশ্বের সমস্ত সাহিত্যসম্ভার, যা মানুষের সত্তাকে আচ্ছন্ন, আবিষ্ট এবং পূর্ণ করে তুলতে পারে, তার মুকুটমণি হচ্ছে শকুন্তলা। ইউরোপে কতখানি সমাদৃত এবং জনপ্রিয় হয়েছিল শকুন্তলার কাহিনি, এই মন্তব্যই তা প্রমাণ করে। উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় বসে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন শকুন্তলা (১৭৯০)। রোমিলা থাপর তাঁর শকুন্তলা: টেক্সটস, রিডিংস, হিস্ট্রিজ় গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে ফরাসি, জার্মান, রুশ, ইটালিয়ান থেকে শুরু করে আইসল্যান্ডিক ভাষায় পর্যন্ত শকুন্তলা অনুবাদ হয়ে যায় ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকেই। এমন কোনও ইউরোপিয়ান ভাষা ছিল না যাতে সেই কাব্য অনূদিত হয়নি।

জার্মান রোম্যান্টিকরা শকুন্তলায় খুঁজে পান ভারতীয় সভ্যতার নির্যাস। ১৯০৩ সালে স্টেজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় শকুন্তলা অভিনয়ের একটি দীর্ঘ সমালোচনা-মূলক নিবন্ধ মেলে। সেখানে লেখক হাইনরিখ স্তুমকে লিখছেন যে, ফরস্টারের অনুবাদের পর থেকে এমন কোনও দশক বোধ হয় যায়নি, যখন কোনও না কোনও জার্মান পণ্ডিত শকুন্তলার অনুবাদ করতে চাননি। শকুন্তলার মতো জনপ্রিয়তা জার্মানির থিয়েটারে অন্য কোনও বিদেশি নাটক পায়নি, তা-ও উল্লেখ করেছেন তিনি। দি ওরিয়েন্টাল রেনেসাঁস (১৯৫০) বইয়ের লেখক রেমন্ড শোয়াব লিখেছেন যে ইউরোপের সাহিত্যচর্চার এই সময়কালকে বলা যেতে পারে ‘শকুন্তলা যুগ’।

আজকের ভারতে যখন ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নানা ভাবে পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা চলছে, প্রাচীন যুগের সংস্কৃতি নিয়ে একটা দক্ষিণপন্থী মাতামাতি চলছে, তখন দু’শো বছর আগে ইউরোপে শকুন্তলার প্রবল জনপ্রিয়তার কারণ নিয়ে আলোচনা জরুরি। কী ভাবে পঞ্চম শতকে লেখা একটি সংস্কৃত কাব্য ইউরোপীয় সাহিত্য আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এল, এবং কেনই বা প্রায় পরবর্তী দেড়শো বছর ধরে, অর্থাৎ বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সেটি সাহিত্য এবং নাট্যাভিনয়ের জগতে ধারাবাহিক ভাবে জনপ্রিয় হয়ে থাকল, তার ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে ইউরোপে ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণের ইতিহাসে নজর দিতে হবে।

প্রথম ব্যাখ্যা হতে পারে ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে ‘ওরিয়েন্টালিজ়ম’ বা প্রাচ্যবিদ্যা নিয়ে চর্চার প্রসার। ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদরা বলেছিলেন যে আধুনিক যন্ত্র-নির্ভর সভ্যতার বিকাশের পথে চলতে গিয়ে তাঁরা হারিয়েছেন প্রকৃতি থেকে আহরিত, আত্ম-অনুসন্ধান থেকে লব্ধ জ্ঞান, যা কেবল প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার মাধ্যমেই ফিরে পাওয়া সম্ভব। শকুন্তলা তাই অধিকাংশ অনুবাদে, বিশেষ করে জার্মান পণ্ডিতদের অনুবাদে হয়ে ওঠে ‘চাইল্ড অব নেচার’— প্রকৃতির কন্যা। ঋষি কণ্বের তপোবন হয়ে ওঠে আদর্শ অনাড়ম্বর গ্রামীণ জীবন, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে জ্ঞানচর্চায় মগ্ন, যেখানে আশ্রমকন্যা শকুন্তলা তাঁর প্রিয়সখী অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার সঙ্গে বনের গাছের ফুল তোলেন, হরিণ-ময়ূরের সঙ্গে খেলা করেন আর প্রশান্তমনে গৃহকর্ম করেন। এই অনুবাদগুলিতে রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার পূর্বরাগ, গান্ধর্ববিবাহ, রাজার দিয়ে যাওয়া ‘অভিজ্ঞান’ সেই আংটি পরিণত হয়েছে একটি প্রতীকী কাহিনিতে, যার উপজীব্য প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরিচয়ের সঙ্কট, এবং সব শেষে অভিজ্ঞান ফিরে পেয়ে সঙ্কটের মোচন। একটি অজানা, প্রাচীন সভ্যতার সুষমা-মণ্ডিত কল্পকাহিনির প্রেক্ষাপটে এই বক্তব্যের উপস্থাপনা করা হয় ইউরোপে।

শকুন্তলার অভিনয়গুলি ছিল ইউরোপের মাটিতে প্রাচ্যের একটি কাব্যের সামূহিক উদ্‌যাপন— সাহেব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রাচ্যরীতিতে সজ্জিত করে, দৃশ্যপটে শ্যামলিমা এবং রাজকীয় ঐশ্বর্যের আভাস এনে, আলোর এবং শব্দের কারুকাজে সাজানো হত এই নাট্য প্রযোজনাগুলি। এগুলি দর্শকদের কাছে এক অনাস্বাদিত কাব্য এবং নাট্যরসের আস্বাদ এনে দিত।

এ কথাগুলো মনে পড়লে গর্বে আমাদের মাথা উঁচু হতে পারে বটে, কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য একটু গভীর ভাবে অধ্যয়ন করলে কিছু সংশয়ও দেখা দেয়। শকুন্তলার প্রথম অনুবাদ যখন হয়, তখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন চলছে। পণ্ডিত জোন্স একাধারে বহু প্রাচ্যভাষা বিশারদ এবং ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী। তিনি কোম্পানির শাসন সুদৃঢ় করার জন্যেই ভারতীয় শাস্ত্র অর্থাৎ সামাজিক জীবনের তথ্যভান্ডার, এবং ফারসি ভাষার আইনের গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন। এই কাজে ব্যাপৃত থাকার সময় তিনি ‘নাটক’ সম্পর্কে জানতে পারেন। জোন্স প্রথমে ভেবেছিলেন ‘নাটক’ হচ্ছে ভারতীয় ইতিহাস। তাঁর মুনশি রাধাকান্ত তাঁর ভ্রম সংশোধন করে বলেন শীতকালে সাহেবরা যে ‘প্লে’ করেন, কলকাতায় তাই হচ্ছে নাটক। জোন্সকে কালিদাসের শকুন্তলা পড়তে দিয়ে রাধাকান্ত বলেন যে, সেটি হচ্ছে ভারতীয় নাটকের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। জোন্স পড়ার পর তা অনুবাদ না করে থাকতে পারেননি। তবে মুখবন্ধে বলেছিলেন যে, এটিই তাঁর একমাত্র নাটক অনুবাদ। কারণ শাসনের সুবিধার জন্য আইন অনুবাদ করার কাজ থেকে তিনি ছুটি নিতে পারবেন না।

জোন্সের অনুবাদ থেকে শুরু করে পরবর্তী অন্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদগুলিতে আর একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সংস্কৃত কাব্যে নারীদেহের রূপের বর্ণনায়, বিশেষত শকুন্তলার রূপের বর্ণনায় যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, অনুবাদকদের মনে হয়েছিল তা বড় বেশি যৌনতা-উত্তেজক, ভদ্র ইউরোপীয় পাঠকের কাছে পরিবেশন-যোগ্য নয়। সেই অংশগুলি তাঁরা তাই নিজেদের মতো করে ‘সংশোধন’ করে নেন। কিছু আলোচনায় এ-ও পাওয়া যায় যে অনুবাদকেরা নিজেরাই কিছুটা বিস্মিত আর দ্বিধাগ্রস্ত যে, এক সরল প্রকৃতি-কন্যার রূপ বর্ণনায় এত যৌনতামূলক অলঙ্কারের আধিক্য কেন? ঊনবিংশ শতকের রক্ষণশীল ‘ভদ্র’ ইউরোপ শেষে রায় দেয় যে, যতই প্রাচীন এবং মনোমুগ্ধকর কাব্য হোক না কেন, আদতে তো সেটি প্রাচ্যের, আর তাই সেখানে কিছু ‘নিম্নরুচি’ অর্থাৎ যৌনতার উদ্‌যাপন থেকে গেছে। প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার সঙ্গে তাই সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ শাসনের ইতিহাস এবং শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। কালিদাসের শকুন্তলার ইউরোপে প্রথম ‘বেস্ট সেলার’ হয়ে ওঠার মধ্যেও তাই ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা যায় না।

তা হলে কি রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষ্যপ্রমাণই সাহিত্যের ইতিহাসের গতির নির্ধারক বলে মেনে নিতে হবে? বিশ্ব-সাহিত্য নিয়ে নতুন গবেষণা কিছুটা অন্য ভাবে চিন্তার দিক খুলে দিচ্ছে। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসকে স্বীকার করে নিয়েও এ কথা নতুন করে ভাবা সম্ভব যে, মহাকবি গোয়টের উচ্ছ্বাস কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের ফল নয়। বরং বলা যেতে পারে অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশের সাহিত্য নিয়ে যে আলোড়ন ইউরোপে শুরু হয়, কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ যার অন্যতম নিদর্শন, তার থেকে সাহিত্যের বিশ্ব নিয়ে অন্য রকম ভাবনাচিন্তা শুরু হয়, চিন্তার আদান-প্রদানের নতুন মাধ্যম নির্মাণ করা হয়। যা ভৌগোলিক বিচারে সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণের বাইরে গিয়ে, এক গতিময়, সহনশীল চিন্তার এবং অনুভবের বিশ্বকে সম্ভব করে তোলে। এই সাহিত্যের বিশ্বে ‘বিদেশি’ হলেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয় না, বরং তার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই তার মর্ম উপলব্ধি করার প্রয়াস পায়। ‘শকুন্তলা যুগ’ তাই প্রাচ্যবিদ্যায় সীমিত থাকে না। সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যার বাইরে গিয়ে এটি হয়ে ওঠে বিশ্ব-সাহিত্যকে কল্পনা করার প্রথম সূচক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kalidasa Indian Literature

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy