Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
রাজা নন, প্রজারাই স্থির করবেন কিসে তাঁদের ভাল: বিবেকানন্দ
Swami Vivekananda

অবতারের সন্ধানে

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নরহরি কবিরাজের প্রবন্ধ সঙ্কলন। এই সঙ্কলনে বিবেকানন্দকে নিয়ে তাঁর দু’টি ছোট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে।

Swami Vivekananda

স্বামী বিবেকানন্দ । —ফাইল চিত্র।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩২
Share: Save:

আজকাল খেয়াল করে দেখেছি জনগণকে রাজনৈতিক নেতাবিশেষের নামে ‘গ্যারান্টি’ দেওয়া হয়। ‘নেতা’ শব্দটি এখানে লিঙ্গনিরপেক্ষ। ব্যুৎপত্তিগত দিক দিয়ে বিচার করলে যিনি নিয়ে যান, নীত করেন, এক অর্থে তিনিই নায়ক, তিনিই নেতা। চার পাশের গ্যারান্টি-ঘোষিত সরকার-পোষিত বিজ্ঞাপনের ভাবখানা হল এই, ছবির রাজনৈতিক নেতাই এ কালের অবতার। এ সব দেখে সংশয়ী পাপী মনে একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে। নেতার কথা থাক, ‘রামজি কা নাম পে গ্যারান্টি’ বা ‘রাজা রামচন্দ্রের নামে গ্যারান্টি’ দিলেও কি স্বামী বিবেকানন্দ, যাঁকে নিয়ে আজকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শপুরুষ বলে টানাটানি করেই চলেছে, এ সব মেনে নিতেন?

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নরহরি কবিরাজের প্রবন্ধ সঙ্কলন। এই সঙ্কলনে বিবেকানন্দকে নিয়ে তাঁর দু’টি ছোট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে। এর মধ্যে ‘বিবেকানন্দের মত ও পথ’ প্রবন্ধটি ১৯৪৮ সালে পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। দু’টুকরো দেশে ধর্মের নামে দাঙ্গার স্মৃতি ও বাস্তব ঘায়ের মতো দগদগ করছে। বিবেকানন্দের সহোদর, বস্তুনিষ্ঠ মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তখনও বেঁচে। ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর দাদা বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা ইংরেজি ও বাংলা গ্রন্থে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, বিশেষ দেশকালের সূত্রেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবেকানন্দ হয়ে উঠেছিলেন। মানবতাবাদী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ব্রাহ্মণ্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পক্ষে বহু বার কথা বলেছিলেন। ১৯০২ সালে প্রয়াত বিবেকানন্দ পরবর্তী দেশ-কাল-সমাজের অনেক কিছুই দেখে যাননি, এ কথা সত্য। তবে যা দেখেছিলেন ও যা বলেছিলেন তার সূত্রে কায়েমি ব্রাহ্মণ্য ধর্মধ্বজীদের পক্ষে হিন্দুত্ববাদের ‘অবতার’ হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করা অন্যায়। নরহরি কবিরাজ তাঁর প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “আসল কথা, গণতান্ত্রিক জীবনধর্মের প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ, প্রজাশক্তির ওপর বিশ্বাস ও স্বেচ্ছাতন্ত্রের প্রতি বৈরাগ্য বিবেকানন্দের মনে এক বিরাট আসন জুড়ে বসেছিল।” নিজের মনের আসনে গণতন্ত্র ও প্রজাশক্তির উপর বিশ্বাস আর স্বেচ্ছাতন্ত্রের প্রতি বৈরাগ্য প্রতিষ্ঠিত বলেই বিবেকানন্দ কোনও ‘নেতার নামে গ্যারান্টি’ তো দূরস্থান, ‘রামজির নামে গ্যারান্টি’-তে বিশ্বাসী হতে পারেন না। সে দিক থেকে রামতন্ত্রের রাজনৈতিক ছাপ্পার তিনি বিরোধিতাই করতেন। এ সিদ্ধান্ত ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বা নরহরি কবিরাজের লেখার সূত্র থেকে না-করে একেবারে বিবেকানন্দ নিজের হাতে যা লিখে গিয়েছিলেন, ‘পাকাপাকি’ ভাবে সেখান থেকেই করা সম্ভব।

বিবেকানন্দের নামে যে কোনও কথা চালিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আজকাল চোখে পড়ছে। তাঁর লেখার অংশবিশেষকে খণ্ডবিখণ্ড করে বাণী হিসাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার প্রয়োজন থেকেই এই তরল প্রবণতার জন্ম। বিবেকানন্দ যে রামের গ্যারান্টিতে বিশ্বাসী নন, এ কথাটা সে রকম কোনও খণ্ড বাণীর সাহায্যে কৌশলে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেই হবে না। কারণ, সত্য-সত্যই বিবেকানন্দ এ কথা লিখেছিলেন দীর্ঘ বিস্তারে। যে লেখায় সেই বিশ্লেষণ রয়েছে সেই ‘বর্ত্তমান ভারত’ নামের তাঁর বাংলা রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল উদ্বোধন পত্রে, ১৫ চৈত্র ১৩০৫ থেকে ১৫ বৈশাখ ১৩০৭ সংখ্যায়। লেখাটিতে প্রজাশক্তির সঙ্গে রাজক্ষমতার সহযোগ ও বিচ্ছেদের আলোচনা রয়েছে।

এই লেখাতেই বিবেকানন্দ রাম, যুধিষ্ঠির, ধর্মাশোক ও আকবর এই চার জন শাসককে ভাল ভারতীয় রাজা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। অশোক ও আকবর ইতিহাসের চরিত্র, রাম ও যুধিষ্ঠির মহাকাব্যের। ইতিহাসের পাশাপাশি মহাকাব্যের শাসকদের বিবেকানন্দ এ কারণেই পাশাপাশি রাখছেন কারণ ভারতীয় জনমানসে তাঁরা সকলেই সুশাসক হিসাবে স্বীকৃত। ‘জনমানস’ বিবেকানন্দের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নথিখানা। তাই মহাকাব্য আর ইতিহাস দুই-ই পাশাপাশি রাখা হল। লক্ষ করতে হবে, মোগল শাসক আকবরকেও তিনি ভারতীয় বলেই মনে করেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদদের কৌশলে যে বিভাজন হিন্দু-যুগ, মুসলমান-যুগ ইংরেজ-যুগের জন্ম দিয়েছিল এবং যে বিভাজন থেকেই মুসলমান শাসকদের বহিরাগত ও অভারতীয় বলে চিহ্নিত করার পরবর্তী অতীত-বর্তমান প্রয়াস প্রচলিত, বিবেকানন্দ সে দলের নন। নন বলেই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ঐস্লামিক দেহের কল্পনা করেন। সে কল্পনায় মস্তিষ্ক শরীরের উপরে ‘রাজ’ করছে এ কথা না ভেবে অন্য কথাও বলা চলে। ইংরেজরা ‘মেয়েলি হিন্দু’ বলে ভারতীয়দের দাগিয়ে দিচ্ছিল বলেই বিবেকানন্দ তার উত্তরে ইসলামের ভারতীয় শরীরকে গুরুত্ব দিলেন। এ-ও মনে রাখতে হবে শাহজাদা দারাশুকো উপনিষদের অনুবাদক— বেদান্তনিষ্ঠ ছিলেন।

বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্ত্তমান ভারত’ রচনায় রামকে সুশাসক বলেই স্বীকার করছেন, কিন্তু রাম ও রাম অবতারকেন্দ্রিক রামরাজ্যের প্রতি তাঁর আদর্শগত সমর্থন নেই। শুধু রাম কেন, যুধিষ্ঠির, ধর্মাশোক, আকবরও সুশাসক হিসাবে যদি অবতারকল্প হয়ে ওঠেন, তা হলেও বিবেকানন্দ সেই অবতাররাজ্যকে সমর্থন করেন না। কেন? মূল কারণ হল এই: বিবেকানন্দ মনে করেন রাজ্যের ভালমন্দ সিদ্ধান্তে প্রজাসাধারণের মতামতের গুরুত্ব প্রবল। প্রজারা তাঁদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্বন্ধে সচেতন হবেন। এই সচেতনতার অন্তরায় অবতারকল্প রাজার প্রতিষ্ঠা ও তার উপরে নির্দ্বিধ বিশ্বাস। তিনি লিখেছেন, “পরে যাহার মুখে সর্ব্বদা অন্ন তুলিয়া দেয়, তাহার ক্রমে নিজের অন্ন উঠাইয়া খাইবার শক্তি লোপ হয়।... সর্ব্বদাই শিশুর ন্যায় পালিত হইলে অতি বলিষ্ঠ যুবাও দীর্ঘকায় শিশু হইয়া যায়। দেবতুল্য রাজা দ্বারা সর্ব্বতোভাবে পালিত প্রজাও কখনও স্বায়ত্তশাসন শিখে না।” বিবেকানন্দের এই পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ‘পরনির্ভরতা’ যে সর্বার্থেই ক্ষতিকর, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দ যখন তাঁর ‘বর্ত্তমান ভারত’ রচনায় এ কথা লিখছেন তখন এই চিন্তায় সমসাময়িক অনেকেই আন্দোলিত। পাশ্চাত্যে ‘পাবলিক’ যে ভাবে নিজের অধিকার-সচেতন হয়ে উঠেছেন, এ দেশে জনগণের সেই সচেতনতা চোখে পড়ে না। এই সচেতনতার অভাবেই এর কিছু দিন পরে ভারতীয়দের ‘হোমরুল’-এর দাবি ইংরেজ শাসকেরা ক্রমাগতই অস্বীকার করবেন। ইংরেজ অপশাসনের বিরুদ্ধে অতীত ভারতের ‘রামরাজ্য’ ‘আকবররাজ্য’ বিবেকানন্দের কাছে গ্রহণযোগ্য তুলনায় ভাল বলে, কিন্তু সেটাই তাঁর ‘আদর্শ’ নয়। তাঁর আদর্শ প্রজাশক্তির বিকাশ।

বিবেকানন্দ লিখেছেন, “প্রজারা রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষেক প্রার্থনা করিতেছে, সীতার বনবাসের জন্য গোপনে মন্ত্রণা করিতেছে... তাহাদের সমবায়ের উদ্যোগ বা ইচ্ছাও নাই, সে কৌশলেরও সম্পূর্ণ অভাব, যাহা দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিপুঞ্জ একীভূত হইয়া প্রচণ্ড বল সংগ্রহ করে।” প্রজারা প্রচণ্ড বল সংগ্রহ করলে কী করবে? বিবেকানন্দের স্পষ্ট উত্তর ‘প্রজাবর্গের সাধারণ মঙ্গলকর সাধনোদ্দেশে সহমতি’ ও ‘রাজগৃহীত প্রজার ধনে সাধারণ স্বত্ববুদ্ধি ও তাহার আয় ব্যয় নিয়মনের শক্তিলাভেচ্ছা’। এই দুই পরস্পরসাপেক্ষ। প্রজাশক্তি ক্ষমতাসম্পন্ন হলে তাঁরাই স্থির করবেন সাধারণ ভাবে কোন কোন কাজ হলে তাঁদের হিত বা মঙ্গল (ওয়েলফেয়ার)— সে কাজই রাজ্যে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রজার যে ধন রাজা ব্যবহার করেন, সেই সম্পদ কোন ক্ষেত্রে কতটা ব্যবহার করা হবে, প্রজাশক্তি তা স্থির করার অধিকারী হবেন। অর্থাৎ, মন্দির তৈরির জন্য অর্থ ব্যয় করা হবে না বনিয়াদি শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করা হবে, তা নিয়ন্ত্রণের সচেতন অধিকার প্রজার আদর্শ রাজ্যে থাকা উচিত। তবে সে জন্য প্রজাদের তৈরি হতে হবে, গড়ে উঠতে হবে। তা না হলে প্রজার কী হলে ভাল তা স্থির করা যাবে না। সেই গড়ে ওঠার অবকাশ কিন্তু অবতারকল্প রামের রাজ্যে নেই।

বিবেকানন্দের সময় অতীত হয়েছে। তবে যে ভাবনা তাঁর লেখায় রয়েছে তার গুরুত্ব কমেনি। ‘রামের নামে গ্যারান্টি’ দেওয়া রাজনীতি প্রজাশক্তিকে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দেয় না। এখনকার রাজনৈতিক নেতারা তা দিতে চান না। নাগরিক নিজের অধিকার দাবি করবেন, তারই জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ করে নাগরিকদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার রাজনীতি এখন কে আর করেন? যা চোখে পড়ে তা হল জনতোষী রাজনীতি— নানা ভাবে জনগণকে ‘ছুটকো-ছাটকা’ সুবিধা পাইয়ে দিয়ে কোনও এক জন অবতারকল্প সর্বাত্মক নেতার করকমলের ভয়ঙ্কর আশীর্বাদের ছবি সর্বত্র। আশীর্বাদী হাত সুযোগ পেলেই মুষ্টিবদ্ধ স্বেচ্ছাচারী স্বৈরতান্ত্রিকের হাত হয়ে উঠতে পারে। বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, জনসাধারণ “রাজমুখাপেক্ষী হইয়া ক্রমে নির্ব্বীর্য্য ও নিঃশক্তি হইয়া যায়। ঐ পালিত রক্ষিতই দীর্ঘস্থায়ী হইলে সর্ব্বনাশের মূল।” রামরাজ্যের সর্বনাশের মুখোমুখিই কি দাঁড়িয়ে আছে আজকের ভারত?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda Society Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE