আবেগ যা-ই বলুক না কেন, এই বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গে ১৯৮৩-র বিশেষ মিল নেই। দুটোই প্রথম বিশ্বকাপ জয়, কিন্তু দুটো এক রকম ঘটনা নয়। সে বার ভারত ছিল আন্ডারডগ। মাঠে হোক বা মাঠের বাইরে, ভারতীয় দলের লড়াই ছিল বহুমুখী। ভারত জেতায় হকচকিয়ে গিয়েছিল অনেকেই। ২০২৫-এর গল্প সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্বকাপের দু’সপ্তাহ আগে মুল্লানপুরে অস্ট্রেলিয়াকে ১০২ রানে হারায় ভারত। তার তিন দিন পর দিল্লিতে ৪১৩ তাড়া করে তোলে ৩৬৯। চলতি দশকে অস্ট্রেলিয়ার কার্যত অপরাজেয় পারফর্ম্যান্সের কথা মাথায় রেখেও বলছি, দেশের মাঠে অন্যতম ফেভারিট দল ছিল ভারত। ফলে, যাঁরা খেলাটার খোঁজখবর রাখেন, ভারত জেতার পর তাঁরা খুশি হলেও তেমন অবাক হননি।
১৯৮৩-র সঙ্গে ২০২৫-এর পার্থক্য এখানেই শেষ নয়। ৪২ বছর আগে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। সে যুগে বিশ বছর ধরে ক্রিকেট মাঠে রাজত্ব করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। মাঠের বাইরে খেলার রাশ কিন্তু ছিল এমসিসি-র হাতে। ক্রিকেটের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হত লর্ডস-এ বসে। ছবিটা বদলাতে শুরু করে ১৯৮৭ আর ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপ এশিয়ায় হওয়ার পরে। বোর্ডরুমে ইংল্যান্ডের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে এনে এশীয় শিবিরের আধিপত্য শুরু করে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা। কোটি কোটি দর্শকের দেশ ভারত, নতুন উদারপন্থী অর্থনীতি, টাকার দৌড়ে অচিরেই বাকিদের টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলল বিসিসিআই। নতুন সহস্রাব্দে ছবিটা আরও বদলাল; আইপিএল আসার পর তো আর কথাই নেই! প্রতিটা বোর্ড এখন জানে যে, ভারতকে ঘাঁটানো যায় না। নিজেদের প্রমাণ করার দায় ১৯৮৩-র ছিল, ২০২৫ তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা এ দেশে বরাবর ছিল। ১৯৮৩-র আগে, ১৯৭১-এর জোড়া সিরিজ়েরও আগে, হকির স্বর্ণযুগেও। কিন্তু ১৯৮৩-র পর এক অভূতপূর্ব জোয়ার আসে। নব্বইয়ের তারকারা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন ১৯৮৩-র প্রভাবের কথা। ২০২৫-এর ক্রিকেটারদের লড়াই অন্য রকম। এ লড়াই ভারতের সঙ্গে গোটা বিশ্বের নয়। এ যুদ্ধ অনেক পুরনো, হাজার হাজার বছর আগেকার। দেশে, বিদেশে সর্বত্র এই যুদ্ধ চলেছে; ভবিষ্যতেও চলবে— মেয়েদের সমান অধিকারের লড়াই।
১৯৮৪-তে অস্ট্রেলিয়ার মহিলা দল তিনটে টেস্ট খেলতে আসে এ দেশে। ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট তখনও বিসিসিআই-এর হাতে আসেনি, উইমেন’স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (ডব্লিউসিএআই)-র যুগ তখন। খেলার জন্য এক পয়সাও না পেয়ে প্রতিবাদে কালো আর্মব্যান্ড পরে টেস্ট খেলতে নামেন ডায়ানা এডুলজি, শান্তা রঙ্গস্বামীরা। করার বিশেষ কিছু ছিল না যদিও— টাকার অভাবে ১৯৮৮-র বিশ্বকাপে দলই পাঠাতে পারেনি ডব্লিউসিএআই।
মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা কি তবে কম ছিল তখন? ওই ১৯৮৪-র অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ে দিল্লির প্রথম টেস্টে গড়ে ছ’হাজার মানুষ দেখতে যান প্রতি দিন। এক অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার জানান, সে দেশে পঞ্চাশ জন দেখতে এলেও তা ভাগ্যের ব্যাপার। ১৯৭৫-এ খেলতে এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-পঁচিশ মেয়েদের দল। বেঙ্গালুরুতে প্রথম খেলা দেখতে আসেন পঁচিশ হাজার মানুষ। জালন্ধরে খেলা শুরুর আগেই অস্ট্রেলীয়দের দেখতে বিশ হাজার মানুষের ভিড় জমে। ভিড় উপচে পড়েছিল ইডেনেও— মাঠেই সন্তানের জন্ম দেন খেলা দেখতে আসা এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা।
কিন্তু, উন্মাদনা থাকলেও তাকে রোজগারে পরিণত করতে পারেনি ডব্লিউসিএআই। মেয়েদের ক্রিকেটে না ছিল রোজগার, না সুযোগসুবিধা। নিরাপত্তার খাতিরে ১৯৯৭-এর বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল গুয়াহাটি থেকে সরাতে হয় দিল্লির হরবক্স স্টেডিয়ামে। ভারতীয় সেনার নিজস্ব মাঠ, অতএব দর্শক ঢোকার প্রশ্নই নেই। নেই গ্রাউন্ড স্টাফও। ডানহাতি-বাঁহাতি এক সঙ্গে ব্যাট করলে সাইটস্ক্রিন সরাতে দৌড়তে হয় ফিল্ডারদেরই। এ-হেন সেমিফাইনালের পর ফাইনালে অবশ্য হাজার হাজার দর্শক এনে ইডেন ভরিয়ে দেন তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী। কিন্তু, সমস্যা দেখা দেয় অন্যত্র। রবিবারে ভারত-শ্রীলঙ্কা পুরুষদের ওয়ান ডে থাকায় দূরদর্শন জানায় যে, তারা ফাইনাল দেখাতে পারবে না। বিশ্বকাপ ফাইনাল তাই হয় সোমবার।
কেমন ছিল তখন মহিলা ক্রিকেটারদের জীবন? খেলে টাকা জুটত নামমাত্র, কখনও তা-ও না। ১৯৯৭ আর ২০০০-এ সেমিফাইনালের পর ২০০৫-এর বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠে ভারত। ম্যাচপিছু মাত্র ১০০০ টাকা পেয়েছিলেন অঞ্জুম চোপড়া, মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী, নীতু ডেভিডরা। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে হলে যেতে হত অসংরক্ষিত কামরায় চেপে। বিদেশে খেলতে গেলে স্থানীয় ভারতীয়দের বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকতে হত।
এরই মধ্যে দেবদূতের মতো দেখা দিয়েছিল ভারতীয় রেল আর এয়ার ইন্ডিয়া। ভাল ক্রিকেট খেললে চাকরি পাওয়া যেত দু’জায়গাতেই। এক বার চাকরি পেয়ে গেলে নিশ্চিন্ত— শুধু বাঁধা মাইনে নয়, খেলতে গিয়ে চোট-আঘাত পেলে ছুটিও জুটত। মেয়েরা ক্রিকেট খেলে শুনলে তখনও কেউ কেউ নাক সিঁটকাত ঠিকই, কিন্তু সরকারি চাকরির কথা শুনলে আস্তে আস্তে মেনে নিতে শুরুও করেছিল।
২০০৬-এ দেশে মহিলাদের ক্রিকেটের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে বিসিসিআই। আর্থিক পরিস্থিতির কিছুটা হলেও সুরাহা হয়। যাতায়াত, হোটেল, ট্রেনিং, সব কিছুর মান উন্নত হলেও পুরুষদের সঙ্গে ব্যবধান থেকেই যায়। আর হবে না-ই বা কেন? ক্রিকেট বোর্ডের হর্তাকর্তা-বিধাতারা মোটামুটি সবাই পুরুষ। এত দিন মহিলা ক্রিকেটারদের ভাগ্য নির্ধারণ করে এসেছেন পুরুষ প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিরাই। ২০১১ সালে বিসিসিআইয়ের নতুন প্রেসিডেন্ট হয়ে এলেন এন শ্রীনিবাসন। ডায়ানা এডুলজিকে জানিয়ে দিলেন, তিনি মনে করেন না যে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার দরকার আছে। বোর্ডের টাকার অভাব বিন্দুমাত্র না থাকলেও শ্রীনিবাসন বুঝিয়ে দিলেন যে, বোর্ডের এই বিমাতৃসুলভ আচরণ চলবে। আর ২০১৩-র বিশ্বকাপ ফাইনাল তাই হয় ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে, দেড় বছর আগের ধোনির ছক্কা-খ্যাত ওয়াংখেড়েতে নয়— সেখানে যে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ হওয়ার কথা! ফাইনালের দিন বদলের ১৬ বছর পরে ফাইনালের মাঠ বদলাতে বাধ্য হল বিশ্বকাপ কমিটি।
চাকা ঘোরা শুরু ২০১৫ সালে। মহিলারা প্রথম কেন্দ্রীয় চুক্তি পান সে বছরই। গ্রেড এ-তে মেয়েদের রোজগার ধার্য হল বছরে ১৫ লক্ষ টাকা (গ্রেড সি-র পুরুষ ক্রিকেটাররা অবশ্য পেতেন ২৫ লাখ)। অচিরেই বিদেশি লিগে খেলার অনুমতিও পেলেন মহিলারা, যা পুরুষরা পেতেন না। একে বোর্ডের বদান্যতা ভাবার কারণ নেই অবশ্য। প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস হল, ‘ভারতীয়রা ক্রিকেট দেখে না; দেখে ভারতীয় ক্রিকেটারদের’। মেয়েদের ক্রিকেটকে যাঁরা তাচ্ছিল্য করে এসেছিলেন, তাঁরা সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, মেয়েদের ক্রিকেট এমনিতেও কেউ দেখবে না। তাই খেলার ছাড়পত্র দিতে সময় লাগেনি।
এর পর ২০১৭-র বিশ্বকাপ। সেমিফাইনালে অবিশ্বাস্য খেলে অস্ট্রেলিয়াকে ছিটকে দেন হরমনপ্রীত কউর। ফাইনাল ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে। ফাইনালে ভারত হারলেও তাঁদের দেখতে মুম্বই বিমানবন্দরে জড়ো হন কয়েক হাজার ভক্ত। টনক নড়ে বোর্ডের। পরের বছর শুরু হয় উইমেন’স টি২০ চ্যালেঞ্জ। বার্ষিক চুক্তির অর্থ বাড়ে। ২০২২ সালের শেষ থেকে পুরুষ আর মহিলাদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফি সমান হয়। ২০২৩-এ শুরু হয় ডব্লিউপিএল। সাম্যের কথা বলতে শুরু করেন অনেকেই।
কিন্তু সত্যিই কি এসেছে সাম্য? সি-গ্রেডের পুরুষ ক্রিকেটাররা (হর্ষিত রানা, আকাশদীপ প্রমুখ) এখন পান বছরে এক কোটি টাকা; এ-গ্রেডের মহিলারা (হরমনপ্রীত, স্মৃতি, দীপ্তি) সেখানে পান তার অর্ধেক। মেয়েরা অনেক কম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন, ম্যাচ ফি সমান হলেও মোট টাকা অনেক কম জোটে। আর, ডব্লিউপিএল? এ বছরের নিলামে সবচেয়ে বেশি দর পান সিমরন শেখ, মাত্র ১.৯ কোটি টাকা (এর দায় অবশ্য বোর্ডের নয়)। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর ডব্লিউপিএল-এর আওতায় একশো জন ক্রিকেটারও আসেন না। আটত্রিশটা দল ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে, সেখানে টাকা না বাড়ালে দেশব্যাপী সাম্য আসবে কী ভাবে?
নবী মুম্বইয়ের অলৌকিক রাতের পর তাই প্রথম লড়াই এটাই। সব পর্যায়ে, সব ক্ষেত্রে, সব স্তরে সমান রোজগার। খতিয়ে দেখতে গেলে, না-হওয়ার কোনও কারণ নেই। ঠিকঠাক প্রচার হলে মেয়েদের ক্রিকেটে মানুষ টানা সম্ভব। স্রেফ বিপণনের জোরে ২০২০ সালের টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে মেলবোর্নে এসেছিলেন ৮৬,১৭৪ মানুষ। ডব্লিউপিএল, তার পর বিশ্বকাপ হওয়ার ফলে মুম্বই অঞ্চলে মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ ছিলই। নবী মুম্বইয়ের ফাইনালে তাই মাঠ ছিল কানায় কানায় ভর্তি। বার বার প্রমাণিত হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ চাইলে মাঠে দর্শক ঠিকই আনা যায়। তা হলে ক্রিকেটারদের টাকা বাড়াতে বাধা কোথায়? সত্যিই টাকা বেড়ে পুরুষদের সমান হবে কি না, বলা কঠিন। কিন্তু, হাজার হোক বিশ্বকাপ— তার একটা ন্যূনতম প্রভাব তো পড়বেই।
কিন্তু, লড়াই কি একটা? কপিলদেব-গাওস্করদের কেউ কখনও ছোটবেলায় বলেনি যে, ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে নেই; রাস্তাঘাটে মাঠেময়দানে ছেলেরা ক্রিকেট খেললে কারও ভুরু কোঁচকায় না। খেলায় হারলে রান্নাঘরে ঢোকার উপদেশে ফেসবুক-টুইটার ছয়লাপ হয়ে যায় না। হরমনপ্রীত-স্মৃতি-জেমিমাদের এখনও প্রতি দিন এমন অজস্র বাধা টপকাতে হয়। একটা বিশ্বকাপে কি দেড়শো কোটি মন পাল্টায়? দেখা যাক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)