Advertisement
E-Paper

নেতির রাজনীতি কেন

ইকো পার্কে পৌঁছনোর খানিক আগেই ডান পাশে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টার। অনেকের মতে, এটি বিশ্বমানের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু অধিক বর্ণনা স্তুতির নামান্তর বলে মনে হতে পারে।

সমঝোতা: বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনে মুকেশ অম্বানীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলাপ, ৫ ফেব্রুয়ারি।

সমঝোতা: বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনে মুকেশ অম্বানীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলাপ, ৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:২০
Share
Save

নিউ টাউনের প্রধান সড়কের উপর দাঁড়ালে শহরটাকে বেশ মোহময় লাগে! সন্ধ্যার পরে রবীন্দ্রতীর্থের সংযোগস্থল থেকে রাস্তার বাঁ-দিকে ঘুরে ইকো পার্কের দিকে যত এগোনো যায়, ততই ঝলমল করতে থাকে দু’পাশের সাজানো পরিবেশ।

অল্প কিছু বছর আগেও এই অঞ্চলের হাল এ-রকম ছিল না। আজকের ঝাঁ-চকচকে সুসজ্জিত ইকো পার্ক দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত যে, ২০১১-র আগে স্থানটিকে কার্যত বাদাবন বলা যেত। এখন প্রশস্ত ঝিলের এক পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে তাকালে অবশ্য সে সব বোঝার উপায় নেই। ইকো পার্কে পৌঁছনোর খানিক আগেই ডান পাশে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টার। অনেকের মতে, এটি বিশ্বমানের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু অধিক বর্ণনা স্তুতির নামান্তর বলে মনে হতে পারে। যদিও, এ ক্ষেত্রে অন্তত যা ছিল এবং যা হয়েছে, সেই বাস্তবতাটুকু অস্বীকার করার নয়।

এ বারেও ওই কনভেনশন সেন্টারে সাড়ম্বরে সম্পন্ন হল বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলন। উপসংহারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এ বার ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, উপস্থিত ছিলেন পাঁচ হাজারের বেশি প্রতিনিধি। রাজ্যের সঙ্গে ২৫ জন রাষ্ট্রদূতের বিবিধ রকম বাণিজ্যিক আলোচনা হয়েছে। বাইরের চল্লিশটি রাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগকারীরা এসেছেন এবং দেশবিদেশের সঙ্গে অনেকগুলি সমঝোতাপত্র (এমওইউ) সই হয়েছে।

সবাই জানেন, যে সব রাজ্যে বাণিজ্য সম্মেলন হয়, বিনিয়োগের নিরিখে প্রধানমন্ত্রীর ‘আপন দেশ’ গুজরাত তাতে সবার আগে। নরেন্দ্র মোদী সম্মেলনে হাজিরও থাকেন। গত বছরের সম্মেলন থেকে গুজরাতে মোট ২৬ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে দাবি।

মোদীর গুজরাতের তুলনায় মমতার পশ্চিমবঙ্গ সেখানে অবশ্যই নস্যি! তবে প্রশ্ন হল, বিনিয়োগ-প্রস্তাব কোথাও, কোনও রাজ্যে একশো শতাংশ রূপায়িত হয় কি? তথাপি কোথায়, কতটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক স্বাভাবিক ও পরিচিত। কারণ এর ভিতরে থাকে রাজনীতির উপাদান। যেমন, মমতা বলছেন, রাজ্যে এ পর্যন্ত মোট ১৯ লক্ষ কোটি বিনিয়োগ-প্রস্তাবের মধ্যে ১২ লক্ষ কোটি বাস্তবায়িত। বাকিটার রূপায়ণ নিয়ে বিভিন্ন স্তরে প্রস্তুতি চলছে। প্রত্যাশিত ভাবেই বিজেপি এবং সিপিএম দু’পক্ষই এই হিসাব চ্যালেঞ্জ করেছে। এটি হল মুদ্রার এক দিক।

অন্য দিকে, বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে কোন মাপের বিনিয়োগকারীরা উপস্থিত হচ্ছেন এবং কে কী বলছেন, সেই চোখে দেখা-কানে শোনার বিষয়গুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে এক দিকে যেমন ওজনদার বিনিয়োগ-কর্তাদের উপর ঘোষিত প্রতিশ্রুতি রক্ষার একটা দায়বদ্ধতা চেপে যায়, তেমনই সংশ্লিষ্ট রাজ্যে তাঁদের বিনিয়োগের সদিচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে সেই রাজ্য সম্পর্কে একটি ‘ইতিবাচক’ ধারণার বার্তা শিল্প-বাণিজ্য মহলে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ বারের বাণিজ্য সম্মেলন মমতার পক্ষে আশাব্যঞ্জক বলা চলে।

বিনিয়োগকারীরা সাধারণত কোথাও টাকা ঢালার আগে সেখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতি অর্থাৎ গুরুতর কোনও অস্থিরতা বা অনিশ্চয়তা আছে কি না, তা যাচাই করে নিতে চান। সেই বিবেচনার তালিকায় প্রশাসনিক হাল-হকিকত, আইনশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক অবস্থা, সামাজিক আবহ, সরকার তথা শাসকের অবস্থান, জনমত ইত্যাদি অনেক কিছুই থাকে। যার নির্যাস হল, ‘ইজ় অব বিজ়নেস’ বা মসৃণ ভাবে ব্যবসার সুযোগ কতটা সেটা খতিয়ে দেখা।

সন্দেহ নেই, গত এক বছরের দিকে তাকালেই রাজ্যের ঘাড়ে অনেক রকম অভিযোগের বোঝা দেখা যাবে। যার কিছুটা প্রশাসন ও পুলিশ-কেন্দ্রিক, কিছুটা রাজনৈতিক অর্থাৎ শাসক দলের দুর্নীতি-দাপট-দৌরাত্ম্য বিষয়ক। এর কোনটি হালকা বা কোনটি ভারী, সে সব তর্ক এই প্রসঙ্গে অর্থহীন।

বরং বেশি প্রাসঙ্গিক, মুকেশ অম্বানী, সজ্জন জিন্দলদের মতো শীর্ষস্তরের শিল্পপতিরা মমতার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘সুপ্রশাসক’, ‘শিল্পবান্ধব’ বলে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে গেলেন। টাটা গোষ্ঠীর নতুন চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন ফোনে মমতার সঙ্গে ‘ইতিবাচক’ কথা বললেন এবং তাঁর সংস্থার একাধিক কর্তাব্যক্তি সম্মেলনে যোগ দিলেন।

অনেকেরই মনে আছে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দু’বছরের মধ্যেই, ২০১৩ সালে, প্রথম মুম্বইতে দেশের শিল্পপতিদের নিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক সভা করেছিলেন মমতা। সেটা ছিল বাণিজ্য সম্মেলনের এক প্রকার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। সেখানে অম্বানী, জিন্দল ছাড়াও হিন্দুজা, গোদরেজ, বাজাজ, মহিন্দ্রা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা প্রমুখ যোগ দেন। টাটা-র তরফে ছিলেন বর্তমান চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখরন। তখন তিনি টিসিএস-এ। সিঙ্গুর নিয়ে টাটা-র সঙ্গে মমতার সম্পর্কের ক্ষতও ছিল বেশ দগদগে।

এ বার জানলাম, মমতা ও চন্দ্রশেখরন উভয়েই অচিরে মুখোমুখি আলোচনায় বসতে আগ্রহী। তাঁরা শিল্প-সম্পর্ক ‘প্রসারিত’ করতে চান। ইতিমধ্যেই কলকাতায় এসএসকেএম-এর কাছে এবং শিলিগুড়িতে টাটা-র আরও দু’টি ক্যানসার হাসপাতালের কাজও এগোচ্ছে।

মুম্বইয়ের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ’১৩-এর সভা যখন হয়, তখন সবে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে। মুকেশের মন্তব্য ছিল, “এই সময়ে এখানে সম্মেলন করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, শিল্প-বাণিজ্য তাঁর কতটা অগ্রাধিকার।” ওই রাতেই প্রায় চল্লিশ মিনিট মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত আলোচনা করেন মুকেশ, যার প্রধান দু’টি বিষয় ছিল ৪জি এবং হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের সরকারি শেয়ার কেনা। দ্বিতীয়টি অবশ্য এগোয়নি।

কথাগুলি ফের মনে করানোর পিছনে আছে এ বারের সম্মেলনে বাংলায় বিনিয়োগের জন্য মুকেশের অগ্রণী ভূমিকা, যেটা কারও নজর এড়ায়নি। তিনি বলেছেন, “দু’হাজার কোটি থেকে বেড়ে আপাতত এই রাজ্যে আমাদের ৫০ হাজার কোটি বিনিয়োগ হয়েছে। চলতি দশকের মধ্যে (অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরে) আরও ৫০ হাজার কোটি বিনিয়োগ হবে। সবাইকে বলছি, এই রাজ্যে বিনিয়োগ করুন।” বাংলায় শ্রমিক সমস্যা নেই, বলেছেন সজ্জন জিন্দল। সঞ্জীব গোয়েঙ্কা থেকে সঞ্জীব পুরী সবাই মনে করেছেন, বাংলা এখন বিনিয়োগের উপযুক্ত ঠিকানা।

এই সব শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারী, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গকে ‘গ্রহণযোগ্য গন্তব্য’ বলে মনে করলেন, তাঁরা কি স্রেফ তৈলমর্দনের উদ্দেশ্যে এ সব বলেছেন? না কি তাঁরা সবাই ধাপ্পাবাজ? বিরোধী রাজনীতি যেন তেমনই কিছু বলতে চায়।

নইলে অন্য সব রাজনৈতিক বিরোধিতা জারি রেখেও বৃহত্তর স্বার্থে শাসক-বিরোধী সবাই এক সঙ্গে রাজ্যের উন্নতির জন্য কোমর বাঁধবে না কেন? নিজের রাজ্যে বিনিয়োগ, উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়লে তাতে তো রাজ্যের মানুষেরই ভাল। এটা না বোঝা হঠকারিতার নামান্তর। দুর্ভাগ্য, সেই প্রসারতা পশ্চিমবঙ্গের কোনও নেতা-নেত্রীরই ধাতে নেই। থাকলে হয়তো বাণিজ্য-সম্মেলনে বিরোধী নেতাদেরও দেখা যেত।

এক দিন সিঙ্গুর থেকে টাটা-কে তাড়ানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় আসার জন্য ‘কার্যকর’ হয়েছিল— ক্ষমতায় আসার পর গা থেকে ‘শিল্প-বিরোধী’ তকমা মুছতে তাঁদের কালঘাম ছুটেছে। নেতির রাজনীতির সেই একই ফাঁদে বিজেপি, সিপিএম-ও পড়ে যাচ্ছে। ভাবা দরকার, বিরোধীপক্ষ হয়েও রাজ্যে বিনিয়োগের উদ্যোগকে স্বাগত জানালে, শিল্প-সম্ভাবনায় সহযোগিতা করলে তাতে ভোটব্যাঙ্ক ‘ফেল’ পড়ে না। বরং লোকের চোখে বিরোধীদের সদর্থক ভূমিকা স্পষ্ট হয়।

এক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির কাছে শুনেছিলাম, গুজরাতে তখন মোদীর সরকার। কংগ্রেসের আহমেদ পটেল দিল্লিতে সনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব। তাঁর সঙ্গে শিল্প ও বিনিয়োগে আগ্রহী কারও যোগাযোগ হলে পটেল চেষ্টা করতেন তাঁকে গুজরাতে পাঠাতে। তাঁর যুক্তি ছিল, “লড়াই রাজনীতিতে। কিন্তু গুজরাতের উন্নয়ন মানে তো আমার রাজ্যবাসীর ভাল।”

বারাসতের অদূরে অশোকনগরে তেলের সন্ধান পেয়েছে ওএনজিসি। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই তাদের এক টাকায় জমি দিয়েছেন। তেল উঠলে মোদী-মমতা কি ‘দখলদারি’র পাঞ্জা কষবেন?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BGBS 2025 Mamata Banerjee

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}