কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ হিসাবে বিবেচিত হওয়ায়, দুর্গোৎসব বলতে এক সময়ে রাজা-মহারাজাদের পারিবারিক পুজোই বোঝাত। বাংলার জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজো পালনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। তাঁরই উত্তরপুরুষ মহারাজ গিরিশচন্দ্র এক সময় মনে করলেন, এই পুজোকে সাধারণের মধ্যে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। নদিয়াবাসী মনে করেন, তাঁর আগ্রহেই রাজবাড়ির কর্মচারীদের বাড়িতেও শুরু হয় দুর্গাপুজো। সেই আয়োজনে আর্থিক সমস্যা দেখা দিলে রাজকোষ থেকে সাহায্য আসত। মহারাজ সশরীরে উপস্থিত হতেন কর্মচারীদের বাড়িতে সেই পুজো দেখতে।
বাংলার প্রাচীন কৃষিপ্রধান অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বছরে এই সময়টা মানুষের হাতে রোজগারের খানিকটা টান থাকত। তাই পুজোকে কেন্দ্র করে কিছুটা নড়েচড়ে বসার সুযোগ পেত সে-কালের অর্থব্যবস্থা। সমাজের সব শ্রেণির মধ্যেই কিছু কিছু আর্থিক লাভ ছড়িয়ে পড়ত। কাপড়, সিধা থেকে দক্ষ শিল্পীদের নগদ পারিশ্রমিক হিসাবে বেশ কিছু আয় হত কৃষিনির্ভর মানুষের। পুজো-পার্বণে ধনীদের দান-খয়রাতের মধ্যেও এই বিষয়টি প্রতিফলিত হত।
রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন যে, সে-কালের বড়লোকদের মেজাজও প্রায়ই বড় হত, তাই ‘বড়মানুষ’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে ধনী মানুষ বোঝাত। তখন টাকা শুধু জমাতে জানলেই সুখ্যাতি হত না, তার পাশাপাশি টাকা ছড়াতে জানলে তবেই নাম হত। যেমন ধরা যাক, কলকাতার বিখ্যাত ধনী বাবুদের একটি সমাজসেবামূলক কাজ ছিল দেনার দায়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তিদের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করে তাঁদের কারামুক্ত করা। কোম্পানির আমলে ঋণখেলাপির জন্য হাজতবাসের সাজা দেওয়া হত। দুর্গাপুজোর মতো ধর্মীয় পার্বণ অথবা পারিবারে নবজাতকের আগমনের মতো আনন্দ-উৎসবে এই ঋণগ্রস্ত কয়েদিদের দেনা মিটিয়ে তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করতেন ধনী বাবুরা। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পুজোর ঠিক আগে ছোট আদালতের সামনে অধমর্ণদের ভিড় জমে যেত। এই সময় হাজতে ঢুকতে পারলে কয়েদের মেয়াদ খুব বেশি হত না। কারণ অচিরেই তো তাঁদের মুক্ত করার জন্য বাবুরা আসবেন টাকার থলে নিয়ে! ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন’ প্রবাদ খ্যাত গৌরী সেন বহু ঋণগ্রস্ত কয়েদিকে অর্থসাহায্য করে মুক্ত করেছিলেন।
এক বার পুজোর আগে দেওয়ান জগৎরাম দত্তের বংশধর কাশীনাথ বাবুর কাছারিতে জমিদারির খাজনা জমা হল। তার মধ্যে ছিল পারিবারিক গুরুদেবকে দেওয়া ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তির খাজনাও। বাবু ফর্দ মিলিয়ে গুরুদেবের টাকা গোনার সময় হঠাৎ তাঁর হাত ফস্কে গুরুদেবের প্রাপ্য কয়েকটি মুদ্রা বাবুর কয়েক হাজার টাকার মধ্যে পড়ে মিশে গেল। এখন কোনটি গুরুদেবের টাকা, আলাদা করে সেটা তো নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। কাশীনাথ ব্রহ্মস্ব অপহরণের ভয়ে সব টাকাই গুরুদেবকে দিয়ে দিলেন।
এমন গল্প সে-কালের কলকাতায় কান পাতলে ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। দ্বারকানাথ ঠাকুর আসল সোনা-রুপার গয়না পরানো অবস্থায় প্রতিমার বিসর্জন দিতেন। খানিকটা বড়মানুষি দেখানোর চেষ্টা এর মধ্যে তো মিশে ছিলই। তবে প্রতিমা জলে পড়ার পর সেগুলি খুলে নিয়ে যেতেন মাঝিমাল্লারা। এই প্রান্তিক মানুষগুলির কিছুটা ধনবৃদ্ধিও উৎসবের অঙ্গ বলেই মনে করতেন সে-কালের বিত্তবানরা।
কথা হচ্ছে, এই সব গল্পের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট জীবনবোধ এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে হাতবদল হত। অবস্থার পরিবর্তনের ফলে প্রচুর কাটছাঁট হলেও একটা নৈতিকতার একটি মূল কাঠামো চেনা যেত বিংশ শতকের শুরুর দিকেও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির স্মৃতিচারণে।
বৈষ্ণবীদের গলায় আগমনী আর নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনার সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় কাপড়ের পুঁটলি কাঁখে তাঁতি-বৌদের দেখে বোঝা যেত যে পুজো এসে গেছে। বাজার থেকে পুরুষদের কেনা জিনিসপত্রের বাইরে অন্দরমহলের সওদার একটা আলাদা জগৎ ছিল। সেই দুনিয়ার বাসিন্দাদের পছন্দ অপছন্দের নাড়িনক্ষত্র জানতেন একমাত্র এই তাঁতি-বৌরা। কাপড়ের পুঁটলি নামিয়ে জল আর পান খেয়ে তাঁরা শুরু করতেন জিনিস দেখানো। ছোট ছেলেদের ফুলপাড়, কল্কেপাড় ধুতি থেকে ছোট মেয়েদের নীলাম্বরী, কালাপানি, কাপড় ঘুরে শুরু হত বৌ-ঝিদের জন্য শাড়ি দেখানো। একটি ‘পাখিপেড়ে’ শাড়ি দেখিয়ে হয়তো তিনি যোগ করতেন— ওই একটা শাড়িই পড়ে আছে, কারণ বাকিগুলি ও-বাড়িতে সব ‘নুপে’ নিয়েছে। কিন্তু পসরা লোভনীয় বা নয়ন-মনোহর হওয়াই শেষ কথা নয়। জা-ননদ-ভাগ্নি-ভাশুরঝি সকলকে দিয়ে-থুয়ে তার পর গিন্নিমা নিজের জন্য শাড়ি বাছতেন। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাড়িতে সংখ্যায় সেটি একটিই হত। তাঁতি-বৌরা মাঝেমধ্যে গিন্নিদের প্ররোচনা দিত, “ওটা য্যাখোন তোমার অ্যাতোই পছন্দ, নিজের লেগে আলাদা করে রাকো না অ্যাকটা বৌদি। দাম নাহয় পরে দিয়ো।” গিন্নি-মা বলতেন, “কী যে বলো! ছি! নিজের জন্য আলাদা!”
আশাপূর্ণা দেবী (জন্ম ১৯০৯) তাঁর শৈশবের স্মৃতিকথায় তাঁতি-বৌদের কাছে পুজোর কাপড় কেনার প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, নিজের জন্য আলাদা করে বেশিটা বা ভালটা নেওয়া সে-কালে ছিল খুব লজ্জার বিষয়। কারণ তখন পুজোর একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত বড় পরিবারের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে উৎসব উদ্যাপনের আনন্দ।
স্বাধীনতার আগের বছরগুলি থেকে দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে খাদি আন্দোলনকে জনপ্রিয় করার একটা বড় উপলক্ষ হয়ে ওঠে শারদীয়া উৎসবের বাজার। সে সময় গণমাধ্যমে বাড়তে থাকল স্বদেশি পণ্য, বিশেষ করে খাদিবস্ত্রের প্রচার। আজকের বিপণনশাস্ত্রের ভাষায় যাকে ‘সেলস পিচ’ বলে, সেটা শুরু হত এ ধরনের প্রশ্ন দিয়ে— ‘দরিদ্র ভাইদের সাহায্য কী প্রকারে করিবেন?’ উত্তরও দেওয়া থাকত তাঁর সঙ্গে— ‘খাদি কিনে’। সঙ্গতিসম্পন্ন বাড়ির ছেলেমেয়েরা যেমন নতুন জামাকাপড় পরে আনন্দ করবে, তেমনই দুঃস্থ কারিগরদের তৈরি পোশাক কিনলে তাঁদের বাড়িতে সেই আনন্দের রেশ প্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ সালের মাঝের বছরগুলিতে বাংলার দুর্গাপুজো সব অর্থেই সর্বজনীন হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৪৩ সালের নিদারুণ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে বাংলা। সর্বজনের ক্ষুধা না মিটলে সর্বজনীন উৎসবের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। সে বছর শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকীয় স্তম্ভে আকাল-পীড়িত সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়, “যিনি অন্নপূর্ণা, কুবের যাঁহার ভাণ্ডারী, তিনি কাঙ্গালিনীর বেশে ভিক্ষাপাত্র করে লইয়ে তোমার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।”
সাধারণ ভাবে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি থেকে আকাল হয়ে আবার সমৃদ্ধিতে ফিরে যাওয়ার মধ্যে একটা কালচক্র কাজ করে। এই ওঠাপড়ার মধ্যে সমাজের প্রান্তিক সদস্যদের খানিকটা আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়ার লক্ষ্য থেকে উৎসবের জাঁকজমকের শুরু। আবার আকাল বা সঙ্কটের সময়ও বিপদগ্রস্ত মানুষের দিকে সেই উৎসবের আঙিনা থেকেই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাহায্যের হাত। মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানোর বার্তা সর্বকালেই উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে বেজেছে। আজকের সমাজমাধ্যমে ও তার বাইরেও উগ্র দেখনদারির যুগে সে কথা আমরা মনে রেখেছি কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)