Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Karnataka Assembly Election 2023

কর্নাটক দেখাল আর্থিক বৈষম্যও কুর্সি হারানোর কারণ হতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে কি কেউ উদ্বিগ্ন?

এই বাড়তে থাকা বৈষম্যের অঙ্ক কিন্তু শুধু কর্নাটকের ছবি নয়। এটা বৃহত্তর ভারতের। তার ফল আগামী লোকসভা নির্বাচনে কী গিয়ে দাঁড়াবে তা অন্য প্রসঙ্গ।

An image of Congress Flag

রাজনৈতিক ভাবে দেশের আর্থিক শক্তি বৃদ্ধির প্রচার যত আলো পাচ্ছে ঠিক ততটাই বৈষম্য বৃদ্ধির আলোচনা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফাইল ছবি।

সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৩ ০৯:০৮
Share: Save:

কর্নাটকে বিজেপির হারের অঙ্কের নানা হিসাব ও তার চুলচেরা বিশ্লেষণে একটা অংশ এবং সেই অংশের বৃহত্তর অভিঘাত নিয়ে আলোচনা ওই রাজনৈতিক বিচারেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের প্রেক্ষিতে এই তথ্যটির কিন্তু অন্য গুরুত্ব রয়েছে। তথ্য বলছে বিজেপি-র হারের নানান কারণের মধ্যে একটি হল আর্থিক ভাবে দুর্বলদের দুর্বলতর হয়ে যাওয়া। এই বাড়তে থাকা বৈষম্যের অঙ্ক কিন্তু শুধু কর্নাটকের ছবি নয়। এটা বৃহত্তর ভারতের। তার ফল আগামী লোকসভা নির্বাচনে কী গিয়ে দাঁড়াবে তা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এই অনভিপ্রেত বৈষম্য যে ভারতের উন্নয়নকে ব্যাহত করে চলেছে সে সম্পর্কে কোনও সংশয় নেই। আর সেটাই হওয়া উচিত আজ এবং আগামীতে সব থেকে বড় আলোচনার বিষয়।

মাথায় রাখতে হবে দেশের সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধি আর উন্নয়ন কিন্তু এক নয়। বৃদ্ধির হার না বাড়লে উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হলেই যে সাধারণের শ্রীবৃদ্ধি হবে তাও কিন্তু ঠিক নয়। সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক ভাবে দেশের আর্থিক শক্তি বৃদ্ধির প্রচার যত আলো পাচ্ছে ঠিক ততটাই বৈষম্য বৃদ্ধির আলোচনা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

তথ্য বলছে, ভারতের আয় করতে সক্ষম নাগরিকদের মধ্যে ৬৯ শতাংশই আর্থিক শক্তিতে দুর্বল। আর আমরা বলছি আর ৭ বছরের মধ্যেই ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আর্থিক শক্তিতে পরিণত হবে। উন্নয়নের মানে হল এই দুই বিপ্রতীপ অবস্থানকে একমুখী করে তোলা। কিন্তু সাম্প্রতিক কোনও তথ্যই কিন্তু এই দুই অবস্থান যে একমুখী হাঁটছে তার কোনও প্রমাণ রাখতে পারছে না। উল্টে প্রায় সব তথ্যই বড়লোক আর গরীবের মধ্যে বাড়তে থাকা বিভাজনের কথাই বলছে। আর তা যদি না হত তা হলে কিন্তু আর্থিক সক্ষমতার অঙ্ক অন্য কথা বলত।

চারিদিকে বিভাজনের রাজনীতির আকচাআকচিতে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে বাড়তে থাকা আর্থিক বিভাজনই হল আসলে দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। সাধারণের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের বৃদ্ধিতেই লুকিয়ে রয়েছে প্রশাসনিক দূরদৃষ্টি এবং সক্ষমতার অন্যতম নির্দেশ। যদি অবশ্য উন্নয়নের অর্থকে আমরা দেখি সাধারণের স্বচ্ছলতার প্রেক্ষিতে।

যেমন এই তথ্যটি। ভারতীয় পরিবারগুলির মাত্র ১১ শতাংশ ব্যাঙ্ক বা ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। আর তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই সেই ঋণ দৈনন্দিন আর্থিক সমস্যা মেটানোয় ব্যবহার করে থাকে। তার মানে এই নয় যে বাকি ৮৯ শতাংশ আর্থিক ভাবে এতটাই স্বচ্ছল যে তাঁদের ঋণের প্রয়োজন নেই। যদি সংগঠিত আর্থিক বাজার থেকে ১১ শতাংশ ঋণ নিয়ে থাকেন এবং তার বড় অংশই যায় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর কাজে তা হলে কিন্তু মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে বাকি ৮৯ শতাংশ হাত পেতে থাকেন অসংগঠিত ঋণের বাজারে। কারণ দেশের সংগঠিত ঋণের বাজারে ঢোকার আর্থিক অধিকার তাঁদের নেই।

এই তথ্যের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে ২টি চিন্তার বিষয়। প্রথমটি হল, দেশের একটা বড় সংখ্যার নাগরিকের আয় যথেষ্ট নয় বলেই তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর তার ফলে তাঁরা আর্থিক ভাবে আরও দুর্বল হচ্ছেন। যুক্তিটা সোজা। আজকের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাঁদের আজকের আয় যথেষ্ট নয় বলেই তাঁরা ভবিষ্যতের আয়কে বন্ধক দিচ্ছেন আজকের আয়ের আর প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ফারাককে ঢাকতে। কিন্তু তা যদি ভবিষ্যতের বর্ধিত আয় থেকে মিটিয়েও হাতে সঞ্চয়ের মতো উদ্বৃত্ত থাকত তাহলে এটা মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু এমন তথ্য নেই যা থেকে আমরা বলতে পারি দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণের সম্বৃদ্ধিও দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এতটাই যে এই ঋণের বোঝা আগামীতে তাঁদের আর্থিক শিরদাঁড়া আরও ভাঙার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।

আর দ্বিতীয়টি যা প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত তা হল, এই ঋণ যেহেতু দৈনন্দিন খরচ মেটাতেই ব্যবহার হচ্ছে তাই এই ঋণ এমন কোনও স্থায়ী সম্পদ তৈরি করছে না যা এঁদের ভবিষ্যতে কাজে আসতে পারে।

আর হবেই বা কী করে? তথ্য বলছে দেশের গড় আয়যোগ্য পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি হয় ৪.২৩ তা হলে সেই পরিবারের গড় আয় দাঁড়ায় ২৩ হাজার টাকা। এই অঙ্কের পাশাপাশি কিন্তু আরও একটা অঙ্ক আছে। এদের মধ্যে ৪৬ শতাংশের আয় মাসে মাত্র ১৫ হাজার টাকা। আর দেশের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবারের কোনও আর্থিক দুশ্চিন্তার জায়গা নেই। কারণ তাঁরা বড়লোক বা উচ্চ উচ্চবিত্ত!

যে দেশের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবারের বিলাসবহুল জীবন, ১১ শতাংশের সংগঠিত বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও তাঁদের একটা বড় অংশই দৈনন্দিন দায় মেটাতে ঋণ নিয়ে থাকে সে দেশে বৈষম্যই তো রাজনৈতিক শিরোনামে থাকা উচিত। কিন্তু তা কেন থাকে না তা অন্য আলোচনা।

এই বৈষম্য এখন দেশের মজ্জায়। এতটাই যে ব্যবসাও এর থেকে মুক্ত নয়। বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আই এম এফের সাম্প্রতিক তথ্যও এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মাথায় রাখতে হবে ভারতের মাঝারি, ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প দেশের জাতীয় উৎপাদনের ৩০ শতাংশের সূত্র। এই ক্ষেত্রই দেশের সাধারণ আয়ের মানুষের আয়ের মূল সূত্রও বটে। প্রায় ১১ কোটি মানুষ এই ক্ষেত্রে কাজ করে। অথচ দেশের সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে নেওয়া ঋণের মাত্র ৬.৭ শতাংশ যায় এই ক্ষেত্রের প্রয়োজন মেটাতে। এদের ব্যবসার জন্য যত ঋণের প্রয়োজন এবং যতটা পেয়ে থাকে তার মধ্যে ফারাক প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের। ডলারের দাম ৮২ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। আর এই ফারাকের মূলেও কিন্তু সেই একই সমস্যা। সংগঠিত আর্থিক ক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার। নানা নিয়ম যা শেষ পর্যন্ত সাধারণের বিরুদ্ধে যায়। আর যায় বলেই এত ‘ফিনান্সিয়াল ইনক্লিউশন’ নিয়ে সবার মাথা ব্যাথা।

অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ ব্যবসার অবস্থান একই। সামাজিক অবস্থান বদলের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা থাকলেও সেই অবস্থান বদলানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতি প্রয়োজন তা নেই। সাধারণ বক্তব্যে উদ্যোগের সাফল্যের জন্য ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রয়োজন নেই বলেই এই অবস্থা বলা যেতে পারে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলবেন এই খানেই প্রয়োজন নীতির। আর এর দক্ষ প্রশাসনিক উপস্থিতির অভাব হলেই বাড়তে থাকে এই বৈষম্য। আর তৈরি হয় উন্নয়ন বৈকল্য। যার অবশ্যম্ভাবী ফল সামাজিক হিংসা ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যা। তাই অনেকেই স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির উদাহরণ টেনে বলেন যে আর্থিক ভাবে বলশালী হওয়ার থেকেও জরুরি সামাজিক ভাবে শক্তিশালী হওয়া। যাতে সাধারণ নাগরিক আর্থিক সক্ষমতা অর্জনকে দিবাস্বপ্ন না ভাবেন। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য একটাই। আগামী ৭ বছরের মধ্যে আর্থিক ভাবে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠার। তার ফল দেশের ৯৭ শতাংশ সাধারণ মানুষের উপভোগে লাগল কি না তা দেখতে উদগ্রীব নই আমরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE