রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের সমাবেশ হল কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে, জুলাই মাসে। আগে এই সমাবেশের গুরুত্ব, শাসনে থাকা বা না থাকাকালীন ক্ষমতাপ্রদর্শনের রকমফের, হাই কোর্টের নির্দেশের সাপেক্ষে যানজট থাকা না থাকা আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারত। অথচ, কিছু কাল ধরেই দেখা যায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমাবেশের খাবার। সমাজমাধ্যমে,এমনকি সংবাদমাধ্যমের মূল আলোচনার বস্তু হয়ে থাকছে খাবার।
কাদের খাবার? রাজনৈতিক সমাবেশে আসা অসংখ্য মানুষ, যাঁদের আমরা অভ্যাসগত ভাবে সাধারণ মানুষ বলি। তাঁরা তাঁদের প্রিয় নেতা বা নেত্রীর পোস্টারের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তোলেন। সেই নেতা বা নেত্রীকে খুব দূর থেকে দেখতে পেলেও তাঁরা খুশি। আর তাঁদের দেখে শহরবাসী আমাদের একদম প্রথমে সেই প্রশ্ন মাথায় আসে— ওই খুশির বদলে তাঁরা কী খেতে পেলেন?
কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন মাথায় আসে কেন? কলকাতার এক সমৃদ্ধ উপনগরীর শিবিরে এসেছেন অসংখ্য মানুষ, তাঁদের তত্ত্বাবধানে থাকা এক স্থানীয় নেতা জানালেন সংখ্যাটা প্রায় তিরিশ হাজার ছুঁইছুঁই। বৃদ্ধ, শিশু আছেন, সংখ্যায় কম। মহিলাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। প্রতি দিন তাঁরা চা করে সকলের সামনে ধরেন, এখানে তৈরি করা চা তাঁদের সামনে আসছে— মুক্তির স্বাদে তাঁদের আনন্দের শেষ নেই। অনেকেই এসেছেন সপরিবার। মন্দিরে যাবেন, হয়তো আর এক বার কলকাতা ঘুরবেন। তার পর সমাবেশে যাবেন— ফিরে এসে তৈরি গরম ভাত পাবেন। খুব বেশি পাওয়া নয়, তবু মূলত কায়িক শ্রম করতে ব্যস্ত মানুষ এক দিনের স্বস্তি পাবেন।
অবশ্যই কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠবে। এই খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আসে? সরকারি কোষাগার থেকে নিশ্চয়ই। এও ঠিক, এই খাবারের লোভ দেখিয়েই তাঁদের নিয়ে আসা হয়। ডিম-ভাত, না মাংস-ভাত, তাই নিয়ে সমাজমাধ্যম উত্তাল। নানান কুপনের সত্যি মিথ্যে ছবি। সঙ্গে মাদক, তরল পাওয়া যাচ্ছে কি না, কৌতূহলের অন্ত ছিল না। সেই কৌতূহলের সঙ্গে ছিল ব্যঙ্গ বা হাসির বিসদৃশতা।
যাঁরা সমাবেশে গিয়েছিলেন, তাঁদের কি আমরা চিনি? চিনি না, তবে রাশিবিজ্ঞানের এই বিশাল সংখ্যার মধ্যে আমরা খুঁজে পেতে পারি আমাদের গাড়ির চালক, বাড়ির সহায়িকাদের। শ্রমের বা জীবিকার দিক থেকে এঁরা মফস্সলের চায়ের দোকান চালানো স্বামী-স্ত্রীর থেকে বেশ কিছুটা পৃথক। কিন্তু সমাবেশের প্রেক্ষিতে তাঁরা এক। একই রকম সাধারণ।
আমাদের গাড়ির চালক বা বাড়ির সহায়িকারা কিছু চেনা গল্প বলেন প্রতি বারই। অমুক দাদা কেমন জোর করেছেন, তাই যেতেই হচ্ছে ইত্যাদি। তাঁরা নিজেদের শ্রমের মালিক নয়, তাই প্রতি বার একই গল্প বলতে হয়। সমাবেশের আসার সিদ্ধান্ত সত্যিই তাঁদের স্বেচ্ছার সিদ্ধান্ত, না কি তাঁদের বাধ্য করা হয়েছে? এই উত্তর পাওয়া সহজ নয়। অন্য শাসনকালেও ছিল না, এখনও নয়। বর্তমান শাসকদের পূর্বসূরিরা কাউকে জোর করতেন কি না, এই নিয়ে কম সরব হননি তৎকালীন বিরোধী, এখনকার শাসকরা। ভারতের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে এর উত্তর নেই। নির্বাচনে রিগিং হয় কি না, সে প্রশ্নের যেমন উত্তর নেই।
আর আমরা যারা সমাবেশে গেলাম না? কেউ জোর করল না বলে? কেন? আমরা ‘সাধারণ’ নই বলে? কিছু মানুষ বিপরীত মতাদর্শে বিশ্বাসী বলে গেলেন না। অন্যরা? যদি তাঁদের নামে সত্যিই ফরমান আসত তাঁদের চাকরিস্থলে, তাঁরা যেতেন না? ‘ডিম্ভাত’ খেতে গেলে যেমনটা সাধারণ হয়ে যেতে হয়, তেমনটা তাঁরা হতেন না? অন্যকে নিয়ে হাসার সময়, কিছু কপচানো বুলি আওড়াবার সময় এমন সম্ভাবনার কথা মনে রাখছি তো?
শেষে একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। শহরের একদম কেন্দ্রে, সংখ্যালঘু প্রধান একটি অঞ্চলের ময়দান সংলগ্ন অঞ্চলে দু’টি দল। দু’টি দলই দুপুরের রান্না চাপিয়েছে। এক জনের মেনু ডিম-ভাত, আর এক জনের মাংস। একটি বাচ্চা ছেলে খিদের মুখে দু’জনের কাছে গিয়েই পেটপুরে খেয়েছে। প্রথমে বোঝা যায়নি, তার পর ধরা পড়েছে। বিষয়টি অনেক দূর গড়ায়, স্থানীয় পুলিশ এসে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মীমাংসা করে।
গল্প শুনে হাসির শেষ নেই। ডিম-ভাত বা মাংস-ভাত নিয়ে এমন হাসির ঘটনা কি আর হতে পারে? মনে পড়ে, এক সময় ‘মাছভাত’-‘মার্ক্সবাদ’ ধ্বনিসাযুজ্য নিয়ে আপাত-বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কম হাসাহাসি হত না। বিষয়টিতে তাই রাজনৈতিক পরিচয় নয়, শ্রেণিপরিচয়ই প্রধান হয়ে ওঠে। যারা খিদের মুখে গোগ্রাসে ‘ডিম্ভাত’ খায়, তারা কিছুতেই আমরা নই। তারা ‘ওরা’। ভোটবাক্সে তারা আমাদের সঙ্গে ভোট দেয় ঠিকই, কিন্তু আমার পাশে পাত পেড়ে বসতে পারে না। আমরা টিভি দেখার সময় তারা সোফার তলায় বসে। তারা পুজোর সময় ছুটি চাইলে আমরা বিরক্ত হই।
ডিম ও মাংস নিয়ে হাসাহাসির মধ্যে সেই ‘আমরা’ মনে রাখি তো, ‘ওদের’ আমরা জানি না, চিনি না?
অর্থনীতি বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)