E-Paper

লিঙ্গবৈষম্য ফাঁদে বিজ্ঞানপাঠ

ভারতে প্রতি বছর এক কোটিরও বেশি স্নাতক তৈরি হলেও, তাদের পঠনপাঠনের বিষয়ের সঙ্গে কাজের জগতের সম্পর্ক সামান্যই।

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৮

শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে কাজ করতে হলে প্রয়োজন হয় প্রধানত চারটি বিষয়ের শিক্ষা— বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এঞ্জিনিয়ারিং, গণিত। এই চারটির ইংরেজি শব্দের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘স্টেম’ শব্দটি। কাজের বাজারে এগুলির গুরুত্ব উত্তরোত্তর বাড়ছে। কিন্তু ভারতে স্টেম স্নাতকদের মধ্যে মহিলা মাত্র ৩৪%। স্নাতক স্তরের পর চাকরির ক্ষেত্রে এআই এবং ডেটা সায়েন্সের কর্মীদের মধ্যে ২৬% মহিলা, এঞ্জিনিয়ারিং-এর ১৫% এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে ১২%। অথচ, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের হিসাবে আগামী দশকে ৮০% নতুন কাজের সঙ্গে স্টেম বিষয়গুলির যোগ নিবিড় হতে চলেছে। ফলে স্টেম নিয়ে পড়াশোনায় লিঙ্গভেদ চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পেশাজগতেও লিঙ্গবৈষম্য অনেক বাড়বে।

ভারতে প্রতি বছর এক কোটিরও বেশি স্নাতক তৈরি হলেও, তাদের পঠনপাঠনের বিষয়ের সঙ্গে কাজের জগতের সম্পর্ক সামান্যই। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রকাশিত যে দেশের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পড়ুয়াদের যথাক্রমে মাত্র ৮.২৫% এবং ৭.৬৭% অংশ এমন কাজে যুক্ত হচ্ছে, যার সঙ্গে তাদের শিক্ষার বিষয়ের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষা এবং কাজের পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা এক দিকে যেমন শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগের সুফল কমিয়ে দিচ্ছে, তেমনই অন্য দিকে পড়ুয়াদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের শিল্প-পরিষেবা কর্মীদের থেকে দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজন উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের নতুন পথ। অতএব স্টেম বিষয়ের কোনওটিতে কেবলমাত্র ডিগ্রি থাকলেই চলবে না, সেগুলির সঙ্গে পড়ুয়াদের মন এবং মননের যোগ থাকতে হবে।

এ দেশে মেয়েরা যে রয়ে যাচ্ছে স্টেম-এর বৃত্তের বাইরে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ একটা অশনিসঙ্কেত। ‘অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন’ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের এঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের মধ্যে ছাত্রী কেবল ১৯% । ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ কিংবা ‘উড়ান’ প্রকল্পের বিজ্ঞাপনী প্রচারেও দেশের প্রযুক্তি পাঠে এই লিঙ্গবৈষম্যের চিত্রের বিশেষ বদল হয়নি। এঞ্জিনিয়ারিং-এর শাখাগুলির মধ্যেও অসাম্য প্রকট— ছাত্রীদের ৮.৪% সিভিল, ১৬.৭% মেকানিক্যাল, ২১.৫% ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হচ্ছে। মেয়েদের আগ্রহ তুলনায় বেশি কম্পিউটার সায়েন্স, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো বিষয়ে। এর সবটাই যে মেয়েদের সচেতন নির্বাচন, এমন ধরে নেওয়া চলে না। সামাজিক এবং পারিবারিক চাপও কাজ করে, কারণ শিক্ষার বিষয় নির্বাচনের সঙ্গে পেশা নির্বাচন এবং তার সঙ্গে ভবিষ্যৎ পারিবারিক জীবনের নকশা যুক্ত রয়েছে। সিভিল, মেকানিক্যাল, মাইনিং, প্রোডাকশন এঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো পেশাতে কায়িক শ্রম বেশি, কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি, এমনই মনে করা হয়। তাই ছাত্রীদের পছন্দের তালিকায় এগুলি উপরে থাকে না। ফলে প্রযুক্তির পাঠের শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়ে লিঙ্গবৈষম্য।

এই বৈষম্যের শুরু স্কুল থেকে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী গুজরাত, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানের মতো রাজ্যতে হাই স্কুল ছাত্রীদের অধিকাংশ কলাবিভাগের বিষয় নির্বাচন করে। কিন্তু তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশের মেয়েদের ৭৫% উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পাশ করছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মেয়েরা ‘স্টেম’ শিক্ষায় অনেক এগিয়ে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের ২০২৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান নিয়ে পাশ-করা পড়ুয়াদের মাত্র ১২% ছাত্রী। অর্থাৎ স্কুল স্তরেই বিজ্ঞানশিক্ষা থেকে ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ মেয়ে।

‘সায়েন্স’ নিয়ে পড়বে বাড়ির ছেলেরা আর ‘আর্টস’ নেবে মেয়েরা, অলিখিত এমন বিধান এখনও বাংলার ঘরে ঘরে চলেছে। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনার জালে জড়িয়ে গিয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষার অধিকারটাও। মেয়েদের মাথায় অঙ্ক ঢোকে না, এটা মেয়েদের অঙ্ক শিক্ষা শুরু হওয়ার অনেক আগেই বাড়ির বড়দের মগজে ঢুকে পড়েছে। এর উপর বিজ্ঞান শিক্ষায় পড়ার খরচ আর্টসের চেয়ে আড়াইগুণ বেশি। শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি করতেই হয়, তা ছেলেদের জন্যই করতে চায় পরিবার।

এমন চিন্তার জেরে আজ স্টেম বিষয়গুলিতে কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদাসীনদের মধ্যে মেয়েদের ভাগ মাত্র ১৫%। ফলে মেয়েদের সামনে ‘রোল মডেল’-ও কম। এ দিকে আজকের পুঁজিনিবিড় ডিজিটাল শিল্পপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের জায়গা নিয়েছে বৌদ্ধিক শ্রম। কাজের সময় ও নিয়োগের শর্তেও এসেছে অনেক নমনীয়তা। এই অবস্থায় প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের বাজারে আরও বেশি মেয়েদের টেনে আনা সম্ভব, কিন্তু তাতে নেতৃত্ব দিতে হবে সরকারকেই। এতে কাজের বাজারে দক্ষ কর্মী বাড়বে, তেমনই প্রযুক্তি ও কর্মনিযুক্তির হাত ধরে মেয়েদের ক্ষমতায়নও বাড়বে।

এ দেশে স্টেম বিষয়ে মহিলা স্নাতকদের মাত্র ২৯% স্টেম-সম্পর্কিত কাজের বাজারে ঢুকতে পারে, বাকিরা হারিয়ে যায় অনিশ্চয়তার আবর্তে। আবার, বহু সামাজিক বাধা অতিক্রম করে স্টেম শিক্ষা লাভ করেছে যারা, তাদেরও কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের বেড়াজালে আটকাতে হচ্ছে। অথচ উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর কাজের জন্য লিঙ্গ-জাত-ধর্মের বেড়া এখনই ভাঙা দরকার। সেটা কি হবে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

STEM Gender Inequality

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy