E-Paper

স্বীকৃতিহীন পরিচিতির মানুষ

সমাজের তাচ্ছিল্য, অপমান, ঠাট্টা সহ্য করার পাশাপাশি, এক জন ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার মানুষকে নিজের ধর্ষণ-অভিজ্ঞতাকেও মুখ বুঝে চেপে রাখতে হবে?

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৫ ০৭:০৪

ভারতের প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের প্রতিনিয়তই শারীরিক ও মানসিক ভাবে হেনস্থা হতে হয়। এর মধ্যে, পিছিয়ে-পড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের অত্যাচার-অভিজ্ঞতা বাকিদের তুলনায় ২.৯ গুণ বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন যৌনতার মানুষদের প্রান্তিকতাকে তাঁদের দুর্বলতা ভেবে নেওয়া হয়। ভারতে সমকাম আইনি ভাবে স্বীকৃত। কিন্তু সেই স্বীকৃতি দৈনন্দিন জীবনের অপমান-তাচ্ছিল্যের হাত থেকে সমকামী ব্যক্তিদের কি বাঁচাতে পারে? এমনকি পরিবার, পরিচিত ও চার পাশের সমাজ থেকে প্রাপ্ত অপমানের সামনে দাঁড়ানোর মতো কোনও ক্ষমতা কি রাষ্ট্র তাঁদের দিয়েছে?

২০১৪ সালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার সম্পর্কে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (নালসা) বনাম ভারত যুক্তরাষ্ট্র মামলার রায়ে শীর্ষ আদালত স্পষ্ট করে বলেছিল, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজে সমান মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের, মতপ্রকাশের অধিকার আছে। পোশাক, ভাষা বা আচরণের মধ্যে কোনও ব্যক্তির যৌনপরিচয় প্রকাশিত হলে, তা অন্যায় তো নয়-ই, বরং স্বাভাবিক ব্যাপার। নালসা রায় বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছিল একটি চিন্তার দিকে— শুধুমাত্র শারীরিক পরিচয়ের দ্বারাই কারও লিঙ্গ নির্ধারণ করা যাবে না; প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তর্গত পরিচয়ও তাঁর লিঙ্গের নির্ধারক। এই রায় কেবল তৃতীয় লিঙ্গের জন্য হলেও, সমগ্র এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি-র অন্তর্গত মানুষের অধিকারের ক্ষেত্রেই তার অন্তর্নিহিত অবস্থানটি প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয় কি?

সে অধিকারকে রাষ্ট্র কী চোখে দেখে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সদ্য চালু হওয়া ভারতীয় দণ্ড সংহিতা। সেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞাটি সীমিত কোনও পুরুষের দ্বারা কোনও নারীর ধর্ষিত হওয়ার গণ্ডিতে। কোনও সমকামী ব্যক্তি ধর্ষিত হলে; অথবা এক জন পুরুষ অন্য কোনও পুরুষ বা নারী দ্বারা ধর্ষিত হলে সেই অপরাধটি ধর্ষণ কি না, দণ্ডবিধিতে তার কোনও প্রত্যক্ষ উল্লেখ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, সে ক্ষেত্রে অপরাধীর বিচার হবে অন্যান্য— লঘুতর— ধারায়। এই বৈষম্যের কারণ কী? শহর থেকে গ্রাম-মফস্‌সলে সমকামী ব্যক্তিরা অনেক সময়েই দৈহিক নিগ্রহের শিকার হন। সমাজের তাচ্ছিল্য, অপমান, ঠাট্টা সহ্য করার পাশাপাশি, এক জন ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার মানুষকে নিজের ধর্ষণ-অভিজ্ঞতাকেও মুখ বুঝে চেপে রাখতে হবে?

চার পাশের জীবন থেকে ইন্টারনেট, নিগৃহীত হওয়ার পরিধি বিস্তৃত ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। ভিন্ন যৌনতার পরিসরে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কয়েকটি ডেটিং অ্যাপ্লিকেশন আছে, যা আমাদের দেশের বহু প্রান্তিক মানুষের কাছে একটা স্বাধীনতার দরজা খুলে দেয়। সমাজের অধিকাংশ স্তরেই বেশির ভাগ সমকামী মানুষ নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে চলতে বাধ্য হন। সেই গোপনীয়তাকে ডেটিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিও মানবিক ভাবেই সমর্থন করে। কিন্তু এর ফলে অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। বিগত কিছু বছরে, ডেটিং অ্যাপ্লিকেশনগুলির মাধ্যমে দেখা হওয়ার পর টাকাপয়সা লুট, যৌননিপীড়ন, হুমকি ও খুনের কথাও জানতে পারা যায়। অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা শুনতে পাওয়া গেলেও, এই নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে ব্যক্তির নিজেকে আড়াল করার সুবিধা অনেক বেশি।

এক জন মানুষের সঙ্গে যখন কোনও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তিনি কী করবেন? কোথায় যাবেন? দেশের অন্যান্য নাগরিকের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর সহজ— এমন ক্ষেত্রে তিনি দেশের আইন-ব্যবস্থার দ্বারস্থ হবেন। কিন্তু, সমীক্ষায় প্রকাশ, ভিন্ন যৌনতার মানুষেরা অসম্ভব পরিমাণে হেনস্থার শিকার হন পুলিশ ও অন্য আইনি সরকারি আধিকারিকদের দ্বারা। এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ও বহু ভিন্ন যৌনতার মানুষের হয়ে লড়েছেন এমন এক আইনজীবীর অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পেরেছিলাম, থানায় কোনও সমকামী ব্যক্তি নিজের পরিচয় প্রকাশ করলে এখনও অনেক পুলিশকর্মীই তাঁর অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে শুনতে চান না। তাঁর ভিন্ন যৌনপরিচয়কে বিকৃতি ভাবেন। অবহেলা করেন। অনেকে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে গেলে তবে হয়তো তাঁরা অভিযোগের বিষয়টিকে আইনি পথে নিয়ে যান।

তা হলে কি ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার একক ব্যক্তির সামনে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ? কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে প্রায় উদাসীন। আমাদের রাজ্যে ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস ডেভলপমেন্ট বোর্ড থাকলেও, সমকামী ব্যক্তিদের জন্য কোনও সেল বা দফতর নেই। এ-কথা ঠিক, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের যৌনপরিচয়ের বিবিধ পর্যায় সম্পর্কে জানাতে এবং তাঁদের অধিকার বিষয়েও চার পাশকে ওয়াকিবহাল রাখতে বিভিন্ন অসরকারি সংস্থা নানা পদক্ষেপ করে। কিন্তু এর সঙ্গেই, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির উচিত এই বিষয়ে সমাজের সর্ব স্তরে জনসচেতনতা তৈরি করা। বিশেষত, থানা ও সরকারি পরিমণ্ডলে নিয়মিত এ-সম্পর্কে বিভিন্ন কর্মসূচি, সেমিনারের আয়োজন করা দরকার। যে কোনও সরকারি উদ্যোগের মধ্যে রাষ্ট্রের সমাজভাবনার একটা পরিচয় থাকে, এ ক্ষেত্রে যা স্বীকৃতিস্বরূপ। সরকার আয়োজিত কর্মসূচিগুলি সাধারণ জনমানসে সমকামিতার প্রতি অস্পৃশ্যতাকে হয়তো কমাতে পারবে। ভিন্ন যৌনতার মানুষের কাছে তাঁর পরিবার, পরিচিত জনেরাই প্রথম সমাজ। সেখান থেকেই অপমানের তিরগুলি ছুটে আসতে শুরু করে। এর ফলে, লোকনিন্দার ভয়কে সরিয়ে হয়তো পরিবারও তাদের সঙ্গে থাকা প্রান্তিক মানুষগুলির ভিন্ন পরিচয়কে বুঝতে চাইবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

LGBTQ Constitution of India Homosexuality

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy