Advertisement
E-Paper

ভাঙা, হেলা বাড়ির শহর

অবৈধ নির্মাণের প্রশ্নটি উঠলে বিরোধী এবং শাসকের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়ে যায় দুর্নীতি নিয়ে। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

পল্লব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:৩৬
Share
Save

কলকাতার গার্ডেনরিচের আজার মোল্লা বাগানে একটি বাড়ি ধসে পড়েছিল ১৭ মার্চ, ২০২৪। প্রাণ হারিয়েছিলেন তেরো জন। দেখা গেল, ওই এলাকায় অবৈধ বাড়ি প্রচুর। বছর না ঘুরতেই বাঘাযতীন, ট্যাংরা, এন্টালি, কসবা, ভবানীপুর থেকে একের পর এক বাড়ি হেলে পড়ার অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। এক্সাইডের মোড়ে হেলে-পড়া বাড়িটির অবস্থা বিপজ্জনক। গার্ডেনরিচ কাণ্ডের জেরে যত কড়াকড়ি শুরু করেছিল পুরসভা, সংবাদের শিরোনাম থেকে বাড়ি ভাঙার খবর মিলিয়ে যেতেই সে উদ্যোগও মিলিয়ে গেল।

অবৈধ নির্মাণের প্রশ্নটি উঠলে বিরোধী এবং শাসকের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়ে যায় দুর্নীতি নিয়ে। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। পুরপ্রতিনিধিরা বেআইনি নির্মাণ থেকে মোটা টাকা উৎকোচ নেন, এমন ধারণা মানুষের মনে শিকড় গেড়েছে। তাই বড় বড় দুর্ঘটনা, এবং তার জেরে বহু শোরগোলের পরেও দেখা গিয়েছে যে, বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ কার্যকর করা যায়নি। গার্ডেনরিচ কাণ্ডের পর গত এপ্রিল মাসে পুরসভা নির্দেশ দেয়, বেআইনি নির্মাণগুলির বিদ্যুৎ, জল ও নিকাশির সংযোগ কাটতে হবে। কিন্তু সে নির্দেশ কার্যকর করা যায়নি। বহু জায়গায় শাসক দলের নেতা-সমর্থকরাই বাধা দিয়েছেন। পুরসভা সূত্রের সংবাদ, গত দু’বছরে সাতশো বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ফেলা গিয়েছে, এবং বাড়ির অনুমোদনের জন্য আবেদনের হাজার তিনেক বাতিল করা হয়েছে।

বেআইনি নির্মাণ ঠেকাতে পুরসভার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা কী? কী করে এত সহজে তার পাশ কাটানো যায়? ১৯৮০-র মিউনিসিপ্যাল আইন অনুযায়ী কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং ট্রাইবুনাল তৈরি হয়, যার কাজ অবৈধ নির্মাণ সংক্রান্ত অভিযোগের বিচার, জরিমানা করা, অবৈধ নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দেওয়া, অথবা ভাঙার নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়া। এক জন বিচারপতি এবং এক জন প্রযুক্তিবিদ সদস্য (টেকনিক্যাল মেম্বার) নিয়ে গঠিত বিল্ডিং ট্রাইবুনাল কাজ শুরু করে ১৯৮৪ সালে। ২০২৪ সালে বিচারক সদস্য অবসর নেওয়ায় প্রায় পাঁচ মাস কাজ বন্ধ ছিল। তার প্রেক্ষিতে এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সেপ্টেম্বরে ট্রাইবুনাল পুনরায় চালুর বিষয়ে জানতে চায়। এর পরই নড়েচড়ে বসে পুরসভা। অবশেষে নতুন বিচারপতি নিয়োগ হয় কিন্তু প্রযুক্তিবিদ সদস্যের পদ থাকে শূন্য। তাই ট্রাইবুনাল অকেজো।

তবে মিউনিসিপ্যাল ট্রাইবুনালের সঙ্গে যুক্ত এক আইনজীবীর মতে, প্রধান সমস্যা পুরসভার বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট-এর শিথিলতা। অবৈধ নির্মাণগুলির বিরুদ্ধে যত মামলা করা উচিত, তত হচ্ছে না। গত দু’বছরে এই আদালতে দু’শোরও কম মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। বাম আমলেও মামলার সংখ্যা আশানুরূপ ছিল না। এখন পুলিশও সে ভাবে আর মামলা করে না। আদালতের বাইরে ‘বিশেষ বন্দোবস্ত’ করে অভিযোগের ফয়সালা হয়ে যায়।

পুরসভা অসাধু ব্যবসায়ীদের যদি বা অবৈধ নির্মাণের নোটিস দেয়, সেখানে উল্লিখিত সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পরেও ব্যবস্থা করে না। সংবাদে প্রকাশ, কলকাতা পুরসভার ষোলোটি বরো এলাকায় গত বছর ২৮ জুন থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ জমা পড়েছে ৫২৫টি। অথচ, তার মধ্যে ভাঙা হয়েছে মাত্র ২৬৪টি বাড়ি। পুরসভার বিল্ডিং বিভাগই এই তথ্য দিয়েছে।

কঠোরতার অভাবের জন্য অবৈধ নির্মাণে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। বরং পূর্ব কলকাতার ইএম বাইপাস-সংলগ্ন এলাকায় বড় বড় জলাশয় বুজিয়ে বহুতল বাড়ি তৈরি হচ্ছে দিনে-দুপুরে। গত কয়েক বছরে আনন্দপুর থানা এলাকার মার্টিন পাড়া, গুলশন কলোনি, পূর্ব পঞ্চান্ন গ্রাম, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিম চৌবাগা, নোনাডাঙা, আদর্শ নগর প্রভৃতি এলাকা দ্রুত হয়ে উঠেছে বেআইনি নির্মাণের স্বর্গরাজ্য। তপসিয়া-সংলগ্ন গুলশন কলোনিতে অন্তত পাঁচ হাজার বেআইনি ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে, পুরসভা-নির্দিষ্ট বিধি অনুসারে জমি ছাড় না দিয়েই। একই চিত্র গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এবং রাজাবাজারেও। বৈধ নথিপত্র না থাকলেও অবৈধ ফ্ল্যাটের ক্রেতা রয়েছে, কারণ দাম অনেক কম।

বাম আমলে ১৯৮৯ সালে ভবানীপুরে প্রদীপ কুন্দলিয়ার তৈরি বেআইনি নির্মাণ ভেঙে এগারো জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। উত্তাল হয়েছিল বাংলার রাজনীতি। সেই প্রথম বেআইনি নির্মাণের ঝুঁকির বিষয়টি বড় আকারে মানুষের নজরে আসে। কিন্তু পুরসভার কর্মসংস্কৃতির যে বদল হয়নি, তা দেখাল গার্ডেনরিচে তেরো জনের মৃত্যু, হেলে-পড়া বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্কট।

রয়েছে রাজনীতির সংস্কৃতিও। অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে গিয়ে পুরসভার ইঞ্জিনিয়াররা বার বার বাধা পান এলাকার মহিলাদের কাছ থেকে, কারণ তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট মহিলা পুলিশকর্মী থাকেন না। যেন ব্যর্থ হওয়ার উদ্দেশ্যেই অভিযান। বেআইনি নির্মাণে বাধা দিতে গিয়ে গত নভেম্বর মাসে আক্রান্ত হলেন শাসক দলেরই এক কাউন্সিলার। বেরিয়ে এল শাসক দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনি। এই কাহিনি বাম আমলেও বার বার শোনা গিয়েছে। সিন্ডিকেট রাজের শুরু বাম আমলে। এখন বাম দলগুলি বিরোধী। তাদের দাবি, তৃণমূল সরকারের আমলে বেআইনি নির্মাণ বহুগুণ বেড়েছে। বস্তি অঞ্চলগুলিতে একের পর এক বেআইনি বাড়ি তৈরি হচ্ছে। রাজনীতিতে, প্রশাসনে যে পরিবর্তন এলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব, তার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

municipalities KMC

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}