E-Paper

অনিশ্চিত সময়ের নীতি

দেশের কর রাজস্ব কী ভাবে বণ্টিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে সরকারের বাইরে থাকা কোনও একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, এমন ব্যবস্থা গোটা দুনিয়াতেই বিরল।

পিনাকী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ০৮:১২

ষোড়শ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা অক্টোবরের ৩১ তারিখে। যদি না কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে তার মেয়াদ বৃৃদ্ধির জন্য আবেদন করে, তা হলে হাতে সময় রয়েছে তিন মাসেরও কম— এর মধ্যে কমিশনকে যাবতীয় আলোচনা শেষ করতে হবে, এবং সুপারিশ তৈরি করে তা জমা দিতে হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। ভারতে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মধ্যে কর রাজস্ব কী ভাবে ভাগ করা হবে, তা নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হল অর্থ কমিশন। প্রতি পাঁচ বছরে এক বার কমিশন গঠিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে মোট ১৫টি অর্থ কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করেছে সরকার। দেশের রাজ্যগুলির হাতে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যাতে যথেষ্ট টাকার সংস্থান থাকে, তা নিশ্চিত করতে অর্থ কমিশের সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ষোড়শ অর্থ কমিশনের সুপারিশ ২০২৬-২৭ থেকে ২০৩০-৩১ অবধি কার্যকর থাকবে।

অর্থ কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, এবং তা সম্পূর্ণ ভাবে স্বায়ত্তশাসিত। দেশের মোট কর রাজস্বের কতখানি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে, আর কতখানি রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীন দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের। ফলে, অর্থ কমিশনের সুপারিশ কেন্দ্রীয় এবং বিশেষত রাজ্য সরকারগুলির কাছে আর্থিক দিক থেকে অতি তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের কর রাজস্ব কী ভাবে বণ্টিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে সরকারের বাইরে থাকা কোনও একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, এমন ব্যবস্থা গোটা দুনিয়াতেই বিরল। এটি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্যতম শক্তি হিসাবে গণ্য।

প্রতিটি অর্থ কমিশনের সুপারিশের মেয়াদই পাঁচ বছর। এখন ভারতে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ বলবৎ রয়েছে। সেই সুপারিশ অনুসারে, কেন্দ্রীয় সরকার মোট যত কর রাজস্ব আদায় করে, তার ৪১% রাজ্যগুলিকে দিতে হয়। এখানে খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কর ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যে সেস এবং সারচার্জ আদায় করে থাকে, সেগুলি কিন্তু বণ্টনযোগ্য রাজস্ব নয়— সে টাকায় অধিকার শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের। কর-বহির্ভূত অন্যান্য রাজস্ব, যেমন বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থেকে প্রাপ্ত মুনাফা বা লভ্যাংশ, সেগুলোর উপরেও শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার।

ভারতে মোট সম্পদের পরিমাণ, এবং বর্তমান রাজস্ব সম্পর্কের চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পদের প্রয়োজন এবং তার মোট জোগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। এর কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কিন্তু, কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্যের কার কতখানি টাকার প্রয়োজন, তার নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমেই স্থির করতে হয় যে, রাজ্যগুলিকে মোট রাজস্ব আদায়ের কত শতাংশ দেওয়া প্রয়োজন, আর কেন্দ্রের হাতেই বা সম্পদের কত ভাগ থাকবে। অতীতের অর্থ কমিশনগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছে। এক দিকে তারা নিশ্চিত করেছে যে, দেশের রাজস্ব-ভারসাম্য যেন বজায় থাকে; আর অন্য দিকে, রাজস্ব ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারও হয়েছে।

সাম্প্রতিক অতীতেই এর বিভিন্ন উদাহরণ রয়েছে। দ্বাদশ অর্থ কমিশন রাজ্যস্তরে নিয়মভিত্তিক রাজস্বব্যবস্থার ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে দেয়; ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন জিএসটির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে, এবং রাজস্ব ক্ষেত্রে সাবধানতার নীতিগত কাঠামোকে শক্তপোক্ত করে; চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নির্ধারিত হয় যে, কেন্দ্রীয় রাজস্বের ৪২% ভাগ করা হবে রাজ্যগুলির মধ্যে— যে সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যগুলির আর্থিক স্বাধীনতা বাড়ে; অতিমারি চলাকালীন পঞ্চদশ অর্থ কমিশন রাজস্ব-ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং রাজ্যগুলির হাতে যথেষ্ট টাকার ব্যবস্থা করতে অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতিকাঠামো প্রস্তাব করে। স্বভাবতই আশা করা হচ্ছে যে, আগের কমিশনগুলির মতো ষোড়শ অর্থ কমিশনের সুপারিশও ন্যায্যতার নিরপেক্ষ নীতির নিরিখেই হবে। এই নীতির থেকে যে কোনও বিচ্যুতিই শেষ অবধি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্ষতি করবে।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে আর্থিক প্রয়োজনের বিস্তর ফারাক রয়েছে— যেমন ফারাক রয়েছে রাজ্যগুলির মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রেও। বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সম্পদ ও আয়ের অসমতার কথা মাথায় রেখে অতীতে একাধিক অর্থ কমিশন কর রাজস্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে যে গোত্রের নীতি গ্রহণ করেছিল, পরিভাষায় তাকে বলা হয় প্রগ্রেসিভ ডিভোলিউশন অব ট্যাক্সেস— অর্থাৎ, মাথাপিছু আয়ে যে রাজ্য যত পিছিয়ে রয়েছে, কর রাজস্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে তার ভাগে তত বেশি পড়বে। দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ষোড়শ অর্থ কমিশনের সামনেও বিবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে বৃহত্তমটি হল, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে যে ভাবে আর্থিক অনিশ্চয়তার মাত্রা বাড়ছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির সম্ভাবনার পরিমাপ করতে পারা। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যদিও আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে অতিমারির ধাক্কা বেশ ভাল ভাবেই সামলে উঠেছে, কিন্তু বৃদ্ধির হারের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস করার জন্য বিভিন্ন অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কথা মাথায় রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, কোভিড অতিমারির কারণে কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরে সরকারি ঋণের পরিমাণ অতিমারি-পূর্ব সময়ের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ রকম ভাবে বেশি। যদিও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের তুলনায় ঋণের অনুপাত গত দুই অর্থবর্ষে কমেছে, কিন্তু এই অনুপাত হ্রাসের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। বেশ কয়েকটি বড় রাজ্যে ঘাটতি বেড়েছে— বিশেষত রাজস্ব ঘাটতি। সরকারি খরচের গুণমান বৃদ্ধির একটি পন্থা হল, অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ করা, কর্মপরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের খাতে খরচ বাড়ানো, এবং অবশ্যই মূলধনি খাতে ব্যয় করা। কিন্তু, মূলধনি খাতে ব্যয় তখনই বাড়ানো সম্ভব, যখন রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ কমবে। ব্যয়ের গুণগত মান বৃদ্ধি করার জন্য রাজস্ব ঘাটতি কমানোর একটি অতিমারি-উত্তর নীতিকাঠামো চাই।

রাজস্ব নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য, উভয় স্তরেই আরও দু’টি প্রশ্ন ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রথমটি দ্রুত নগরায়ণ সংক্রান্ত— এবং, এই নগরায়ণের পিছনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে দেশের দরিদ্রতর অংশ থেকে ধনীতর অংশ বিপুল জনগোষ্ঠীর অভিবাসন; এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত। যদিও অর্থ কমিশন নীতিনির্ধারক সংস্থা নয়, কিন্তু তার পক্ষে স্থানীয় স্তরে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রণোদনা তৈরি করা সম্ভব, যাতে শহরগুলি আর্থিক বৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে, এবং শহরাঞ্চলে বিপুল পরিযাণের চাপ সামলাতে পারে। ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনীর পরবর্তী অর্থ কমিশনগুলি এই প্রক্রিয়াকে প্রণোদনা জুগিয়েছে— বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজ্য সরকারগুলির জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে। পরবর্তী পর্যায়ে দ্রুত নগরায়ণের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার জন্যও এমন আর্থিক নীতিকাঠামো প্রয়োজন।

ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের সময় থেকেই পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স বা বিবেচ্য বিষয়ের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে, অতীতে অর্থ কমিশনগুলি এই প্রশ্নকে আংশিক ভাবে দেখেছে। রাজ্যগুলিকে আর্থিক সাহায্য এবং কর রাজস্বের ভাগের পরিমাণ, দুই নির্ধারণেই ফরেস্ট কভার বা অরণ্য আচ্ছাদনের মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন স্পষ্ট যে, জলবায়ু প্রশ্নটি এমনই, যার সমাধানে সার্বিক প্রয়াস প্রয়োজন। তাই, কমিশনের নীতিতেও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যগুলির সার্বিক রাজস্ব পর্যালোচনা প্রয়োজন— অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামলাতে কোন রাজ্যের কত খরচ বাড়বে, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কোন রাজ্যের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতাতেই বা কতখানি প্রভাব পড়বে, দুই হিসাবই দেখতে হবে। এবং, সেই অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এমন নীতিকাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে অর্থ কমিশনই সম্ভবত সবচেয়ে যথাযথ প্রতিষ্ঠান। সরকারের সমস্ত স্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে রাজস্ব নীতি ব্যবহারের যে নীতিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন, ষোড়শ অর্থ কমিশন সেই কাজটি করুক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Central Government Taxes Finance commission

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy