E-Paper

বিধ্বংসের দায় প্রকৃতির নয়

ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত ২৮ জুলাই, একটি মামলার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারকের বেঞ্চ স্পষ্ট বলেছে, ভয়ঙ্কর সব বিধ্বংসের দায় প্রতি বারই প্রকৃতির উপর চাপানো যায় না। ওই মন্তব্যের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট মনুষ্যকৃত হস্তক্ষেপগুলিকে চিহ্নিত করেছে।

জয়া মিত্র

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৫ ০৪:১৩
ধূলিসাৎ: বিপর্যস্ত ধারালীতে উদ্ধারকাজে ব্যস্ত জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা, ১৪ অগস্ট।

ধূলিসাৎ: বিপর্যস্ত ধারালীতে উদ্ধারকাজে ব্যস্ত জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা, ১৪ অগস্ট। ছবি: পিটিআই।

ধারালী নামের একটি প্রাচীন ছোট জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল হিমালয়ের গা থেকে। গত পঁচিশ বছরে এই নিয়ে চার বার— ধসে গেল উত্তরকাশী শহর। অথচ, প্রতি বারই দু’বছরের মধ্যে আবার ওঠে ছয়তলা সাততলা বাড়ি, মঠ আশ্রয় ভবন। চার ধাম, যে নামে কোনও তীর্থশৃঙ্খলা কোনও দিন ছিল না, সেই তীর্থক্ষেত্র টুরিজ়মের জন্য চার লেনের ‘অল ওয়েদার রোড’-এর সুবিধা পাওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে হোটেল, হোমস্টে, রিসর্ট। এ সব চলতে থাকে, যত দিন না পরের বিপর্যয় আসে। টিহরি বাঁধের কিছু উপরে, গঙ্গোত্রী থেকে অল্প আগে ধারালীতেও একই ভাবে গড়ে উঠেছিল হোটেল, রিসর্ট। মাটির পাহাড় নবীন হিমালয় এই ভার নিতে পারল না।

ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত ২৮ জুলাই, একটি মামলার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারকের বেঞ্চ স্পষ্ট বলেছে, ভয়ঙ্কর সব বিধ্বংসের দায় প্রতি বারই প্রকৃতির উপর চাপানো যায় না। ওই মন্তব্যের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট মনুষ্যকৃত হস্তক্ষেপগুলিকে চিহ্নিত করেছে। তার মধ্যে আছে উচ্চ হিমালয়ের স্পর্শকাতর অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে বড় নদীবাঁধ ও সুড়ঙ্গপথ তৈরি, চার লেনের রাস্তা তৈরি, অরণ্যছেদন, বহুতল বাড়ি ও হোটেল নির্মাণ— এ সব ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সুরক্ষার আইনগুলিকে অমান্য করা।

২০১৩ সালে কেদারনাথের কাছে মন্দাকিনী অববাহিকার ভয়ঙ্কর ধসে, যেখানে মৃতের সংখ্যা সরকারি ভাবেই ছিল চার হাজারের বেশি, সেখানেও সরকার নির্মিত হাই পাওয়ার কমিটি ওই একই কারণ নির্দেশ করে— নদীর ধারা পার করানোর জন্য পাহাড়ে যথেচ্ছ টানেল কাটা, বিস্ফোরণ ঘটানো, হাজার হাজার বৃক্ষচ্ছেদ। পাহাড়ি ঢালের মাটিকে শিকড়ের আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে গাছই। কিন্তু কোনও শিক্ষা কি নেওয়া হয়েছিল সেই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে? না। সমস্ত দায় চাপানো হয় কেদারশৃঙ্গের উপরে তৈরি হওয়া একটি হ্রদ ভেঙে যাওয়া ও মেঘভাঙা বৃষ্টির উপর। হিমালয়ের প্রাকৃতিক বিশেষত্ব এবং ভারসাম্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হল। সুপ্রিম কোর্টের ২৮ জুলাইয়ের ওই মন্তব্যের পরও ‘ক্লাউড বার্স্ট’ই হিমালয়ে পাহাড় ধসে পড়া, বড় বাঁধের নির্মীয়মাণ কাঠামো ভেঙে নদীজলে ভেসে যাওয়া, প্রাণহানি ও আশপাশের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির কারণ বলা হয়। এখন শোনা যাচ্ছে, ‘মেঘভাঙা বৃষ্টি’ নামক যে ভিলেনের কারণে পাহাড়ের অধিকাংশ ভূমিধস ঘটে থাকে, সেও নাকি তেমন ভাবে ঘটেইনি ওইখানে। কাকে বলে ‘ক্লাউড বার্স্ট’? কতটা পথ হাঁটলে পরে…!

অতুল সতি, জোশীমঠ মাটিতে বসে যেতে শুরু করার পর যিনি সারা দেশের কাছে বিষয়টির ভয়াবহতা তুলে ধরেন, গত ৫ অগস্টের বীভৎস ধস সম্পর্কে বলেন, শুধু হিমাচল নয়, উত্তরাখণ্ড থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ— পুরো হিমালয় উন্নয়নের বুলডোজ়ারের নীচে পিষে যাচ্ছে। ২০১৩-র বিপর্যয়ের পর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি হাই পাওয়ার কমিটির মতও ছিল একই। তাঁরা বলেন, ওই এলাকায় নির্মাণকাজের জন্য যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, তার তীব্র কম্পন হিমালয়ের পক্ষে বিপজ্জনক। বলা হয় অগ্রিম বিপদসঙ্কেতের ব্যবস্থা করার কথা।

২০২১ সালে রেনি গ্রামের কাছে, নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির ভিতরে, ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হয়। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় পাঁচশো মিটার লম্বা এবং ততটাই চওড়া একটি শিলাপীঠ তার উপরে জমা বরফ-সমেত স্থানচ্যুত হয়ে নেমে আসে। এই বিপুল বরফ, পাথর ও মাটির স্তূপ ঋষিগঙ্গা প্রকল্পকে ধুয়ে নিয়ে চলে যায়। সেখানে কাজ করছিলেন যে ৭০ জন শ্রমিক, তাঁদের নিয়েই। হাজার হাজার টনের এই প্রকাণ্ড স্তূপ, জলস্রোত, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে। জোশীমঠের নীচে ধাক্কা দেয়। জোশীমঠের নীচে বিষ্ণুপ্রয়াগের পুল, যা ২০১৩-র বিপর্যয়ে ভাঙেনি, তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যায়। তার পরও ২০২৫-এ সেই প্রকল্পে আবার কাজ শুরুর উদ্যোগ করা হচ্ছে। সরকার নিজেই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে।

যে পর্বতচূড়ায় ঋষিগঙ্গার উৎস, বিপর্যয়ের পর বিশেষজ্ঞেরা বলেন ক্রমাগত বিস্ফোরণের দরুন তা দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জোশীমঠের বাড়িগুলিতে ফাটল দেখা দেয়। ভূবিজ্ঞানীরা সার্ভে রিপোর্টে বলেন, বাড়িতে ফাটল, জমি বসে যেতে থাকা— এ সবই ছিল ২০২১-এর বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ অংশ। কারণ, উপরে রেনি গ্রাম, কুয়ারি, কুয়ারি পাস থেকে যে বিরাট শিলাপীঠ, সেটি এই অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই প্রকাণ্ড ভূস্খলনের জন্যই ২০২১ সালের শেষ দিক থেকে জোশীমঠের বাড়িতে বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। ২০২২ সালের সারা বছর ধরে সেটি বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালে যখন সেই ফাটল আরও বাড়তে থাকে, তখন জোশীমঠ খালি করানো শুরু হয়।

অতুল সতি বলেন, “১৯৭৬ সালের যে মিশ্র কমিটির রিপোর্ট, তার উপর নির্ভর করেই আমরা ওই অঞ্চলে এনটিপিসি-র কাজ শুরুর বিরোধিতা করছিলাম। মিশ্র কমিটির রিপোর্ট-এ বলা হয়, হিমালয়ে এই রকম ভারী কাজ হওয়া বিপজ্জনক। ফলে ২০০৩-০৪ থেকে আমরা টানা বিরোধিতা করছিলাম। তার পর ২০১০-এ যখন এনটিপিসি-র কাজ শুরু হল, জোশীমঠের নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ কাটা হচ্ছিল, সুড়ঙ্গের মধ্যে মেশিন আটকে রয়ে গেল আর জলের ধারা আটকাল, সে সময় একটা বড় আন্দোলন হয়। আমাদের দাবি ছিল, আমাদের বাড়িঘরের বিমা করানো হোক। কারণ, তখনই আমরা এই ফাটলের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলাম বা আশঙ্কা করছিলাম। হাই পাওয়ার কমিটির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের চুক্তি হয় যে, বিমা করানো হবে, যদিও তা হয়নি।” বিভিন্ন কমিটি, স্থানীয় লোকজন, পরিবেশকর্মী— সকলের বাধা অগ্রাহ্য করেই হিমাচলপ্রদেশে উন্নয়নের কাজ চলতে থাকে। সরকার নিজের তৈরি কোনও পরিবেশ সুরক্ষা আইনই মানার লক্ষণ দেখায় না। খুব বড় কিছু ঘটলে মিডিয়ায় সেই খবর স্রেফ ‘ওপেন অ্যান্ড শাট’ করে দেওয়া হয়। ২৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মন্তব্য ছিল, এ ভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মানচিত্রে হিমাচল নামে কোনও রাজ্য থাকবে না।

এই প্রবল বিপদ অভ্রান্ত ভাবে আমাদেরই দিকে গড়িয়ে আসছে। প্রকৃতিতে প্রতিটি জিনিস অচ্ছেদ্য ভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়ানো। আদিম জল আদিম ভূমির উপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে কোটি কোটি বছরে পৃথিবীর ভূমিরূপ তৈরি করেছিল। আজ উচ্চ হিমালয়ের সেই মাটি পাথর এ সব প্রকাণ্ড ভূমিধস, নদীপ্লাবনের সঙ্গে নীচের দিকে গড়িয়ে আসছে, তা সেই গঠিত সমভূমিকে বিপুল মাটিকাদার স্তূপে ঢেকে দিয়ে নিয়ে আরও পূর্ব-দক্ষিণে যাবে। তা শুরু হয়েছে, আমরা গ্রাহ্য না করলেও।

বর্ষাকালে কর্তৃপক্ষ বাঁধ খুলে দিতে বাধ্য হলে প্রতিটি নদীবাঁধের পিছনে জমা যে পলিমাটির স্তূপ জলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে, তার মধ্যে পাহাড়ের ধসের মাটি যুক্ত থাকে। এই মাটির পরিমাণ প্রতি বছর বাড়বে, কারণ তা বন্ধ করার কোনও সদিচ্ছা বা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ছোট-বড় প্রতিটি নদীর খাত বালিতে বন্ধ। এখন বর্ষার জল ভরে যাওয়া নদী উপচে আসে, এর পর নিচু খাদের অভাবে তা মাটির উপর দিয়ে আসবে। মাঝে পড়া জনপদগুলির ভবিষ্যতের পরিস্থিতি সম্প্রতি ধারালী গ্রামের ছবিতে দেখা গিয়েছে।

২০১৩-য় শ্রীনগরে অলকানন্দার প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা কয়েকশো বাড়ির একতলা পর্যন্ত নদীর কাদায় ডুবে ছিল। ছাদে দাঁড়িয়ে হাহাকার করতে থাকা বাসিন্দাদের ছবি দেখে তখন ভয় পেলে এই বিপর্যয় হয়তো এড়ানো যেত।

হিমালয়, তার হিমবাহ, নদীধারা, শৈলশৃঙ্গ, অরণ্যের জটিল, মহতী, নিশ্চিত শৃঙ্খলা তৈরি হতে যত দিন লেগেছিল, মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায় স্খলন হবে তার চেয়ে দ্রুত। ভয়ের জিনিসে ভয় পাওয়াই মনে হয় রক্ষা পাওয়ার উপায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Natural Disasters Man-made Disasters Flash flood

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy