কিছু দিন ধরেই একটা গানের সুর ঘুরছে মাথার মধ্যে। চেনা সুর, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না। ভরসা স্মার্টফোন, দু’-তিনটে রিল স্ক্রল করতেই দেখি, মেরি পপিন্স গান গেয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, ‘আ স্পুনফুল অব শুগার হেল্পস দ্য মেডিসিন গো ডাউন’। এই গানই তো বাজছিল অবচেতনে! কাকতালীয় ঘটনা। তবে এমন বার বার ঘটলে মনে হয়, স্মার্টফোন নিশ্চয়ই মন পড়তে পারে। এটা জানি যে, কিছু খুঁজলে বা কোনও কিছু নিয়ে কথা বললে তা নিয়ে মুঠোফোনে খবর চলে আসবে। কিন্তু এ তো যখন-তখন মন পড়ে ফেলছে: কিছু খেতে ইচ্ছে করলে দেখি তার রেসিপির ভিডিয়ো, কোনও ফিল্মস্টারের কথা ভাবলে তার ছবির বিজ্ঞাপন, এমনকি খুব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যা শুধু আমার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নিয়েও দেখি কারও বক্তব্য আমার পাতায় আসছে। এ কি নিছকই কাকতালীয়?
কাকের বসা আর তালের পড়া, দু’টি ঘটনা একই সময় ঘটলেও পরস্পর সম্পর্কিত নয়। পরিসংখ্যানের ভাষায়, ‘ইনডিপেন্ডেন্ট ইভেন্টস’। এমন ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে। কাজে বেরোতে ইচ্ছে করছে না মোটেই, ঠিক তখনই আকাশভাঙা বৃষ্টি। বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর কথা মনে পড়তেই হঠাৎ ফোন বেজে ওঠা, স্ক্রিনে তার নম্বর। আমাদের নিত্যদিনের জীবনে একরাশ বিস্ময় ছড়িয়ে যায়।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এই মিল কি সত্যিই এতটা সরল? মেরি পপিন্সের গানের কথা ভাবছি বলেই তা ইনস্টা-ফিডে আসছে, নাকি ইনস্টা-ফিড আমাকে বাধ্য করছে ঠিক ওই গানটির কথাই ভাবতে? আজকাল ‘অ্যালগরিদম’ শব্দটি বহুব্যবহৃত, অ্যালগরিদম হল ধাপে ধাপে সাজানো নিয়মের অনুক্রম। সমাজমাধ্যমের কাঠামো এক-একটি অ্যালগরিদমের ভিত্তিতে চলে, ব্যবহারকারীর ভাল লাগা বিষয় সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করে। আমার ফিডে পুরনো হলিউডি ছবির রিল আসছিল, সেগুলো অনেক বার দেখেছি, লাইকও দিয়েছি। ইনস্টাগ্রাম জেনে গেছে পুরনো হলিউড আমার পছন্দের, অ্যালগরিদম অনুযায়ী সে আমার পেজে বারংবার তা নিয়ে আসছে। আমার মাথায় মেরি পপিন্সের কথা হঠাৎ এক দিন এসেছে, এমনও নয়। দীর্ঘ দিন ধরে ওই হলিউডি রিল দেখছি বলেই মস্তিষ্ক আমার দেখা পুরনো ছবির স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে, তাই মেরি পপিন্সের স্মৃতি মনে টোকা দিচ্ছে। কাকতালীয় মনে হলেও, এর পিছনে আছে একাধিক স্তরের প্রক্রিয়া: মস্তিষ্কের নিজস্ব ‘প্যাটার্ন রেকগনিশন’ আর ডিজিটাল অ্যালগরিদমের সূক্ষ্ম খেলা।
দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় তথ্য— কখন কোন ভিডিয়ো দেখছি, কত ক্ষণ দেখছি, কোন পোস্টে লাইক দিচ্ছি, কী এড়িয়ে যাচ্ছি, সব জমা হয় স্মার্টফোনে। সুযোগ মতো এগুলোই হয়ে ওঠে ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবের ‘ট্রেনিং ডেটা’। সমাজমাধ্যমের ছক-বাঁধা অ্যালগরিদম এই ডেটা থেকে প্যাটার্ন বার করে শিখে নেয় কোন ব্যবহারকারীর কোন কনটেন্ট প্রিয়, কখন সে বেশি সক্রিয় থাকে, কোন মেজাজে কী ধরনের ভিডিয়োতে সে থেমে যাবে। সেই বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিষ্কার যে, যা আমরা নিছক কাকতালীয় বলে মনে করছি তা আসলে অনেক অদৃশ্য সমীকরণের ফল। ব্যবহারকারীর পুরনো পছন্দ, পূর্ববর্তী সার্চ, ভিউ হিস্ট্রি, এমনকি বন্ধুদের পছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে এক সূক্ষ্ম অনুমান তৈরি করে এই অ্যালগরিদম। যে গান বা সিনেমার দৃশ্য হঠাৎ আমাদের সামনে আসে, তা বরং আমাদের আগের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নির্মিত পূর্বাভাস; খোলা চোখে ধরা না পড়া বিজ্ঞানের হিসাব। যন্ত্রের কাছে তা গণিত ও সম্ভাবনার নির্ভুল ব্যবহার।
আমরা আজকাল যে ভাবনাগুলো ভাবি সেগুলো কতটা ব্যক্তিগত আর কতটা প্রভাবিত, তা হয়তো নিজেরাও জানি না। আগে মনে প্রশ্ন জাগলে সমাধান ছিলেন শিক্ষক বা অভিভাবক, আজ সে জায়গা অনেকটাই নিয়েছে স্মার্টফোন। আমাদের ভাবনা তার কাছে রক্ষিত থাকে ডেটা হিসেবে। একটা সময় অবধি সে আমাদের চিন্তাধারা অনুসরণ করে, পরে সূক্ষ্ম কৌশলে আস্তে আস্তে আমাদের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের ব্যক্তিত্ব হয়ে দাঁড়ায় আমাদের ইনস্টা-ফিডের প্রতিচ্ছবি। আমরা যেন অ্যালগরিদমের দুর্গে বন্দি— এই কারাগারে গরাদ নেই, আছে নোটিফিকেশনের টুংটাং, স্ক্রিনের ঝলমলে আলো। আমরা ভাবি আমরা মুক্ত, অথচ আমাদের প্রতিটি পছন্দ, সিদ্ধান্ত, এমনকি আমাদের বিস্ময় পর্যন্ত নির্ধারিত এক অদৃশ্য ইশারায়।
একটা সময় হয়তো ‘কাকতালীয়’ শব্দের অস্তিত্বই থাকবে না। কাকতালীয় বিস্ময়ের প্রতীক; বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যত অগ্রগতি হবে, বিস্ময় ততই কমবে। বিস্ময়ের উৎপত্তি অজানার থেকে, আজ আমাদের কাছে খুব বেশি কিছু অজানা নয়। তবু আমরা তো চাইবই হঠাৎ পেয়ে যাওয়া গানের সুরে আনন্দ খুঁজতে, হঠাৎ-বৃষ্টিতে ভিজতে, হঠাৎ আসা বন্ধুর ফোনে খুশি হতে। বেঁচে থাকার জন্য এই বিস্ময়ের প্রয়োজন। যে ক’টা সমাপতন আজও ঘটে, তাতেই নাহয় খুশি থাকি!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)