আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, বা সংক্ষেপে আইসিজে) এ বছর ৮০-তে পড়ল ঠিকই, তবে, সত্যি বলতে কী, এতখানি তরুণ, উদ্দীপনায় ভরপুর তাকে আগে কখনও মনে হয়নি। প্রশান্ত মহাসাগরের খুদে দ্বীপরাষ্ট্র ভ্যানুয়াটু পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তুলে ধরেছে এই সর্বোচ্চ আদালতে, আর বদলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন। তাদের কাছে মুহূর্তটি যেন বাইবেলের ডেভিড বনাম গলিয়াথ দ্বৈরথের অনুরূপ। তাদের আর্জির ফলে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের অনুরোধে (১৩২টি রাষ্ট্রের সমর্থনক্রমে) আইসিজে জলবায়ু পরিবর্তনেরক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির আইনি বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে মতামত প্রকাশ করেছে, যা প্রকৃতপক্ষে বেশ কড়া কিছু উপদেশ।
আইসিজে-তে উত্থাপিত প্রশ্নগুলি ছিল সহজ-সরল, কিন্তু স্থিতাবস্থার ভিত টলিয়ে দিয়েছে। প্রশ্নগুলো এই রকম— আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় রাষ্ট্রগুলির বাধ্যতামূলক ভাবে কী কী করণীয়? না পারলে, আইনি ব্যবস্থাই বা কী?
আইসিজে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। সেই কর্তব্য শুধু প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো বিধিগুলিতেই নিহিত নয়, পরিবেশ আইন, মানবাধিকার আইন ও প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনেও তার ভিত রয়েছে। দ্য হেগ-এর পিস প্যালেস থেকে আইসিজে প্রেসিডেন্ট ইয়ুজি ইওয়াসাওয়া বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ একেবারে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, এবং তা গোটা দুনিয়ার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে।” রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধি জন সিল্ক বলছেন, “বিজ্ঞান এই বিপদ সম্বন্ধে চিরকালই স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে; এখন আইনেও ধোঁয়াশা রইল না।”
আন্তর্জাতিক স্তরের সর্বোচ্চ আদালত যে সর্বসম্মতিক্রমে এমন একটি অবস্থানে পৌঁছতে পারল, সেটাই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু যে পথে হেঁটে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল, তা আরও চমকপ্রদ। আইসিজে-তে উত্থাপিত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ জলবায়ু-মামলার উৎপত্তি কিন্তু কোনও মন্ত্রিসভা বা থিঙ্কট্যাঙ্ক-এ হয়নি, বস্তুত তার সৃষ্টি ক্লাসঘরে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলের ২৭ জন আইনবিদ্যার ছাত্রের মস্তিষ্কপ্রসূত, যাঁরা গঠন করেছেন প্যাসিফিক আইল্যান্ডস স্টুডেন্টস ফাইটিং ক্লাইমেট চেঞ্জ (পিআইএসএফসিসি)। শুরুতে সংগঠনটির নেতা ছিলেন সোলোমন ইয়েও, পরে ভার নেন সিন্থিয়া হোউনিউহি। দু’জনেই সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের মানুষ। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ফিজির বিশাল প্রসাদ, টোঙ্গার সিয়োসিউয়া ভেইকিউন। এঁরা কেউই অভিজ্ঞ কূটনীতিজ্ঞ নন; বা কোনও কোটিপতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকও নন। কিন্তু তাঁদের জেদ চেপে গিয়েছিল। জাস্টিন রোজ়ের যুক্তি, “বিষয়টা হার-জিতের নয়, কখনও কখনও লড়াইটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।” রোজ় ফিজিতে ইউনিভার্সিটি অব দ্য সাউথ প্যাসিফিক-এর প্রাক্তন অধ্যাপক, ২০১৯-এ তাঁরই ক্লাসঘরের কাজকর্মের মধ্যে এই অপ্রত্যাশিত বিপ্লবটির বীজ বপন হয়।
জলবায়ু-ন্যায়ের আন্দোলনে এক জবরদস্ত বিজয়নিশান উড়িয়ে দিয়েছে এই রায়। সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ একক ভাবে প্রতিবাদে গর্জে ওঠার পর থেকেই এই আন্দোলনে গতি এসেছে। আন্দোলন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মর্যাদা ও আইনি স্বীকৃতির দাবি তুলছে, বিচারবিভাগ কর্তৃক এই আনুষ্ঠানিক অনুমোদনে তার জমিটা আরও শক্ত হল এই প্রথম বার।
‘গ্লোবাল সাউথ’, অর্থাৎ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দুনিয়ার পক্ষেও এ এক বিজয়মুহূর্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলি এমন সব ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে, যেগুলির সৃষ্টিতে তাদের কোনও ভূমিকাই নেই। কয়েক দশক ধরেই এই অবিচার নিয়ে সরব তারা। এ বার এই বৈষম্যের বিষয়টিতে সিলমোহর দিয়েছে আইসিজে-ও এবং সংশোধনে প্রথম পদক্ষেপটি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলি এত দিন ধরে যে দাবি করছিল, আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত তার ন্যায্যতা স্বীকার করে নিল। সেখানে সৈকতরেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, মিঠে জলেও নুন ভরে যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় শক্তি বাড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এক আইনি যুদ্ধের নায়ক হয়ে উঠছে সেই দেশগুলি, যারা এত দিন ক্ষীণবাক, বঞ্চিত, নির্যাতিত দলের বলেই গণ্য করা হত।
আইসিজে-তে জলবায়ু সমস্যার বিচারের চেষ্টা এটাই প্রথম নয়। ২০১২-য় পালাউ এবং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ একই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক মদতের অভাবে তাদের থেমে যেতে হয়। এ বারে তফাতটা যে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জবাসীদের নাছোড়বান্দা মনোভাবই গড়ে দিল, তা নয়— তাঁদের সমবেত লড়াইয়ের রণকৌশলটিও কাজে দিয়েছে। কূটনীতির পরিচিত, রাশভারী পথটি ধরতে নারাজ তারা, আন্তর্জাতিক আইনে এনেছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের হৃদয়ের ওম। জাতিপুঞ্জের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গেলে হোউনিউহি-র মাথায় সব সময় শোভিত থাকত রোরোডারা (উৎসবে পরার ঝিনুক বসানো শিরোভূষণ)। তাঁর দল আদালত চত্বর নাচ-গানে মুখরিত করে তুলত। শুনানিগুলিকে জমকালো অনুষ্ঠান রূপেই উদ্যাপন করা হত।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপবাসীরা সমুদ্র ও প্রজন্ম পেরিয়ে অন্য তটরেখার দেশ, সব বয়সের মানুষকে নিয়ে জোট গড়ে তোলে। এক সঙ্গে কাজ করেন ভ্যানুয়াটুর তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী র্যালফ রিজেনভানু, ক্যারিবিয়ান সাগরের বন্ধুরাষ্ট্রগুলি এবং সারা পৃথিবীর তরুণ পরিবেশকর্মীরা। কিছু দেশ তো আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করতে থাকে। আইসিজে-র বিচারপ্রক্রিয়াই যেন একটা আন্দোলন হয়ে ওঠে।
আইসিজে-র এই রায় একেবারে মোক্ষম সময়ে এল। এখন অন্যান্য আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তেও একই সুর। সমুদ্রবিষয়ক আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিচারসভা সদ্য নিশ্চিত করেছে, রাষ্ট্রগুলিকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ফলে সৃষ্ট সমুদ্র দূষণ রোধ করতে হবে। আন্তঃ-আমেরিকা মানবাধিকার আদালত জলবায়ু সম্পর্কিত বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে মতপ্রকাশের সময় স্বাস্থ্যকর জলবায়ুর অধিকারকে মানবাধিকার রূপেই মান্যতা দিয়েছে। আফ্রিকার মানুষ ও জনতার অধিকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা চলছে আদালতে।
আইসিজে-র রায় মানতে কোনও দেশ দায়বদ্ধ নয়। কিন্তু তা বলে সেই রায় কোনও ভাবেই গুরুত্বহীনও নয়। তার গুরুত্ব আইন প্রয়োগের বাধ্যবাধকতায় নয়, বরং প্রশ্নটিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসায়, তার বিস্তারে। আইসিজে-র এই রায় বৈশ্বিক স্তরে বিভিন্ন আদালত, আইন প্রণেতা এবং পরিবেশকর্মীদের সামনে কিছু নিয়মনীতিকে স্পষ্ট করেছে। আন্তর্দেশীয় মামলার ক্ষেত্রেও এই রায়ের গুরুত্ব অনুভূত হবে। অতএব, ইতিমধ্যেই আশা জন্মেছে, ইটালির তেল সংস্থার বিরুদ্ধে গ্রিনপিস সংগঠনের মামলার মতো ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতে হয়তো কোনও দেশ অন্য কোনও দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আদালতে নিয়ে যেতে পারে।
এ বার সত্যিই একটি বৈশ্বিক আইনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আমি কোনও ‘আন্তর্জাতিক সরকার’-এর কথা বলছি না; বরং একটি সুনির্দিষ্ট আইনি পদ্ধতির কথা বলছি। আইনতাত্ত্বিক এইচ এল এ হার্ট যেমন বলেছিলেন, বৈশ্বিক বিচারব্যবস্থা জুড়ে স্বীকৃত ‘প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়মের মেলবন্ধন’। পরিবেশ আইন বলতে এত দিন ছিল মূলত কিছু ভাল ভাল কথার সমাহার, বাধ্যবাধকতাহীন কিছু শপথ— সেই কথার খেলার দিন পেরিয়ে সম্ভবত তৈরি হতে চলেছে একটি বলিষ্ঠ ব্যবস্থা।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের সেই ছাত্রদের অর্থ ও প্রতিপত্তিতে ঘাটতি ছিল, কিন্তু সেই অভাব পূরণ করেছে তাঁদের দৃঢ় প্রত্যয়। স্বল্প বাজেটে কাজ করেছেন, ভিসার বাধার মুখোমুখি হয়েছেন; তাঁদের বার বার বলা হয়েছে যে, এই প্রচার অভিযানের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তবু তাঁরা এগোতে থেকেছেন, প্রমাণ করেছেন যে, প্রান্তিক অবস্থান থেকেও ক্রান্তি আনা যায়, যা শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনকেও বদলাতে বাধ্য করে।
“আমরা ওখানে ছিলাম। আর আমাদের কথা শোনা হয়েছে!” মতামত প্রকাশের পর হোউনিউহি-র গলায় ছিল বিস্ময়ের সুর। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জবাসী ও যুব সমাজ— এই দুই গোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের প্রতিনিধি রূপেই এ কথা বলেন তিনি। প্রান্তিক গোষ্ঠীরা নিজেদের কথা উজাড় করে বলল, আর সর্বোচ্চ আদালত মন দিয়ে শুনলও। হয়তো এখনও ত্রুটি রয়ে গিয়েছে, এগোচ্ছেও ঢিমে-তালে— তবু আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা এখনও মজুত।
(প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট)
ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)