E-Paper

প্রকৃত মূল্যায়ন হয়েছে কি

১৯৪০-এর টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্বের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইলা। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আবহে সেই অলিম্পিক্স হয়নি। তখন তিনি বছর পনেরোর কিশোরী। ইচ্ছা করলে এই পারফরমেন্স আরও দশ বছর ধরে রাখতেই পারতেন।

পৌলমী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:০৪

জনপ্রতিনিধি হয়ে জনসেবার তাড়নায় ‘তারা’রা আলোকবর্ষ দূর থেকে ছুটে আসেন, বা তাঁদের জবরদস্তি টেনে আনা হয় রাজনীতিতে। দেশ জুড়ে এখন বহু সফল ব্যক্তিত্ব অবসরের পর রাজনীতির মাঠে নেমেছেন। এ দৃশ্য তো দেখাই যায়। বরং বৈচিত্রে আগ্রহ বাড়ে। এখানেই ব্যতিক্রম ইলা মিত্র (ছবি)। আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসে, আজীবন মানুষের কাজ করেছেন।

১৯৪০-এর টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্বের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইলা। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আবহে সেই অলিম্পিক্স হয়নি। তখন তিনি বছর পনেরোর কিশোরী। ইচ্ছা করলে এই পারফরমেন্স আরও দশ বছর ধরে রাখতেই পারতেন। কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রের আন্তর্জাতিক অভিলাষ ত্যাগ করেছিলেন সামাজিক কাজের স্পৃহায়। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই যুক্ত হন বামপন্থা সূত্রে, দশের কাজে। সক্রিয় ছিলেন হিন্দুত্বের, উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে। বিয়ে হয় সে কালের তৎকালীন মালদহের রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার পরিবারে, জীবনসঙ্গী রমেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন সমদর্শী। শুরু হয় এই বঙ্গনারীর ভিন্ন এক জীবনকাহিনি— রাজনৈতিক পদমর্যাদা, সাংবিধানিক ক্ষমতা অতিক্রম করেও যেখানে তিনি চির নীতিনিষ্ঠ সমাজকর্মী।

১৯৪৯-এ নাচোলের কৃষক বিদ্রোহে নিহত পুলিশের পক্ষে মামলা রুজু করা হয়। সেই বয়ানে, ইলা মিত্র নাচোলের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী, শোষিত পীড়িত সাঁওতাল কৃষকদের বিপ্লবী ‘রানিমা’। ১৯৪২-এ গ্রামবাংলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব তেমন না থাকলেও, নেমে আসে মন্বন্তর। আর্থ-সামাজিক দুর্দশায় হাবুডুবু খাওয়া দরিদ্র মানুষ তখন বয়ে বেড়াচ্ছেন খিদের জ্বালা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্পষ্টতর হচ্ছে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। চরম মাত্রায় পৌঁছয় কৃষক শোষণ। তিন ভাগ ফসলের দুই ভাগের দাবিতে সঙ্ঘবদ্ধ হন নিঃস্ব কৃষকেরা। ১৯৪৬-৪৭ সালে দিনাজপুরকে কেন্দ্র করে বাংলায় আছড়ে পড়ে তেভাগা আন্দোলন। রামচন্দ্রপুর হাটের কৃষক সমাজের সামগ্রিক দায়িত্ব পড়ে রমেন্দ্রনাথের উপর। সেই সূত্রেই ইলা সরাসরি যুক্ত হন তেভাগা আন্দোলনে। গ্রামবাংলায় হিন্দু-মুসলমান-জনজাতির একত্র আন্দোলনের পাশাপাশি ও-দিকে কলকাতাও উত্তাল হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। ইলা মিত্র পৌঁছে যান নোয়াখালির দাঙ্গাধ্বস্ত অঞ্চলে, সেবা ও পুনর্বাসনের কাজে।

দেশভাগ, স্বাধীনতার পর মিত্র পরিবারের জমিদারি পূর্ববঙ্গের রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনের দাপট কমেনি। ১৯৫০-এর ৫ জানুয়ারি, পুলিশ ও কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তার জেরে ক্রাউন সৈন্য ও পুলিশের অত্যাচারে স্তব্ধ হয়ে যায় নাচোলের জনজীবন। ভিটেছাড়া হয় বহু পরিবার। গ্রেফতার হন ইলা। এটুকু তো আন্দোলনের চেনা পরিণতি, কিন্তু অচেনা ছিল তাঁর উপরে হওয়া অত্যাচার। নৃশংসতার এই চোরাস্রোত আসলে ছিলই, ইলা মিত্র শুধু বেপরোয়া ভাবে শাসকের এই নির্যাতন সকলের সামনে বেআব্রু করেছেন। রাজশাহী আদালতে তাঁর জবানবন্দি অনুসারে সেটি ছিল শাসকের অত্যাচারের বিরলতম নজির।

দীর্ঘ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাঁকে দেখতে উপচে পড়ে ছাত্র-যুব, জনতার ভিড়। এত সহমর্মিতা, পাশে থাকার আশ্বাস সত্ত্বেও কষ্ট হয়েছিল নারীত্বের আবেগ কাটিয়ে উঠতে। অমানুষিক যৌন নির্যাতনে তৈরি হওয়া মানসিক বিপর্যয় অতিক্রম করতেও সময় লেগেছিল অনেক। প্যারোলে কলকাতায় আসেন, ফিরে যাননি নাচোলে। তবে প্রতিবাদস্পৃহা স্তিমিত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সহযোগিতা করেছেন নানা ভাবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন। এর পর আপন গতিতেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠা। বিধায়ক হয়েছেন চার বার। পাশাপাশি চলেছে বৌদ্ধিক চর্চা। দক্ষতা ছিল রুশ ভাষায়, বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। হিরোশিমার মেয়ে বইটির জন্য পান ‘সোভিয়েট ল্যান্ড নেহরু’ পুরস্কার। গোলাম কুদ্দুস, সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন তাঁকে নিয়ে, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস কাঁটাতারে প্রজাপতি তাঁর সংগ্রামী জীবনের ইতিকথা। শুধু তাঁর জবানবন্দি নিয়েই রয়েছে সঙ্কলনগ্রন্থ। সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান ডায়মন্ডের চলচ্চিত্র নাচোলের রানী-তেও তাঁর বিপ্লবের কথা। জীবনের একটি অংশ শিল্পিত হয়ে আছে কবিতা উপন্যাস চলচ্চিত্রে, সংগ্রহশালায়। তবু এই বাংলায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক উপস্থাপনা বিরল।

অনগ্রসর গ্রামবাসীর শিক্ষা প্রসারেও কাজ করেছেন তিনি। পরবর্তী কালে অধ্যাপনা করেছেন সিটি কলেজে। তাঁর শিক্ষাভাবনা, ক্রীড়াদক্ষতার দিকগুলি চর্চিত নয় তত। তাঁর বিপ্লব পরিকল্পনা, নেতৃত্ব-কৌশল নিয়েও চর্চা কোথায়! কী ভাবে অগণিত অন্ন-গৃহ-শিক্ষাবঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ মানুষকে একত্র করেছিলেন, সেই বিবরণও মুছে যাচ্ছে যেন।

ইলা মিত্র জনঅভ্যুত্থানের নেত্রী ছিলেন, শাসক তাঁর নেতৃত্ব প্রতিহত করতে তাঁর নারীশরীর আক্রমণ করেছে বার বার। কিন্তু তিনি নিজের জীবনসত্যের আলোয় প্রতিষ্ঠা করেছেন নারীবাদকেও। গণপরিধিতে তিনি নির্ভীক প্রগতিশীল নারীত্বের আধুনিক প্রতীক। সে কারণেই কি শুধু তাঁর উপর হওয়া পৈশাচিক নির্যাতনের অনুপুঙ্খ বিবরণই তাঁকে নিয়ে চর্চার সার? ১৮ অক্টোবর পূর্ণ হচ্ছে তাঁর জন্মশতবর্ষ, বিকল্প সমাজবিপ্লবের অগ্রণী মানুষটিকে মনে রাখা আমাদের গুরুদায়িত্ব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Athlete Indian Athlete Protest Social worker

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy