Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Sundarbans

একের পর এক নদীর অন্তর্ধান

সুন্দরবনের নদীগুলো বেশির ভাগই খাঁড়ি। ঝিঙ্গেখালিও ব্যতিক্রম নয়। জোয়ারের সময়ে নদীগুলোতে অথৈ জল। আর ভাটার সময় নদীতে জল থাকে না। সেই সময় নদীগুলো যেন নির্জীব।

সুপ্রতিম কর্মকার
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৪:৪৪
Share: Save:

হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকে সামসের নগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝিঙ্গেখালি দুয়ানি নদী। ‘দুয়ানি’ মানে যে নদী দু’দিক দিয়ে দু’নদীর সঙ্গে যুক্ত। আবার দু’পাশ দিয়েই নদীতে জোয়ার-ভাটা খেলা করে। এক পাশে কালিন্দী ও অন্য পাশে রায়মঙ্গল নদীর সঙ্গে সংযোগ ঝিঙ্গেখালির। কালিন্দীর দিকটাতে তার নাম শকুনখালি। স্থানীয়রা বলছেন, এক সময় নদীর আশেপাশে প্রচুর শকুন দেখা যেত, তাই ওই নাম হয়েছিল। আর যে এলাকার নদীটার নাম ঝিঙ্গেখালি, সেখানে নদীটা দেখতে অনেকটা ঝিঙের মতো ছিল। স্থানীয় মানুষেরা নদীটার একটা ডাক নামও দিয়েছিল বহু দিন আগে, তা হল কুড়েখালি। এলাকার খুব পুরনো মানুষ ছাড়া ‘কুড়েখালি’ নামটা বাকিরা জানে না। মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা নদীটা খুব ভাল ভাবে বেঁচে থাকার কথা ছিল। বাস্তবে আমরা ঝিঙ্গেখালি নদীর অবস্থা কেমন দেখছি?

সুন্দরবনের নদীগুলো বেশির ভাগই খাঁড়ি। ঝিঙ্গেখালিও ব্যতিক্রম নয়। জোয়ারের সময়ে নদীগুলোতে অথৈ জল। আর ভাটার সময় নদীতে জল থাকে না। সেই সময় নদীগুলো যেন নির্জীব। এই ভাটার সময়টা ছোট নদীগুলোতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার উপযুক্ত সময়। ছোট নৌকা করে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এখনও ঝিঙ্গেখালি নদীতে মাছ ধরেন। আগে এই নদীতে প্রচুর মাছ হত। এখন অনেক কম। নদীর পাশের পারগুমটি, সামসের নগর, কালীতলা গ্রামগুলোতে মৎস্যজীবী আছেন অনেকে। নতুন প্রজন্মের মৎস্যজীবীরা অবশ্য আর গ্রামে নেই। তাঁরা আন্দামান, কেরল, বেঙ্গালুরু, দিল্লিতে, মূলত দিনমজুরের কাজ করতে যাচ্ছেন বেশি উপার্জনের আশায়। যে মৎস্যজীবীরা গ্রামে রয়েছেন, বেশির ভাগই বয়স্ক। তাঁরা কাঁকড়াই বেশি ধরছেন, তাতে পয়সা বেশি। একে নদীতে মাছ কম, আর মাছ বিক্রিতে তেমন পয়সা নেই।

প্রায় একশোটি মৎস্যজীবী পরিবারকে বামফ্রন্টের আমলে ঝিঙ্গেখালি নদীর ধারে পারগুমটিতে বসবাসের জায়গা দেওয়া হয়। এই জমি আগে ছিল নদীর চর। জমির রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে, সেই জমি ছিল রায়তি। কাজেই সেই সময় মৎস্যজীবীদের বামফ্রন্ট জোর করে বসালেও জমির পাট্টা দিতে পারেনি। তবে বামফ্রন্ট আমলের শেষের দিকে কৌশল করে ব্যক্তিমালিকানা জমির উপর পাট্টা দেয়। বর্তমান আমলে বেশ কিছু মৎস্যজীবী পরিবার সরকারি আবাস যোজনায় ঘরও পেয়েছে। তবে সেই মৎস্যজীবী পরিবারগুলিই সরকারি ঘর পেয়েছে, যারা স্থানীয় পঞ্চায়েতের খুব ঘনিষ্ঠ, এ অভিযোগ তুলছেন স্থানীয় মানুষই।

গ্রামের জমি যেমন অবৈধ ভাবে চলে যাচ্ছে কারও না কারও দখলে, তেমনই যাচ্ছে নদীর খাত। কালীতলা বাজার, সামসের নগর হাই স্কুলের কাছে, সামসের নগর ১ নম্বর স্লুইস গেট, সামসের নগর ট্রেকার স্ট্যান্ড এলাকাগুলোতে ঝিঙ্গেখালি নদীর জমি দখল করে একের পর এক গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এমনকি কয়েকটা জায়গায় বাড়ি ঘরও। নদীর জমি কী ভাবে দখল হচ্ছে? প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার দীর্ঘ ঝিঙ্গেখালি নদীটা এই সব এলাকায় কিছুটা সঙ্কীর্ণ। কাজেই জলের পরিমাণ নদীতে কম থাকে। ফাঁকা জায়গা দেখে রাতারাতি কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। স্থানীয় পঞ্চায়েত কী করছে? এলাকার পরিবেশ কর্মীরা আঙুল তুলছেন পঞ্চায়েতের দিকেই। তাঁরা জানাচ্ছেন, নানা রকম আর্থিক দুর্নীতিকে আশ্রয় করে পঞ্চায়েত নদীর জমির উপর দোকানপাট ও বাড়িঘর গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। ব্যাঙের ছাতার মতো নদীর বুকে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন নির্মাণ।

ঝিঙ্গেখালি ব্যতিক্রম নয়। এমন ভাবেই হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের স্রোতস্বিনী নদী— ঘুমটী, নোনাভুঁই। সুন্দরবনের ভিতর ছোট নদীগুলোর দু’পারের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর জমি দখল করে তৈরি হচ্ছে বাড়ি ঘর দোকান প্রভৃতি। কাজেই নদীগুলো ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠছে। কোস্টাল রেগুলেশনের জোন নোটিফিকেশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদীর পারে তৈরি হচ্ছে অবৈধ নির্মাণ। বাংলার কত নদী মারা যাচ্ছে প্রতি দিন, কেউ তার হিসাব রাখে না।

শুধু আইন করে নদীকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। নদীকে বাঁচাতে গেলে দরকার স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ বাড়ানো, নাগরিকের প্রতি পঞ্চায়েতের দায়বদ্ধতা অনেক বাড়াতে হবে। নদী-নির্ভর মানুষগুলি ছাড়া, ছোট নদীর স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে সুন্দরবনের বেশির ভাগ মানুষ বড় উদাসীন। তা ছাড়াও পঞ্চায়েতে দুর্নীতি কমানোর জন্য বিধিসম্মত সব রকমের নজরদারি চাই, বিশেষত সোশ্যাল অডিটের উপর আরও বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন। যাতে অবাধে নদীর খাতে নির্মাণ না চলতে পারে। এ সবই হবে বাদাবনের ছোট নদীগুলিকে বাঁচানোর প্রথম ধাপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sundarbans Illegal Construction
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE