E-Paper

গর্ব এবং সুবিধাবাদ

প্রশ্নটা মধ্যবিত্তের স্ববিরোধলাঞ্ছিত মনঃপরিসরেই তৈরি হচ্ছে কেন, তার কারণ আছে। এই পরিসরটাতেই তৈরি হয় বিশ্বাস, যা ক্রমে বৃহত্তর জনসমাজে পৌঁছে যেতে থাকে।

শুভময় মৈত্র

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:২৯

মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কাছে বামপন্থী হওয়ার যেমন গর্ব আছে, তেমনই দক্ষিণপন্থী হওয়ার সুবিধাও আছে। এই দ্বিমুখী সম্পর্কের কথা বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বিলক্ষণ জানে। ফলে, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই যে কোনও প্রশ্নের অবস্থানে থেকে যায় এক গোত্রের যৌক্তিক স্ববিরোধ— ভাবনার মধ্যে থেকে যায় এক ধরনের ফাঁক। রাজনীতি এবং সমাজনীতি যে-হেতু অঙ্ক নয়, তাই সেখানে কিছু প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। ফলে, সেই স্ববিরোধের পরিসরে ঘটতে থাকে অনেক কিছুই। যেমন, তৈরি হয় সংশয়: আর জি কর-কাণ্ডকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল যে প্রতিরোধ, তার কি কোনও রেশই অবশিষ্ট নেই? সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ছয়ে-ছয়ের মতো ‘২০২৬-এ আড়াইশো’-র স্লোগানও কি মিলে যাবে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে?

প্রশ্নটা মধ্যবিত্তের স্ববিরোধলাঞ্ছিত মনঃপরিসরেই তৈরি হচ্ছে কেন, তার কারণ আছে। এই পরিসরটাতেই তৈরি হয় বিশ্বাস, যা ক্রমে বৃহত্তর জনসমাজে পৌঁছে যেতে থাকে। ঠিক যেমন ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই বিশ্বাস শহুরে বুদ্ধিজীবীরা গোটা বাংলায় পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন যে, তদানীন্তন বামফ্রন্টের চলে যাওয়ার সময় এসেছে। ঘটেছিল তেমনই। এ বার তেমন আবেগ কোথায়?

তৃণমূল কংগ্রেস যদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তা হলেই কি প্রমাণ হবে যে, নাগরিক আন্দোলনের সবটুকু ভুল? যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের কি একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে, তৃণমূল ক্ষমতা থেকে সরে যাক? কলকাতা শহরের যে সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্‌-মুহূর্তে রাতমিছিলে হেঁটেছিলেন, তাঁদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ভুল বুঝিয়ে বা সমাজমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ডেকে এনেছিল? সবটাই হুজুগ? আমার মতো অনেকেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্টো কথা বলে। যে দিন প্রথম রাত দখলের ডাক দেওয়া হয়েছিল, সেই ১৪ অগস্ট বাড়ি ফেরার পথে রাত এগারোটায় বাড়ির তিন কিলোমিটার দূরে নেমে পড়তে হয়। সিঁথির মোড় থেকে উত্তরে তিন কিলোমিটার রাস্তায় যে মানুষের ঢল, তা অবশ্যই ব্রিগেড জনসামাবেশের মাপের। গোটা রাস্তায় বাড়ি ফেরার জন্যে হাঁটতে হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের উল্টো স্রোতে। দেখে মনে হয়নি যে, মচ্ছবের আঁচ পোহাতে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। বেশির ভাগ চোয়াল শক্তই ছিল।

সেই আঁধারেও যাঁরা পথ খুঁজে নিতে পথে নেমেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই প্রশ্ন ছিল যে, টেলিভিশনের পর্দায় সান্ধ্যকালীন রাজনীতি আলোচনাতে আরও অনেক উচ্চকণ্ঠে, আরও অনেক দৃঢ়তার সঙ্গে ন্যায় বিচারের ডাক পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না কেন? বড় জোর এক-দু’জন সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস বা তার নেতৃত্বের জড়িত থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অথবা তৃণমূল কবে হারবে সেই ভাবনা ভেবেছেন। এই প্রশ্ন উঠছিল, কারণ সাধারণ মানুষ যতই পথে হাঁটুন, রাজ্যের রাজনৈতিক ‘ন্যারেটিভ’ নির্ধারিত হয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণির দ্বারা। সেই কারণেই, সে শ্রেণির অবস্থানগত চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।

সে প্রশ্নের গুরুত্ব কতখানি, বোঝা গেল কয়েক দিনের মধ্যেই। বিষয় ঘুরে গেল এই জায়গায় যে, আন্দোলনের কোনও রাজনৈতিক প্রভাব পড়ছে না— তৃণমূল আবার জিতবে। এবং সত্যিই তারা উপনির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতল। তৃণমূল-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনের অসহায়তায় পুলকিত হলেন। কোন ডাক্তারের কোথায় ব্যক্তিগত স্তরে কী ভুলত্রুটি আছে, শুরু হল সেই আলোচনা। এর মধ্যে সিবিআই-এর তদন্ত নিয়ে একগাদা প্রশ্ন। একই সময়কালে রাজ্যে আরও বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনা সামনে এল। বুদ্ধিজীবীরা বুঝিয়ে দিলেন যে, সেগুলোতে কম সময়ে সঠিক বিচার হয়েছে রাজ্য সরকারেরই বদান্যতায়। অর্থাৎ, বিজেপির তোতাপাখি সিবিআই অকৃতকার্য, আর রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী সফল।

সিপিআইএম আর কংগ্রেস স্বভাবতই ‘বিজেপি-তৃণমূল সেটিং’-তত্ত্ব আওড়াল। কিন্তু তাদের বন্ধু বুদ্ধিজীবীরা কিছুতেই বললেন না দু’টি কথা— এক, এই সেটিং তত্ত্ব মেনে নিয়েও রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তৃণমূল এবং বিজেপি; এবং দুই, গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে, এমনকি ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই একই ধারার সেটিং সিপিএম আর কংগ্রেসের মধ্যে ছিল। সে আমলের বুদ্ধিজীবীরাও বিলক্ষণ বুঝতেন বামপন্থী হওয়ার গৌরব, এবং দক্ষিণপন্থী হওয়ার সুবিধার কথা।

তবে, ফারাকও ছিল। বাম আমলে রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়টি যথেষ্ট গোলমেলে ছিল, স্বজনপোষণ ছিল কিছু ক্ষেত্রে, ফলে সাধারণ মানের কিছু ধামাধরা বুদ্ধিজীবী ছিলেন— কিন্তু সেখানে নগদনারায়ণের দাপট কম ছিল। অর্থাৎ কোনও একটি কমিটির সদস্য হলেই সাম্মানিক, কিংবা অন্য কোনও ভাবে আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আনুগত্য কেনার বিষয়টি আজকের দিনে ক্রমবর্ধমান। একে এখন আর ঠিক দুর্নীতির পর্যায়ে ফেলা যায় কি না, সে নিয়ে তর্ক হতেই পারে। তবে তৃণমূলের প্রতি আনুগত্যে রাজনৈতিক ভাবনার গুরুত্ব তুলনায় কম বলেই নিন্দুকদের ধারণা।

এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বামফ্রন্টের ভূমিসংস্কারের সঙ্গে তুলনা করা যায় তৃণমূলের মানুষের হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্পগুলিকে। এর ভাল-খারাপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু চাষির নিজের চাষের জমি পাওয়া, কিংবা শ্রমিকের দিনের শেষে ঘামের বিনিময়ে মেলা রোজ সুনিশ্চিত হওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ সে ভাবে হাতে কাজ না থাকার সময় অভাবী মানুষের হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়া। কিন্তু তৃণমূলের সেই বামপন্থী কাজের গর্ব তৃণমূলের দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নকে সমর্থন করা সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী ভাগ করে নিলে তা ততটা প্রশংসনীয় নয়।

অর্থাৎ, অভয়ার মৃত্যুতে নাগরিক আন্দোলন সত্ত্বেও যদি তৃণমূলের জনসমর্থন বজায় থাকে, তা থেকে কোনও বুদ্ধিজীবী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন যে, রাষ্ট্রশক্তি এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু তাঁকে দেখতে হবে, এতে কোনও ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের সংঘাত জড়িয়ে আছে কি না। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে যে, এই জায়গায় বামের গর্ব এবং দক্ষিণের বিশেষাধিকার দু’টিই তিনি ভোগ করছেন কি না, যার কোনটাই তাঁর অর্জিত নয়, বরং সুবিধাভোগের।

রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলছেন, এই সমস্যা তাঁদের ক্ষেত্রেও অনুপস্থিত নয়। অভয়া হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার একটি বিশেষ ঘটনা, কিন্তু তার সঙ্গে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দাবি তুলতে গেলে নাগরিক আন্দোলনের বিশেষ লাভ হয় না। ব্যবস্থার পরিবর্তন রাজনীতির লড়াই। দীর্ঘ বাম রাজত্বে এখানে চিকিৎসাব্যবস্থা যে পথে চলেছে, এবং তার পর তৃণমূলের সময় যে পথে চলছে, তার মধ্যে একাধিক মিল এবং অমিল আছে। সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন অরাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের পক্ষে অর্জন করা আপাতত কঠিন। যুব চিকিৎসকেরা এমনিতেই বিজেপি বা কংগ্রেসকে ভাগিয়ে দিয়েছেন, একটু দূরে থেকে সিপিএম আছে। তবে সিপিএম নেতৃত্ব সাধারণ ভাবে রাজ্য বা দেশে ক্ষমতায় থাকার তুলনায় নিজেদের আঞ্চলিক কমিটিতে চেয়ার ধরে রাখায় বেশি উদ্‌গ্রীব। ফলে এই আন্দোলনের যে বাম চেহারা, সেটাকে শুধুমাত্র গর্ব হিসাবেই ব্যবহার করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনও দিশা সেখানে নেই।

উল্টো দিকে, তৃণমূল একটানা চেষ্টা করছে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা মুখগুলির ব্যক্তিচরিত্র কাটাছেঁড়া করতে। সেখানে প্রশ্ন উঠছে বিজ্ঞাপনী সংস্থার আন্দোলন পরিচালনা নিয়ে, প্রশ্ন উঠছে কোন অ্যাকাউন্টে কত টাকা ঢুকছে তাই নিয়ে, কে কী ভাবে কোন ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসা করছেন তাই নিয়ে। অর্থাৎ আন্দোলনের মুখগুলি দক্ষিণপন্থী সুবিধা কতটা পাচ্ছেন, তা নিয়ে কৌশলগত ভাবেই প্রশ্ন তুলছে তৃণমূল। সে প্রশ্নগুলোও কিন্তু সম্পূর্ণ
উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বাম ‘বনাম’ দক্ষিণ-এর ভেদাভেদ মুছে এ বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা ‘এবং’-কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন, বললে খুব ভুল হবে কি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

R G Kar Medical College

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy