E-Paper

তাপ থেকে বাঁচার অধিকার

তাপপ্রবাহ চলাকালীন সবচেয়ে ঝুঁকি শ্রমিকদেরই, কারণ তাঁদের কর্মস্থল খোলা আকাশের নীচে। আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন নিশ্চিত করেছে শ্রমিকদের জন্য পানীয় জল, ছায়া ও বিশ্রাম। গরমে তাঁদের সুস্থ থাকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

রুমি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ ০৪:৩৩
Share
Save

গরমে নাস্তানাবুদ গোটা বিশ্ব। যে ইউরোপে বছর কুড়ি আগেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেশির ভাগ অঞ্চলেই ৩০ ডিগ্রির আশপাশে থাকত, এখন প্রায়ই তা ৪০ ডিগ্রি পেরোচ্ছে। ২০২১-এ গ্রিস, ইটালির তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল! এটাই নতুন স্বাভাবিক। তাপপ্রবাহকে জলবায়ু পরিবর্তনের অঙ্গ বলে মেনে নিয়ে বিশ্বের বিবিধ শহর তাপ মোকাবিলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে।

সেই প্রস্তুতির একটি দিক, শ্রমিকদের জন্য চিন্তাভাবনা। তাপপ্রবাহ চলাকালীন সবচেয়ে ঝুঁকি শ্রমিকদেরই, কারণ তাঁদের কর্মস্থল খোলা আকাশের নীচে। আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন নিশ্চিত করেছে শ্রমিকদের জন্য পানীয় জল, ছায়া ও বিশ্রাম। গরমে তাঁদের সুস্থ থাকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ফ্রান্সে ‘প্ল্যান ক্যানিকুলে’ আবহাওয়া অনুযায়ী কাজের সময় পরিবর্তন করতে বলেছে। তাপপ্রবাহ চলাকালীন পাবলিক বিল্ডিং সাধারণের আশ্রয়ের জন্য খুলে দিতে বলেছে। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো বহু দিন দাবদাহের মোকাবিলায় অভিজ্ঞ। সেখানে সরকারি নিয়ম, গ্রীষ্মের দু’মাস দুপুর বারোটা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে অবধি কোনও শ্রমিক বাইরে কাজ করবেন না। শ্রমিকদের দেওয়া হয় বিশেষ ধরনের তাপ-নিরোধক পোশাক।

ভারত এখনও তাপপ্রবাহ ও শ্রমিকের সুস্থতার উপায় সার্বিক ভাবে বিবেচনা করে উঠতে পারেনি। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, চার জন ভারতীয় শ্রমিকের তিন জনই খোলা আকাশের নীচে কাজ করেন। সংখ্যাটা প্রায় ৩০ কোটি। প্রতি বছর তাপপ্রবাহে বহু শ্রমিক অসুস্থ হয়ে কাজ হারান, মারা যান। তাতে সরকারের তেমন হেলদোল নেই। তাপ এড়াতে সরকার পরামর্শ দিচ্ছে দুপুরে বাইরে না বেরোতে। স্কুলগুলোতে বাড়তি ছুটি দিচ্ছে। এই সব ব্যবস্থা কী কাজে আসবে সাফাইকর্মী, রিকশা বা ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা বা গিগ কর্মীদের? খনি, নির্মাণ শিল্প ও ইট ভাটার শ্রমিকদের কাজে উত্তাপের প্রকোপ মারাত্মক। তাঁরা হিট স্ট্রোক বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কথা ভেবে কাজ হারানোর ঝুঁকি নিতে পারেন না।

ভারতীয় অর্থনীতির একটা বড় অংশ এই অসংগঠিত শ্রমিকরা। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, গত বছর দেশ জুড়ে দাবদাহে যত শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, তাতে ভারতের জিডিপির ক্ষতি হয়েছে ৪.৫%। ২০২২-এ বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, শুধুমাত্র দাবদাহের জন্য আগামী পাঁচ বছরে তিন কোটির বেশি শ্রমিক কাজ হারাবেন। অর্থাৎ সমস্যাটা কেবল গরিব মজুরের নয়, অর্থনীতিরও। সব রাজ্যই অবশ্য নিশ্চেষ্ট নয়। ২০১০-এর দাবদাহে ১৩০০ মৃত্যুর পরে আমদাবাদ শ্রমিকদের জন্য প্রথম ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে। কাজের সময় পরিবর্তনের মতো সহজ কয়েকটি নিয়ম চালু করে তাপজনিত মৃত্যু কমানো গিয়েছে। ওড়িশাও নিষিদ্ধ করেছে উষ্ণতম সময়ে শ্রমিকদের বাইরে কাজ। কিন্তু সমগ্র দেশের শ্রমিকদের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কোথায়? এ বছর এপ্রিলে দিল্লিতে সরকার হাসপাতালগুলোতে তাপপ্রবাহে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ওয়র্ড চালুর কথা বলেছে। রাজধানীতে ৮০ শতাংশ শ্রমিকই রাস্তায় কাজ করেন। গিগ বাহকরা ঘরে ঘরে ঠান্ডা পানীয় পৌঁছে দেন। চোখে পড়ে নীতিতে সংহতির অভাবও। শ্রম, পরিবশে, বা স্বাস্থ্য মন্ত্রক পৃথক ভাবে কিছু নীতি নিয়েছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবে সুনির্দিষ্ট কোনও নিয়ম-নির্দেশিকা না থাকায় সে সব নীতি শ্রমিককে সুরক্ষা দিতে পারে না।

গত গ্রীষ্মেই তানজ়ানিয়াতে বসেছিল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যার বিষয় ছিল জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জনবসতি-ভিত্তিক উপায়ের সন্ধান (ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কমিউনিটি-বেসড অ্যাডাপটেশন টু ক্লাইমেট)। জানা গিয়েছিল নানা দেশের উদ্যোগের কথা। কোথাও জনবসতির মধ্যে এক টুকরো জমিতে গাছ লাগিয়ে তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা চলছে। শস্য বাঁচাতে তৈরি হয়েছে সৌরশক্তি চালিত কোল্ড স্টোরেজ। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে কেউ ফিরিয়ে এনেছে আলু সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি। কোথাও গরিব মানুষের পানীয় জলের সুরক্ষায় চালু হয়েছে ‘ওয়াটার এটিএম’। জ্বালানির খরচ কমাতে সোলার কুকারের ব্যবহার, জলের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে বস্ত্র উৎপাদন, এমন চল্লিশ রকমের পদক্ষেপের বাস্তব প্রয়োগে হাতেনাতে ফলও মিলছে।

ভারতেরও দরকার শহরাঞ্চলের উত্তাপ কমানোর, উত্তাপ সহনের উপায় নির্ধারণের জন্য ‘হিট প্ল্যান’। সমস্যা চিহ্নিত করতে পৌঁছতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সমস্যা ভিন্ন, সমাধানও হবে ভিন্ন। শ্রমিক ইউনিয়ন, জনকল্যাণমূলক গোষ্ঠীকে পরিকল্পনার অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। নিরাপদ কাজের সময় নির্দিষ্ট করতে হবে, তাপপ্রবাহ চলাকালীন গিগ-কর্মীকে বাধ্য করা যাবে না পথে নামতে। দরকারে অতি-উত্তাপের সময় সবেতন ছুটির বন্দোবস্ত করতে হবে। তাপদাহে অসুস্থদের জন্য আপৎকালীন চিকিৎসার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও অত্যন্ত জরুরি। তার জন্য প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। খোলা বাজারে ছাদ, বা ছায়াযুক্ত চলার পথ নির্মাণ, আশ্রয়স্থল চিহ্নিত করতে হবে। সর্বোপরি, শ্রমিকের শীতল পরিবেশ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। তীব্র গরমে বিশ্রাম ও জল শ্রমিকের জন্য বিলাসিতা নয়, তাঁর মৌলিক অধিকার। তা অগ্রাহ্য করলে তাপদাহে ক্ষতির পরিমাণ মাপতে হবে প্রাণ দিয়ে, অর্থ দিয়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Heatwave Alert Summer Season Indian Labours

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।