Advertisement
E-Paper

বিকল্প স্বাস্থ্যনীতির দাবি জরুরি

স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা ক্রমশ পিছচ্ছি।

বিষাণ বসু

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২১ ০৪:৩০

অতিমারির মৃত্যুমিছিল, শয্যাসঙ্কট, অক্সিজেনের অভাব, টিকার অমিল, ক্ষোভ-হাহাকার— সব কিছুর মধ্যেই বিকল্প স্বাস্থ্যনীতির আলোচনা জারি রাখাটা আমাদের দায়িত্ব। স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য’-এর দাবিতে অধিকাংশই কান দেননি। মিলটন ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, সঙ্কটকালে রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাড়লেও, সেই সিদ্ধান্ত বাজারে চালু ধারণার ভিত্তিতেই নেওয়া হয়। কিন্তু, ‘সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য’, ‘প্রতিটি নাগরিকের সুস্থতার দায় রাষ্ট্রের’— ধারণাগুলো বাজারে চালু নয়। কাজেই, অতিমারির সঙ্কট ও তার মোকাবিলায় বর্তমান মডেলের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুরবস্থা— কোনওটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে বিকল্প নীতির দাবি জোর গলায় উঠছে না।

আগামী কয়েক বছরে জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছনোর সম্ভাবনা আমাদের, ২০৩০ নাগাদ তৃতীয় সর্বোচ্চ আর্থিক শক্তিধর হয়ে ওঠারও কথা! কিন্তু, স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা ক্রমশ পিছচ্ছি। অনাহারক্লিষ্ট মানুষ, অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায় আফ্রিকার হতদরিদ্র দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি। জনসংখ্যা বাড়লে অনাহার-অপুষ্টিতে আক্রান্ত, অসুস্থতাও বাড়বে।

অর্থনীতির বর্তমান মডেলে অবশ্য বিশ্বের সর্বাধিক অনাহারক্লিষ্ট শিশু নিয়ে বিশ্ব-অর্থনীতির অন্যতম ‘প্রধান শক্তি’ হওয়া যায়। স্বাস্থ্য সূচকে তলানিতে থাকা দেশের পক্ষে স্বাস্থ্য পর্যটনের কেন্দ্র হওয়া, পাঁচতারা হাসপাতালে বিশ্বমানের চিকিৎসার বন্দোবস্তও সম্ভব। তেমনটাই চলে দেশে। আমরাও মেনেছি নির্বিবাদে। কারণ, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা লাটে উঠলেও পাঁচতারা হাসপাতাল উন্নত চিকিৎসা দিয়েছে। স্বাস্থ্যবিমা থাকায় চিকিৎসার আকাশছোঁয়া খরচও মেনে নিয়েছি। আস্ত একখানা অতিমারিও কি এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ভ্রান্তি নিয়ে ভাবাবে না?

দেশে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি করতে জিডিপির অন্তত ৫% দরকার। উন্নত দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ তার চাইতে ঢের বেশি। আপাতত আমাদের লক্ষ্য জিডিপির ২.৫%। গত বছরগুলিতে সেই বরাদ্দটা ১-১.৫%-এ ঘুরেছে। জল বা শৌচালয়ের বাজেট, রেলে নারী-সুরক্ষার খাতে বরাদ্দকেও জুড়ে স্বাস্থ্যবাজেটকে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। তাতেও ২.৫%-এর ধারেকাছে নেই।

তারও সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি? স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বরাদ্দ অর্থ খরচের বিষয়ে দু’টি দিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘এফিশিয়েন্সি’ অর্থাৎ কুশলতা, এবং ‘একুইটি’ অর্থাৎ সমতা। দু’টি সম্পর্কহীন নয়। সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি মানুষকে কী ভাবে সুস্থতার দিশা দেখানো যায়, তা-ই স্বাস্থ্যব্যবস্থার কুুশলতার সূচক। কিন্তু বরাদ্দের সিংহভাগই যায় উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার খাতে। সরকারি হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপন যত চমকপ্রদ, অপুষ্টিতে ভোগা গ্রামের মেয়েটির সাদা স্রাবের চিকিৎসা ততটা নয়। অথচ একটি অঙ্গ প্রতিস্থাপনে যা খরচ, তাতে দ্বিতীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেককে সারিয়ে তোলা যায়। যত জনের অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন, সাদা স্রাবের রোগী তার বহু গুণ। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পগুলির সমস্যাটা সেখানেই। ১০০০ পরিবারকে পাঁচতারা হাসপাতালে পাঁচলাখি চিকিৎসা দিলে তাঁরা অবশ্যই উপকৃত হন। কিন্তু ওই পঞ্চাশ কোটিতে সরকারি স্বাস্থ্যকাঠামোর উন্নয়ন হলে উপকৃত হতেন আরও অনেকে। জনস্বাস্থ্য ও প্রতিরোধক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় উপযুক্ত অর্থ ব্যয় হলে কুশলতা আরও বেশি। খরচ কমবে, দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবেন বেশি মানুষ।

সমতার নীতির প্রসঙ্গে আসি। গরিবদের অসুস্থতার সম্ভাবনা বেশি, তাই ব্যয়ের সিংহভাগ তাঁদের জন্যই হওয়ার কথা। অথচ, দেশের মডেল বিপ্রতীপ। এখানে বিশেষজ্ঞ নির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হয় প্রাথমিক পরিষেবাকে অবহেলার মূল্যে। গরিবেরা রক্তাল্পতা, কৃমি, জ্বরের চিকিৎসা নাগালে পেতে সমস্যায়; কিন্তু বিনামূল্যে বাইপাস সার্জারির বন্দোবস্ত শহরে মজুত! রায়গঞ্জের রোগী বিনামূল্যে রেডিয়োথেরাপি নিতে কলকাতায় দেড় মাস মাথা গোঁজার খরচ জোটাচ্ছেন জমি বেচে!

লক্ষাধিক মানুষ চিকিৎসা করাতে গিয়ে দারিদ্র‍সীমার নীচে নেমে যান প্রতি বছর। দেশে চিকিৎসাখাতে মোট খরচের দুই-তৃতীয়াংশই নাগরিকদের পকেটের, অনেকটাই ওষুধ কেনার পিছনে। রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সায় ওষুধ, ন্যায্য মূল্যের দোকান, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প কিছুটা সুরাহা দিলেও সমাধান হয়নি। চিকিৎসকেরা ওষুধের বর্গীয় নামে প্রেসক্রিপশন লিখলেও দোকানি পছন্দের ব্র্যান্ডের ওষুধ দেন। ক্রেতার চাইতে বিক্রেতারই লাভ। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ওষুধ তৈরির সরকারি কারখানাগুলো প্রায় লাটে। সরকারের হাতে ওষুধ তৈরির ক্ষমতা নেই। ওষুধের দাম বেঁধে দিতে গেলে প্রস্তুতকারীরা একজোটে জরুরি ওষুধ তৈরি না করার ভয় দেখাচ্ছেন। ফার্মা লবির চাপে, দাম বাঁধা হয় ‘মার্কেট অ্যাভারেজ’ বা বাজারের গড় নীতিতে। অর্থাৎ, চারটি কোম্পানি যদি ১০০ টাকায় ওষুধ বিক্রি করে, একটি কোম্পানি দাম হাঁকে ১০০০, সরকার গড় দাম বাঁধবে ১৪০০/৫, বা ২৮০ টাকার ভিত্তিতে। প্রথম চারটি কোম্পানির ওষুধের দাম বাড়বে তিন গুণ।

অতিমারি থামবে, কিন্তু বর্তমান মডেলের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্কট রয়ে যাবে। শুরুতেই বলা হয়েছে, সঙ্কট ছাড়া বিকল্পের কথা কেউ ভাবে না। নিজেদের স্বার্থেই বিকল্প স্বাস্থ্যনীতির দাবিটা আমাদের তুলতে হবে। সেই দাবি তোলার সময় এখনই।

COVID-19 coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy