E-Paper

‘নষ্টের গোড়া নারীবাদ’

ট্রাম্পের আশপাশে এক দল মহিলা থাকেন, তাঁরা কেবলই বলেন, রক্ষণশীল নারীবাদ কত ভাল ছিল, মেয়ে-পুরুষের প্রভেদ মেনে নিয়ে মহিলাদের দুঃখ ঘোচানোর কথা বলতেন!

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:০৮

বাইফোকাল চশমাটা নাকের উপরে ঠেলে তুলে ট্রেনের রড থেকে ঝোলা হরেক মালের সম্ভার থেকে বেছে বেছে চুলের ক্লাচ দেখছিলেন বিভাদি। শিয়ালদহ সাউথ লাইনের ট্রেনে নিত্যপসারিণী এই বয়স্কা মহিলাও আমাদের খুব চেনা। মাথার ক্লিপ, কানের দুল, টিপের পাতা, চুলের গার্ডার, চিরুনির রকমারি পসরা তাঁর কাছে। দাম দশ থেকে কুড়ি টাকার মধ্যে। বিভাদি এ সব ব্যাপারে ভারী খু্তখুঁতে। যত দেখছেন, ইসমত তত অস্থির হয়ে উঠছে। বেশ ভাল একখানা আলোচনা হচ্ছিল আমাদের। এর মধ্যে হঠাৎ কেনাকাটা শুরু হওয়ায় তা থমকে গেছে। অবশেষে একটা ক্লিপ বেছে দাম মিটিয়ে বিভাদি বললেন, “দিদি যখন প্রথম বেরোলেন হকারি করতে, লোকের কাছে কথা শুনতে হয়েছিল?” দিদি বললেন, “তা আর হয়নি! ঘরে-বাইরে অনেক কথাই উঠেছিল। তবে আমার কারবার তো লেডিজ় কম্পার্টমেন্টেই!” দিদি এগিয়ে যেতে ইসমত বলল, “লেডিজ় কম্পার্টমেন্টে কাজ করায় বাধা কম বলতে চাইলেন বোধ হয়।”

রুমা মুচকি হেসে বলল, “ভাগ্যিস তোর হেলেন অ্যান্ড্রুজ আর লিয়া লিব্রেস্কো সার্জেন্ট এখানকার লোকাল ট্রেনে ওঠে না!”

এই নিয়েই আলোচনা চলছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক পডকাস্টে হাজির হয়ে আমেরিকার রক্ষণশীল রাজনীতির পরিচিত মুখ হেলেন আর লিয়া বললেন, কর্মক্ষেত্রের বারোটা বাজাচ্ছে উদারপন্থী নারীবাদ। নিউ ইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছিল, ‘আর উইমেন রুইনিং দ্য ওয়ার্কপ্লেস?’ অর্থাৎ, মেয়েরা কি কর্মক্ষেত্রের বারোটা বাজাচ্ছে? এমন সাড়ে-সর্বনেশে হেডিং দেখে দুনিয়া জুড়ে ছিছিক্কার পড়ে যায়। অবশেষে শিরোনামটি বদলে করা হয় ‘লিবারাল ফেমিনিজ়ম বা উদারপন্থী নারীবাদ কি কর্মক্ষেত্রের সর্বনাশ করছে?’

রুমা জানতে চাইল, এই কথার যুক্তি কী? আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, সমাজতত্ত্বের গবেষক ইসমত বলল, “যুক্তি না ছাই! আমাদের টিভি চ্যানেলে বসা পুরুষ অধিকারকর্মীদের— যাদের আমি সংক্ষেপে বলি ‘পুঅক’— মতো হেলেন বলেছেন, মেয়েলি বদ স্বভাবে কাজের জায়গা নষ্ট হচ্ছে। মেয়েরা গসিপবাজ, পরনিন্দা পরচর্চা ভালবাসে, চটজলদি কঠিন সিদ্ধান্ত বা ঝুঁকি নিতে পারার মতো পুরুষালি গুণ তাদের নেই।” বিভাদি ইসমতের কথার খেই ধরে বললেন, “শিরোনাম বদলে বোঝানো হল, যত নষ্টের গোড়া ওই উদারপন্থী নারীবাদ।”

রুমা বলল, “কী বোকা বোকা! উদারপন্থী নারীবাদের সঙ্গে রক্ষণশীল নারীবাদের লড়াই বাধিয়ে দিয়ে মজা দেখবে।”

ট্রেনটা এত লেট করছে, ব্রেকফাস্ট হজম হয়ে গিয়ে খিদে পাচ্ছে। ব্যাগ থেকে একটা বাদামের প্যাকেট বার করে ছিঁড়লাম। কয়েকটা বাইরে ছিটকে পড়ল। বিভাদি বিরক্ত হয়ে তাকালেন। সেই অগ্নিদৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বাদাম চিবোতে চিবোতে আমি বললাম, “রক্ষণশীল নারীবাদ যেন বলে মেয়েরা কূটকচালি করে আর ছেলেরা সব নির্বাণপ্রাপ্ত সন্নিসি। রুমার বিকেসির মতো।”

বিকেসি রুমার বস। লোকের হাঁড়ির খবর বার করে তাদের উত্ত্যক্ত করা, ঠারেঠোরে মেয়েদের কুপ্রস্তাব দেওয়া— কোনও গুণেই ঘাট নেই তাঁর। রুমা বলল, “ভাগ্যিস আমাদের ‘পুঅক’-রা অত ওয়াকিবহাল নয়। আমেরিকান খবরের কাগজ অবধি ওদের দৌড় নয়। নইলে ওদের কী রকম পোয়াবারো হত ভাবো! যে কোনও বিতর্কে এক জন বিদেশির উদাহরণ দেখিয়ে দিতে পারলেই তো লোকে ভাবে কেল্লাফতে।”

আমি ফোড়ন কাটি, “ফেলুদা যেমন এরিখ ভন ড্যানিকেনের বই দেখিয়ে ভাবায়, গ্রহান্তরের মানুষেরা এসে মানুষকে প্রযুক্তি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কি না। আর একটু পড়াশোনা করলে আমাদের ‘পুঅক’-দের বোকা কথাগুলোও কেমন মান্যতা পেয়ে যেত।”

দু’হাত দিয়ে চুল টেনে জড়ো করে নতুন কেনা ক্লাচটা লাগাতে লাগাতে বিভাদি বললেন, “উঁহু, সবাইকে বোকা ভাবার বোকামিটি কোরো না খবরদার। দুনিয়া জুড়ে যুক্তি বুদ্ধি ঘেঁটে দেওয়ার এই খেলাটা কিন্তু খুব বুদ্ধিমান লোকেরাই শুরু করেছেন। লক্ষ করেছ কি না জানি না, ট্রাম্পের আশপাশে এক দল মহিলা থাকেন, তাঁরা কেবলই বলতে থাকেন, আহা রক্ষণশীল নারীবাদ কত ভাল ছিল! মেয়ে-পুরুষের প্রভেদ মেনে নিয়ে মহিলাদের দুঃখ ঘোচানোর কথা বলতেন। তুমি তাঁদের নারীবিদ্বেষী বলে এক কথায় বাতিল করে দিতে পারবে না। তাঁরাও তত্ত্বের নামে নানা রকম হাবিজাবি জিনিস বাজারে ফেরি করতে থাকবেন।”

ইসমত বলে, “অরুন্ধতী রায়ের ‘থেফ্ট অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ মনে পড়ে যাচ্ছে।”

বিভাদি ঘাড় নেড়ে বলেন, “অরুন্ধতীর মতে, স্বাধীনতা স্বক্ষমতা এই শব্দগুলোকে হাইজ্যাক করে এখন উল্টো অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।” বিভাদির কথা শেষ না হতেই রুমা বলল, “মানেগুলো উল্টে দিলে সহজেই বোঝানো যায় যে, ক্ষমতাশালীরা আসলে কত দুর্বল। তাই তো শুনি ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’, দেখি গজিয়ে উঠছে বিপন্ন ব্রাহ্মণ সমিতি, নিপীড়িত পুরুষ সঙ্ঘ।” রুমার কথায় ধরতাই দিয়ে বলি, “আহা বেচারা পুরুষেরা। সাদা মনে কাদা নেই। দিব্যি বুদ্ধি খাটিয়ে ঝু্ঁকি নিয়ে কাজ করত। মেয়েগুলো ঢুকে গল্পগুজব কূটকচালি করে খেলো কথায় পরিবেশটাকে বিষিয়ে দিল।”

ইসমত বলল, “দিদি, শুধু কূটকচালি না। ওদের আর একটা যুক্তি হল, উদারপন্থী নারীবাদ সবাইকে এত ‘ওয়োক’ করে দিয়েছে যে, ব্যবসাপত্তর লাটে উঠছে।” মনে পড়ল, এই ‘ওয়োক’ শব্দটাক একটা জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দকোষে আছে— ‘সজাগর’। বিদ্বেষদীর্ণ পৃথিবীতে নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে অতিমাত্রায় যাঁরা সচেতন, তাঁরাই সজাগর। আধুনিক কালে কথায় কথায় এই সজাগরদের তুলোধনা করার চল দেখা দিয়েছে দুনিয়া জুড়েই।

আমি কিছু বলার আগেই রুমা বলে ওঠে, “আহা! আমেরিকান সিরিজ়গুলো দেখলেই বোঝা যায়, ওদের অফিসের পরিবেশ কত উওক।” বিভাদি চোখ টিপে বলেন, “তোমার বিপিনকুমার চক্রবর্তীর মতোই সব লোক জন।”

বিপিনকুমার চক্রবর্তী বা বিকেসি-র উল্লেখে আমরা সবাই মুখ টিপে হাসি। একটা কলেজে বটানি পড়ায় সুচরিতা। আমাদের আড্ডায় মাঝে মাঝে যোগ দেয়। এত ক্ষণ পরীক্ষার খাতা দেখছিল। আমাদের কথাও শুনছিল ফাঁকে ফাঁকে। বলল, “এই বিপিন কুমার লোকটা কে গো? কথা উঠলেই তোমরা হাসাহাসি করো!”

আমি বলি, “দেখেছ তো, কেমন মেয়েলি স্বভাব! গসিপের গন্ধ পেয়েই উতলা হয়ে উঠেছে।”

রুমা বলে, “বিপিনবাবু আমার বস। লিঙ্গসাম্য নিয়ে এত কথা বলি আমরা, একটা কথাও আর বলতে হবে না ওঁকে ভাল করে জানলে।” নিজের মনেই একটু মিটমিট করে হাসল রুমা। তার পর বলল, “দিনকয়েক আগে একটা মেয়ে ইন্টারভিউ দিল আমাদের অফিসে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তাকে কম্পিউটার বা এঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে একটাও প্রশ্ন করেনি বিকেসি। প্রথমেই বলেছে, ‘সিভি-তে তো লেখোনি, তুমি বিবাহিত কি না’!”

“শুরুতেই ‘তুমি’!” মুখ ভেটকে বলল সুচরিতা।

“উনি বয়সে ছোট মেয়েদের আপনি বলতে পারেন না। মেয়েটা বলল, বিয়ের কথাটা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ভেবে লিখিনি। তাতে বিকেসি বললেন, ওটাই তো আসল। মেয়েটি জানাল, সে বিবাহিত। বস তখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখনই পরিবার শুরু করার ইচ্ছা আছে নাকি?’ ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, বাংলায় এ সব কথা ঠিক বলা যায় না তো!”

অস্থির হয়ে উঠে রুমা বলে, “বোঝো! কান কটকট করে কি না, জুতোর মাপ কী, এ সব জেনে কী করবেন উনি?”

বিভাদি মুখ খোলেন, “লোকটাকে বোকা ভাবাই তোমার মস্ত বোকামি, বুঝলে রুমা। পৃথিবী জুড়ে বহু কাল ধরেই চাকরি দেওয়ার সময় এই তথ্যটি চায় মালিকপক্ষ। গর্ভকালীন সুবিধা দেওয়ার ভয়ে বিবাহিত মহিলাদের নিতে চায় না বহু কোম্পানি।”

ইসমত বলে, “তাই অনেক নারীবাদী পিরিয়ড লিভ সমর্থন করেন না। বাড়তি ছুটি দিতে হবে ভেবে মেয়েদের আর চাকরিই দেবেন না মালিকরা।”

বিভাদি ইসমতের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “পঁয়তাল্লিশ বছর আগে মণিকুন্তলা সেন বারোমাস পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, প্রথম দিকে অনেক কর্মক্ষেত্রেই নিয়ম ছিল যে, মেয়েদের চিরকুমারী থাকতে হবে। বিয়ে করলেও নামের আগে মিস লিখতে হবে। ডাক্তাররা তাই নার্সদের মিস বলে ডাকতেন। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকাদেরও তাই। মণিকুন্তলার মতে, এর কারণ আর কিছুই না, প্রসূতি ভাতা ফাঁকি দেওয়া।”

ট্রেন শিয়ালদহে ঢুকছে। আমরা উঠে দরজার সামনে দাঁড়াই। বিভাদি আমাকে বলেন, “ভাল কথা। লিলি বলে একটা সিনেমা রিলিজ করেছিল, ২০২৪-এ। কোনও ওটিটিতে পাচ্ছি না। দেখো তো পাও কি না।” নানা রকম সাইট থেকে সিনেমা ডাউনলোড করায় আমার প্রসিদ্ধি আছে। এই সিনেমাটার কথা আমিও শুনেছি। লিলি লেডবেটারের জীবনের গল্প। সেই লিলি, যাঁর নামে চালু হয় আমেরিকার ‘লিলি লেডবেটার ফেয়ার পে রেস্টোরেশন অ্যাক্ট’।

শিয়ালদহে নেমে মেট্রো ধরব বলে হাঁটতে শুরু করি। নামতে অসুবিধা হয় না। এখন ট্রেনে ভিড় নেই। ভিড় হবে ফিরতি পথে। লেডিজ় কামরা মুখর করে থাকবে তখন নানা শ্রেণি, নানা অবস্থানের শ্রমিক মেয়ের ঝগড়া, গল্প, গসিপ। সে কথা মনে করে ভাবি, এ সব জানলে নতুন উত্তর-সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখা হবে: ‘আর উইমেন রুইনিং দ্য ট্র্যাভল স্পেস টু?’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Empowerment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy