E-Paper

বন্দিদেরও ভোটাধিকার থাকুক

সংশোধনাগার সার্বিক ভাবে আগের চেয়ে অনেক উন্নত। সেখানে সঠিক জীবনযাত্রার পাঠ দেওয়া হয়। ভারতে কারাগারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

আদিত্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৯

ভারতে কারাবন্দিদের ভোট দেওয়ার অধিকার নেই। এমনকি, বিচারাধীন বন্দিদেরও নয়। কে কোন ধারায় অভিযুক্ত, এ ক্ষেত্রে তা আদৌ বিবেচ্য নয়। ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন না। কারাবন্দিরা কেন আজও সংবিধানের সবচেয়ে বড় উৎসবের অংশ নন?

স্বাধীনতার পর সবেমাত্র নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। গোটা দেশে প্রথম ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সেই সময়ে জেলকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা কঠিন ছিল। নিরাপত্তা, পরিকাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার ঘাটতি ছিল প্রবল। জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১-র ৬২(৫) ধারা যোগ করে বলা হয়, কেউ জেলে বন্দি থাকলে তিনি ভোট দিতে পারবেন না। এই সাপেক্ষে আইনের যুক্তি ছিল, জেলের মতো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ভোটের গোপনীয়তা বা স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। প্রভাবশালী বন্দিরা অন্যদের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। অতীতে সামাজিক ধারণা ছিল যে, বন্দিরা সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারেন না।

এই ধারণা আজও অপরিবর্তিত। যদিও প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের দিক থেকে পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বার বার বলেছে যে, বিচারাধীন বন্দিদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া আসলে সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগরিকের সমতা ও অনুচ্ছেদ ৩২৬ অনুসারে গণতান্ত্রিক অধিকারের সমতা রক্ষার আদর্শের পরিপন্থী। সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৭ সালের একটি মামলায় এই ধারা বহাল রেখে জানিয়েছিল যে, জেলে ভোটদানের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। ফলে আজও ভারতে বিচারাধীন বন্দি ভোট দিতে পারেন না, যদিও তাঁদের প্রার্থী হতে বাধা নেই।

ভারতে ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার মূলত সংবিধান ও জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১-র মাধ্যমে নির্ধারিত। সংবিধান অনুযায়ী, কোনও নাগরিক যদি ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি হন, এবং আইনত অযোগ্য ঘোষিত না হন, তবে তিনি নির্বাচনে ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা ৮ ও ৮(ক) অনুযায়ী, কেবল দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন না। অর্থাৎ, এক জন বিচারাধীন বন্দি ভোটে দাঁড়াতে পারবেন, কারণ আইনি দৃষ্টিতে তিনি অপরাধী নন। ভারতের আইনব্যবস্থার দার্শনিক অবস্থান হল, কেউ দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধী নন, তাই তাঁর মৌলিক অধিকার রক্ষা করা হয়।

ভারতে বন্দিদের ভোটাধিকারের আইনের সংশোধন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে নানা শ্রেণির মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সরব হয়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ বার বার বলেছে যে, বিচারাধীন বন্দিদের ভোটাধিকার রোধ করা সংবিধানের সমতা এবং মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। নির্বাচনী আইন ও সংবিধান বিষয়ে গবেষকরা বলেছেন যে, আধুনিক প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রের মাধ্যমে জেলে ভোট নেওয়া সম্ভব, এবং সংশোধনের মাধ্যমে আইনটিতে থাকা দ্বৈততা দূর করা উচিত।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বারই যুক্তি এসেছে যে, প্রশাসনিক ও নিরাপত্তাজনিত কারণে জেলে থাকা ব্যক্তিদের ভোটাধিকার সীমিত রাখা যৌক্তিক। ফলে, আইনটি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতের কারাগারে মোট বন্দির সংখ্যা ছিল ৫,৩০,৩৩৩ জন। সেই রিপোর্টে উল্লেখ ছিল পশ্চিমবঙ্গের ৬০টি কারাগারে মোট বন্দির সংখ্যা ছিল ২৫,৭৭৪ জন। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। সেই ভোটে এই বন্দিরা ভোট দিতে পারবেন না। বিহারের কারাগারে মোট বন্দির সংখ্যা প্রায় ৬৪,৯১৪ জন। তাঁরাও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।

সংশোধনাগার সার্বিক ভাবে আগের চেয়ে অনেক উন্নত। সেখানে সঠিক জীবনযাত্রার পাঠ দেওয়া হয়। ভারতে কারাগারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বন্দিদের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা, মানসিক কাউন্সেলিং, জিম ও খেলাধুলার ব্যবস্থা, দক্ষতা উন্নয়ন ও হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ, পুনর্বাসনমূলক আলোচনাসভা এবং ভিডিয়ো কনফারেন্সের মতো আধুনিক প্রযুক্তি চালু হয়েছে। এ সব উদ্যোগ বন্দিদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি করছে, এবং সমাজে পুনর্বাসনে সহায়ক হচ্ছে। শুধু ভোটাধিকার দিতে আপত্তি কেন?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দিদের ভোটাধিকারের নীতি ভিন্ন। পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলি যেমন নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, এ ছাড়া কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জ়িল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বিচারাধীন বন্দিরাও ভোট দিতে পারেন। ভারতের মতো দেশে যদি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড থেকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা পরিবর্তন এত পরিকল্পনামাফিক হতে পারে, তা হলে বন্দিদের জন্য আইন কেন পরিবর্তন হতে পারে না? বহু গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত আইন যেখানে সংশোধিত বা পরিমার্জিত হয়েছে, এই আইনটির ক্ষেত্রেই বা তা করা হবে না কেন? কারাবন্দিদের মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের, সে কথা ভুললে চলবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Election Commission Election Prisoner

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy