E-Paper

সবুজ শক্তির আলো-আঁধার

বড় সংস্থাগুলিও প্রাথমিক ভাবে চায় সবুজ প্রযুক্তিতে যে সব সংস্থা বহু বছর ধরে কাজ করছে, তাদের তৈরি করে দেওয়া বাজার থেকে সরাসরি সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি কিনতে।

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৫ ০৬:৫৭

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির পর প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন এবং বায়ুমণ্ডল থেকে সে সব গ্যাসের অপসারণের চূড়ান্ত ভারসাম্য (নেট জ়িরো এমিশন) রক্ষা নিশ্চিত করা ছিল সেই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জ়িরোর লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই পৌঁছনো উচিত। সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগে ২০৩০-এর মধ্যে আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন কমানো দরকার অন্ততপক্ষে ৪৫%— এ কথাও বলা হয়েছে প্যারিস চুক্তিতে। গত বছরও বাকুতে রাষ্ট্রপুঞ্জের বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন অধিবেশনে উন্নত এবং উন্নয়নশীল সব দেশকেই মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এই লক্ষ্যের কথা।

এ লক্ষ্যে পৌঁছনো ক্রমেই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। একাধিক কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির সরকারকে ঘরে বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তেও হচ্ছে। কিন্তু যে কারণটি নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক কম, তা হল, সবুজ শক্তির বাজারে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের ক্রমহ্রাসমান উৎসাহ এবং আস্থা। একাধিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, গত দু’বছরে সবুজ শক্তিতে বিনিয়োগ কমেছে ২০ থেকে ২৫%; জলবায়ু প্রযুক্তি নিয়ে যে সংস্থাগুলির ব্যবসা, তাদের শেয়ারদরও ক্রমেই পড়ে চলেছে। এবং, সবুজ শক্তিকে মূলধন করে শুরু করা নতুন ব্যবসা— চলতি ভাষায় যাকে বলে স্টার্ট-আপ— তাতে লগ্নি হচ্ছে খুবই কম।

নেট জ়িরোর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সারা পৃথিবী জুড়ে প্রবল উত্থান নিঃসন্দেহে একটা বড় কারণ। অপ্রচলিত শক্তি নিয়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের সংশয়, কয়লা বা তেল উৎপাদনকারী শ্রমিকদের মধ্যে ভোট হারানোর আশঙ্কা, এ-হেন বিবিধ কারণে তাঁরা সবুজ শক্তিতে বিনিয়োগকারীদের অর্থনৈতিক ছাড় দিতে চান না। কিন্তু শুধু দক্ষিণপন্থী নেতারাই দোষী নন। দোষী কর্পোরেট সেক্টরও— যদি প্রবল মুনাফার বাসনাকে ‘দোষ’ বলা যায়। একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র দেখাচ্ছে যে, বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাঙ্কগুলি শেষ কিছু বছরের মতো গত বছরেও মূলত বিনিয়োগ করেছে কয়লা এবং পেট্রলিয়ামের মতো জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবসা করা সংস্থাগুলিতে। একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক— বিশ্বের ষাটটি বৃহত্তম ব্যাঙ্ক মিলে ২০২৩-এ জীবাশ্ম-জ্বালানি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে বা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মোট ৭০৫ বিলিয়ন ডলারের। অন্য দিকে, শেল বা এক্সন-এর মতো সংস্থা যে হারে তেল তুলছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। এবং বিশ্বজোড়া যুদ্ধের মাঝে সে তেলের চাহিদাও এত যে, সংস্থাগুলির মুনাফাও এক কথায় অভূতপূর্ব।

কিন্তু শুধু তেল নয়। সিংহভাগ বেসরকারি বিনিয়োগ যন্ত্রমেধা-মুখী। আমাদের সমাজকে আমূল বদলে ফেলার যে প্রতিশ্রুতি যন্ত্রমেধা দিচ্ছে, তার মধ্যে অফুরন্ত মুনাফার সম্ভাবনা দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। গুগল, মাইক্রোসফ্ট বা ওপেনএআই জাতীয় সংস্থাগুলি প্রতি তিন-চার মাসে নতুন পণ্য ও পরিষেবা নিয়ে আসছে,ফলে বিনিয়োগকারীরা সংস্থাগুলির কাছে যাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠছেন। উল্টো দিকে, সবুজ প্রযুক্তিকে ঠিক ভাবে দাঁড় করানোর জন্য দরকার পাঁচ থেকে দশ বছর সময়। স্বাভাবিক ভাবেই, বিনিয়োগকারীদের সেই প্রযুক্তিতে লগ্নি করার বিশেষ উৎসাহ নেই। বৈদ্যুতিক গাড়িই হোক বা হাওয়া থেকে কার্বন অপসারণ, সবুজ প্রযুক্তিতে শুরুর বিনিয়োগের অঙ্কটি যথেষ্ট বড়। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের বিনিয়োগকারীরা তো বটেই, আমেরিকা বা চিনেও তাই সবুজ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে লগ্নিকারীরা বহু বার ভাবেন। যদিও টেসলা বা চিনের বিওয়াইডি-র মতো বৈদ্যুতিক গাড়ির নির্মাতাদের অসাধারণ সাফল্য দেখায় প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ বাজারে জবরদস্ত চাহিদা তৈরি করতে পারে।

তবে অল্প আশার আলো আসছে ওই গুগল-ফেসবুকের হাতে ধরেই। অত্যাধুনিক যন্ত্রমেধা তৈরি করার জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার, তা জীবাশ্ম-জ্বালানি থেকে পাওয়া অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এবং বিবিধ আর্থরাজনৈতিক কারণে এই প্রচলিত জ্বালানির জোগানও মাঝে মাঝেই অপ্রতুল হয়ে পড়ছে। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে এখন বিদ্যুতের জন্য নিজেদের উদ্যোগে পারমাণবিক চুল্লি বসাতে হচ্ছে। এবং একই সঙ্গে তারা বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে সবুজ শক্তিতেও। তাই শুনতে অদ্ভুত ঠেকলেও, যন্ত্রমেধার সাফল্য একই সঙ্গে অভিশাপ ও আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে সবুজ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।

তবে বড় সংস্থাগুলিও প্রাথমিক ভাবে চায় সবুজ প্রযুক্তিতে যে সব সংস্থা বহু বছর ধরে কাজ করছে, তাদের তৈরি করে দেওয়া বাজার থেকে সরাসরি সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি কিনতে। নিজেরা আগ বাড়িয়ে সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির পরিকাঠামো তৈরি করতে চাইছে না। যে কারণে ডেনমার্কের মতো সবুজ প্রযুক্তিতে উদ্যমী দেশকেও এ বছরের শুরুতেই বায়ুশক্তি বিক্রির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত নিলাম বন্ধ রাখতে হয়েছে, কারণ উত্তর সাগরে নতুন উইন্ডমিল বানানোর জন্য কোনও সংস্থাই আগ্রহ দেখায়নি। আমেরিকা বা চিনের তুলনায় ইউরোপের দেশগুলি সবুজ শক্তি নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হলেও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে তাদের ভাঁড়ারে এ মুহূর্তে বিস্তর টান। তাই সরকারি অপারগতা আর বেসরকারি অনাগ্রহের দরুন সবুজ শক্তি ক্ষেত্রটিতে বেশ খানিক দোলাচল তৈরি হয়েছে, অথচ আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেও সবুজ শক্তির ভবিষ্যৎ যথেষ্ট উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।

সবুজ শক্তির বিনিয়োগে এই যে দোলাচল, তা অর্থনীতির ভাষায় একটা নেগেটিভ মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট তৈরি করতে পারে, কারণ বহু ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, আজকের বিনিয়োগে যত দেরি হবে,নীতিনির্ধারকরা তাঁদের নীতিগুলিও ততই বদলাতে শুরু করবেন। যেমন, সৌরশক্তিতে একটি জোরদার বাজার তৈরি হওয়ার আগেই ‘নেট জ়িরো’তে পৌঁছনোর তাগিদে হাইড্রোজেন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের কথা শুরু হয়েছিল; হাইড্রোজেন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা বাজারে এসে পৌঁছতে পারল না, কিন্তু এখন কথা চলছে এমন প্রযুক্তি নিয়ে, যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণ করবে। তাই আজকের বিনিয়োগে যে বিঘ্ন ঘটছে, তা এমন একটা অবিশ্বাসের জন্ম দেবে, যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তির বিনিয়োগকেও রীতিমতো প্রভাবিত করবে। প্রযুক্তি থাকবে, কিন্তু তা নেহাতই এক স্থবির চেহারায়। যার দরুন বাজারে চাহিদাও তৈরি হবে না, জন্ম নেবে অর্থনৈতিক অপচক্র।

বাজার তৈরি না হওয়ার এই যে আশঙ্কা, এর ফলে আর্থিক ভাবে শক্তিশালী সংস্থাগুলি ছোট স্টার্ট-আপ অধিগ্রহণেও ভয় পাচ্ছে। যে কারণে নতুন উদ্ভাবনী চিন্তাগুলির সবই পড়ে থাকছে গবেষণাগারে— কদাচিৎ তা বাজার এসে পৌঁছচ্ছে। সৌরশক্তি বা বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো কয়েকটি উদাহরণ বাদ দিলে এমন কোনও শক্তিশালী গল্পও তৈরি হচ্ছে না, যা একটি নতুন সংস্থাকে চট করে শেয়ার বাজারের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরবে। যন্ত্রমেধা বা ফিনটেক-এর বাজারে কিন্তু এ সমস্যা নেই। ফলে ঘুরে ফিরে লগ্নিকারীদের সিংহভাগ পুঁজি যাচ্ছে এই ক্ষেত্রগুলিতেই, সবুজ প্রযুক্তির ভাগ্যে রয়ে যাচ্ছে ছিটেফোঁটা।

আশার কথা খুব কিছু না থাকলেও এই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার চিন্তাভাবনা তো চালিয়ে যেতেই হবে। আলোচিত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, সবুজ শক্তির ক্ষেত্রে সরকারকে বাদ দিয়ে কোনও রকম সাফল্যই আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু গোটা পৃথিবী যেখানে সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে, সেখানে সবুজ শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দরকার একাধিক সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা, সেটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো কাঠামোতেও ঘটতে পারে অথবা ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে। দরকার গ্রিন ওয়েলথ ফান্ড, যেখানে রাজস্ব উদ্বৃত্ত এবং সরকারি বন্ড একই সঙ্গে ব্যবহৃত হবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য। বাজার তৈরির জন্য হয়তো প্রথাগত ব্যবসায়িক মডেল থেকেও সরে আসা দরকার— সোলার প্যানেল হোক বা বৈদ্যুতিক গাড়ি, সাবস্ক্রিপশন মডেল নিয়ে ভাবা যেতেই পারে।

ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Environment Right Wing Activist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy