E-Paper

শক্তিও বটে, চ্যালেঞ্জও

কেন নিজেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন বলে দাবি করা আরএসএস একটি রাজনৈতিক দল বিজেপিতে তাঁর নিয়োগ করা দূতকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে বসিয়ে রাখে?

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৬
শক্তিমান: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত, দিল্লি, ২৬ এপ্রিল।

শক্তিমান: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত, দিল্লি, ২৬ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই।

আরএসএস-এর তাত্ত্বিক নেতা ও প্রথম মুখপাত্র মাধব গোবিন্দ বৈদ্যকে এক বার প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে কেন আরএসএস-এর নিযুক্ত ব্যক্তি কাজ করেন? বৈদ্য স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ইস লিয়ে কি পার্টি ঠিক ঢং সে চলে’। অর্থাৎ, যাতে ভারতীয় জনতা পার্টি সঠিক ভাবে চলে। বিজেপির প্রথম অবতার ভারতীয় জনসঙ্ঘকে ‘ঠিকমতো’ চালানোর জন্যও আরএসএস-এর নেতারা একই ভাবে কাজ করতেন। দীনদয়াল উপাধ্যায় জনসঙ্ঘে প্রথম এই ভূমিকায় কাজ করেছিলেন।

কেন নিজেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন বলে দাবি করা আরএসএস একটি রাজনৈতিক দল বিজেপিতে তাঁর নিয়োগ করা দূতকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে বসিয়ে রাখে?

কারণ আরএসএস প্রতি মুহূর্তে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের কাছে নিজের চিন্তাধারা পৌঁছে দিতে চায়। সেই চিন্তাধারা মেনেই যাতে বিজেপি চলে, তা নিশ্চিত করতে চায়। অতীতে কুশাভাও ঠাকরে, সঞ্জয় জোশী থেকে রাম লালের মতো নেতারা সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক বি এল সন্তোষ আরএসএস-এর নিযুক্ত বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে সেই দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়াও আরএসএস-এর হয়ে বিজেপির সঙ্গে দৌত্যের কাজ করেন সঙ্ঘের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অরুণ কুমার। আরএসএস শীর্ষনেতৃত্বের মতে, এই দু’জনের কেউই আরএসএস-এর চিন্তাধারা নরেন্দ্র মোদীর কাছে ঠিক মতো পৌঁছে দিতে পারেননি। পড়ুন, চাপিয়ে দিতে পারেননি।

আরএসএস আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর একশো বছরে পা দিতে চলেছে। শতবর্ষ উদ্‌যাপনে আরএসএস-এর লক্ষ্য, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া। বিশেষত তরুণ সম্প্রদায় বা যুব সমাজের মধ্যে প্রভাব ছড়িয়ে দিতে চল্লিশ বছরের কমবয়সি স্বয়ংসেবকদের প্রশিক্ষণে জোর দিচ্ছে আরএসএস। তবে শতবর্ষে আরএসএস-এর আসল চ্যালেঞ্জ অবশ্য বিজেপিকে ‘সঠিক ভাবে’ অর্থাৎ আরএসএস-এর চিন্তানুযায়ী চালানো। তাই এ বার বিজেপির জাতীয় সভাপতি পদে একেবারে ‘নিজের লোক’ বসাতে চায় আরএসএস, যিনি নরেন্দ্র মোদীর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে থাকবেন না। যেমনটা গত ২০১৪ থেকে বিজেপি সভাপতি হিসাবে প্রথমে অমিত শাহ, তার পরে জে পি নড্ডা মোদীর নিয়ন্ত্রণে থেকেছেন। আরএসএস চাইছে, নতুন বিজেপি সভাপতি ‘স্বাধীন ভাবে’ কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রেও ‘স্বাধীন ভাবে’-র অর্থ হল, আরএসএস-এর চিন্তাধারা অনুযায়ী কাজ করবেন। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের প্রবল প্রতাপের সামনে দাঁড়িয়ে তা করে ওঠাটাই শতবর্ষে আরএসএস নেতৃত্বের সামনে আসল পরীক্ষা।

জগৎপ্রকাশ নড্ডা বিজেপি সভাপতি হয়েছিলেন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে। তাঁর তিন বছরের মেয়াদ আড়াই বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছে। আর ছয় মাস গেলে আরও তিন বছরের মেয়াদ শেষ করে ফেলবেন নড্ডা। কিন্তু বিজেপির পরবর্তী সভাপতি কে হবেন, তা এখনও ঠিক করা যায়নি। কারণ এ নিয়ে বিজেপি ও আরএসএস-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব মেটেনি। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, কর্নাটকের মতো রাজ্যেও বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদে নিয়োগ একই কারণে আটকে রয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপি সভাপতি নিয়োগ থেকে স্পষ্ট, আরএসএস এ বার তার পুরনো আস্থাভাজনদেরই বিজেপির সংগঠনের গুরুদায়িত্বে দেখতে চাইছে।

নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপির কাজের ধারা নিয়ে আরএসএস-এর কোথায় সমস্যা হচ্ছে? আরএসএস মনে করছে, বিজেপি নির্বাচনে জিততে জিততে বেশি রকম মোদী-নির্ভর, অর্থাৎ ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদী যে আরএসএস-এর কর্মসূচি রূপায়ণ করে চলেছেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু সংগঠনের থেকে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠলে আগামী দিনে কংগ্রেস বা বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মতোই বিজেপির দশা হবে বলে আরএসএসের মত। আরএসএস যখন সেপ্টেম্বরে শতবর্ষে পা দেবে, ঠিক তার কয়েক দিন আগেই নরেন্দ্র মোদী পঁচাত্তরে পা দেবেন। তাঁর নিজেরই তৈরি প্রথা অনুযায়ী মোদী পঁচাত্তরে অবসর নেবেন কি না, এ নিয়ে জল্পনা চলছে। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে মেনে নিয়েছেন, মোদী না থাকলে বিজেপির পক্ষে লোকসভা নির্বাচনে দেড়শো আসন জেতাও কঠিন।

আরএসএস নিজেও এই মুহূর্তে শুধু বিজেপি সভাপতি পদে নিজের পছন্দের লোক চাইছে। প্রধানমন্ত্রী পদে বদল চাইছে না। কারণ দেশের রাজনীতিতে মোদী এখনও আরএসএস-এর সেরা বাজি। আরএসএস প্রচারক হিসাবে মোদী দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আরএসএস-এর নাম উচ্চারণ না করেও তিনি সঙ্ঘের মতাদর্শ যে ভাবে সহজ ভাষায় দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তা আরএসএস একশো বছরে পেরেছে কি? গত এক দশকের মোদী জমানায় আরএসএস যে ভাবে সমাজের সর্বত্র শিকড় ছড়িয়েছে, ইতিহাসের পাঠ্যক্রম বদলে দিতে পেরেছে, আমজনতার মনে উগ্র হিন্দুত্বের বীজ বপন করতে পেরেছে, সেটাই তার প্রমাণ। বিহারের নভেম্বরে ভোট, তার পর আগামী বছরে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল, তামিলনাড়ুতে ভোটের আগে মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হবে, এটা ভাবা কঠিন।

তা বলে কি বিজেপি তার জন্মদাত্রী আরএসএস-কেই অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারে? বিজেপির প্রতিষ্ঠার পরে অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণীর নিজস্ব জনপ্রিয়তা থাকলেও তাঁরা বিজেপিতে স্বশাসন চাননি। কারণ আরএসএস-এর ক্যাডার বাহিনী ও সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনের প্রয়োজন তাঁরা জানতেন। আডবাণীর রথযাত্রা ও রামমন্দির আন্দোলনে সঙ্ঘ পরিবারই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল।

আরএসএস যে বিজেপিকে কতখানি নিয়ন্ত্রণ করে, তা নিয়ে এক সময় লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেছিলেন, “আরএসএস-এর এক রকম নৈতিক কর্তৃত্ব রয়েছে, যা বিজেপির পক্ষে স্বাস্থ্যকর বলে আমার বিশ্বাস।” এই আডবাণীকেই আরএসএস যখন বিজেপির সভাপতির পদ থেকে কার্যত বরখাস্ত করে, তখন তিনি আরএসএস-বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক চেয়েছিলেন। পত্রপাঠ সেই দাবি খারিজ করে দিয়েছিলেন আরএসএস-এর তৎকালীন মুখপাত্র রাম মাধব।

লালকৃষ্ণ আডবাণীর রাজনৈতিক কেরিয়ারে আরএসএস-ই দাঁড়ি টেনে দিয়েছিল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণা করা হোক, তা আডবাণী কোনও ভাবেই চাননি। তাঁর দাবি ছিল, মোদীকে লোকসভা ভোটের প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে ঘোষণা করা হলেও যেন স্পষ্ট করে দেওয়া হয়, তিনি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নন। কিন্তু সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নতুন প্রজন্মের হাতে বিজেপির নেতৃত্ব তুলে দেওয়া উচিত। দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হল তখনই, আডবাণী বিজেপির মার্গদর্শকমণ্ডলীতে যেতে চলেছেন।

মোদী-শাহের জমানায় আরএসএস-এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলেছিলেন বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই এক সাক্ষাৎকারে। শীর্ষ স্তরের এই আত্মবিশ্বাস দেখে নিচুতলার বিজেপি নেতারা আরএসএস-এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার ফল ভুগেছিল। চারশো পারের স্বপ্ন থেকে বিজেপি এক ধাক্কায় দু’শো চল্লিশ আসনে নেমে গিয়েছিল। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত একাধিক বক্তৃতায় বিজেপি নেতৃত্বকে ‘ঔদ্ধত্য’-র কথা মনে করিয়ে দেন। ভুল শুধরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় বিজেপি নেতারা বিধানসভা নির্বাচনে ফের আরএসএস-এর শরণাপন্ন হয়ে বৈতরণি পার হন।

কিছু দিন আগেই দিল্লিতে গোটা দেশের আরএসএস-এর প্রান্ত প্রচারকদের সম্মেলনে অপারেশন সিঁদুর-এর প্রভাব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, অপারেশন সিঁদুর-এর যখন সলতে পাকানো চলছে, ঠিক সেই সময় মোহন ভাগবত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়েছিলেন। ঠিক তার পরের দিনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা জাতগণনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এর আগে নরেন্দ্র মোদী খোদ নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতর ঘুরে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এই প্রথম। স্পষ্টতই, আরএসএস এখন বিজেপি ও মোদী সরকারের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লুকোছাপা করছে না। সঙ্ঘ এখন খোলাখুলি নিজের সংগঠনের বিস্তারের কথা বলছে। রাজ্যে রাজ্যে স্বয়ংসেবকদের প্রশিক্ষণ, সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়, নতুন প্রজন্মকে টেনে আনার লক্ষ্য নিচ্ছে।

আরএসএস-এর প্রবীণ নেতারা রসিকতার ছলে মনে করান, সঙ্ঘের বয়স একশো, বিজেপির বয়স সবে ৪৫। কাজেই বিজেপিকে টিকে থাকতে হলে সঙ্ঘের মতাদর্শ সংগঠন অনুশাসনের পথেই ভরসা রাখতে হবে। আরএসএস তাই এই মুহূর্তে বিজেপির কাছে যেমন শক্তি, তেমনই চ্যালেঞ্জ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP RSS Mohan Bhagwat PM Narendra Modi Amit Shah

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy