উল্লাস: শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়ার পর ঢাকায় প্রতিবাদীদের জমায়েত। ৫ অগস্ট, ২০২৪। ছবি: পিটিআই।
বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলি কি খুবই আকস্মিক, খুবই অভূতপূর্ব? আমার অন্যতম প্রিয় এবং বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম লেখক হুমায়ূন আহমেদ তিন দশক আগে প্রকাশিত হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম উপন্যাসে লিখছেন, “ঢাকার মেয়র হানিফ সাহেব করেছেন জনতার মঞ্চ।... খালেদা জিয়া তৈরী করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চ।... দুটি মঞ্চ থেকেই দাবি করা হচ্ছে— আমরা ভারতবিরোধী। ভারতবিরোধিতা আমাদের রাজনীতির একটি চালিকাশক্তি হিসেবে উঠে আসছে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের স্বাধীনতার জন্য তাদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই কারণে কি আমরা কোন হীনম্মন্যতায় ভুগছি?... আমাদের সারা দেশে অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ আছে— যেসব ভারতীয় সৈন্য আমাদের স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছেন তাঁদের জন্য আমরা কিন্তু কোন স্মৃতিস্তম্ভ করিনি। কেন করিনি? করলে কি আমরা জাতি হিসাবে আমরা ছোট হয়ে যাব?” এই ভারতবিরোধিতা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কথা। ভারতবিরোধিতা মানে পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা, ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদী চিন্তার বিরোধিতা। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু ভারতবিরোধিতার স্রোত বাংলাদেশের ধমনীতে চিরপ্রবহমান। সেখানে ২২ শতাংশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হয়েছে ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের মুখ আমি দেখিয়াছি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি মিথ্যাকে প্রথমেই দূর করা আবশ্যক যে, বাংলা ভাষার লড়াই বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। ১৯৫৪-র ৭ মে পাকিস্তান সংসদ পঞ্জাবি, পশতু, সিন্ধি, বালোচি ভাষাকে অগ্রাহ্য করে মেনে নেয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি, ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে। টাকা, ডাকটিকিট থেকে সব সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই বাংলা স্থান পায়। ভাষা আন্দোলন সেখানেই শেষ। বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে ছিল ১৯৭০-এর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ছ’দফা দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের বিপুল জয়। এই দাবির প্রথম দফার প্রথম বাক্যই ছিল “ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে।” ছ’দফা দাবির সবই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত, কেবল শেষ দাবিটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য (ভারতের আক্রমণ থেকে) সশস্ত্র বাহিনী গঠনের দাবি। এতে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি বা ধর্ম নিরপেক্ষতার কোনও কথাই ছিল না।
চাকরির সংরক্ষণ বা কোটা নিয়ে বাংলাদেশে ছাত্র-আন্দোলন নতুন নয়। ২০১৩ সালে প্রথম আন্দোলনে বিশেষ কিছু না হলেও ২০১৮-র ছাত্র-আন্দোলন ছিল এ-রকমই ব্যাপক এবং অনেকটাই সফল। এই আন্দোলনে সংঘর্ষে অনেকে আহত হলেও কোনও মৃত্যু ঘটেনি। হাসিনা সরকার কোটা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু এ বছর জুন মাসে ঢাকা হাই কোর্ট কোটা বন্ধের প্রস্তাব খারিজ করে, ফলে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। এই অবস্থায় ১৫ জুলাই শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ৩০ জুলাই পর্যন্ত এই আন্দোলনে মৃত্যু হয়েছে দুই শতাধিক, যার মূল দায়িত্ব হাসিনা সরকারের। ১ অগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ছাত্রদের দাবি মেনে সংরক্ষণ প্রায় পুরোটাই প্রত্যাহার করে। আন্দোলন জয়ী হল কিন্তু নতুন আন্দোলন শুরু হল, তার একটাই দাবি— সরকারের পতন। এই আন্দোলন কাদের? কাদের পরিকল্পনায়? ৫ অগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও সরকারের পতন। পরবর্তী সময়ে যখন সরকার অনুপস্থিত, আরও কয়েকশো লোক প্রাণ হারালেন কেন? আর এই আন্দোলনে প্রথম থেকেই আক্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায়, তাদের ধর্মস্থান এবং নারী। এখন বিএনপি জামায়াতে জোটের প্রত্যাবর্তন স্বাভাবিক।
কোন বিদেশি চক্রান্তে এ-সব ঘটছে সেই অনুমানে মাথা না ঘামিয়ে এটা স্বীকার করা দরকার যে আজকের বাংলাদেশের অরাজক অবস্থার অন্যতম কারণ শেখ হাসিনার গত পনেরো বছরের অগণতান্ত্রিক শাসন। এর জন্য শেখ হাসিনাকে একা দোষারোপ করা ঠিক হবে না। অগণতান্ত্রিক এই মনোভাব পাকিস্তানেরই উত্তরাধিকার। বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর ১৯৭৩-এর মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এই বিপুল জয়ের দুই বছরের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে দেশে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন এবং একমাত্র শাসক দল বাকশাল বা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। অগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের শুরু শেখ মুজিবের হাত ধরেই। এর কয়েক মাস পরেই, ১৫ অগস্ট মুজিব হত্যা, তার পরে বার বার সামরিক অভ্যুত্থান এবং সামরিক তত্ত্বাবধানে নির্বাচন। ফলে সামরিক প্রভাব মুক্ত নির্বাচনের জন্য ১৯৯০ সালে গঠিত হল অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এর পরিচালনায় ১৯৯১ সালে জেতে বিএনপি, ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ, ২০০১-এ বিএনপি, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দেশের ধরনেই মোটামুটি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে সরকার পরিবর্তিত হচ্ছিল বাংলাদেশে, জনসাধারণের রায়ে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টি বাতিল করে দেয়। এর পর ২০১৪, ২০১৮ এবং সদ্য হয়ে যাওয়া ২০২৪-এর নির্বাচন, সবই ছিল আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত ভুয়ো নির্বাচন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ত্রিশ বছরই কেটেছে অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে ভারতের মাথা ঘামানোর কি বিশেষ দরকার আছে? ধনসম্পদে প্রযুক্তিতে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চিনে গণতন্ত্রের নামগন্ধ নেই গত সাত দশক ধরে। কিন্তু তাতে বিশ্বের দরবারে সে কিছুমাত্র ব্রাত্য নয়। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যই প্রধান কথা, সীমান্তবর্তী দেশ বলে নিরাপত্তার ব্যাপারটি একটি অতিরিক্ত বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আর একটি বিষয় হল ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সমস্যা। গত পঁচাত্তর বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশে হিন্দু সমাজের উপর নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার, নারীদের উপর অত্যাচার, ধর্মীয় স্থান আক্রমণ চলছেই। বাংলাদেশ হয়ে তা কমেনি, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি শাসনেও তা কমেনি।
শেখ হাসিনার এই অগণতান্ত্রিক সরকারের বড় ভরসা ছিল ভারত সরকার। গত পনেরো বছরের এই অপশাসনের সময় পাঁচ বছর কংগ্রেস এবং দশ বছর ভারতে ছিল বিজেপি সরকার। বাংলাদেশ নিয়ে কংগ্রেস বা বিজেপির বিদেশ নীতির খুব একটা তফাত নেই। শেখ হাসিনাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে চালানোর চেষ্টা করে ভারতে সব দলের সরকার। শেখ হাসিনা যে-রকম বেশ কিছু গণহত্যাকারীদের ফাঁসি দিয়েছেন, বেশ কিছু জঙ্গি দমন করেছেন, পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেছেন দেশ শাসন করবেন ইসলামি মদিনা সনদের আদর্শে। তিনি হাত ধরেছেন কট্টর মৌলবাদী হেফাজতে ইসলামের, তাদের খুশি করতে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে লঘু করেছেন। বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছর ধরে হিন্দুদের উপর আক্রমণের কোনও দোষীরই সাজা হয়নি।
বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছর বা গত দশ বছরে হিন্দু নির্যাতনের ব্যাপারে বিজেপি সরকার প্রায় নীরব বা মামুলি প্রেস বিবৃতি দিয়ে থাকে। তাকে মেনে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপিও মূলত নীরব থাকে। আজকের বাংলাদেশের অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থ পররাষ্ট্র ভাবনা কম দায়ী নয়। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য সহমর্মিতা দেখানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গের মানুষের। তারাও এ ব্যাপারে আশ্চর্য নীরব। কোনও দিন শুনেছেন বাংলার সাংসদরা সংসদে হইচই বাধিয়েছেন বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য অথবা বিধায়করা বিধানসভায় বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে আলোচনা করছেন? বাংলাদেশের মৌলবাদী উগ্রতা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে দৃশ্যমান। আজও পশ্চিমবঙ্গ নীরব। এর মূল্য আগামী দিনে দিতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy