E-Paper

চৈতন্যে জারিত মানবতাবোধ

দক্ষ শিক্ষার্থী সেই ছাত্র, যে তার অধীত শিক্ষাকে জীবনে অর্থপূর্ণ ভাবে প্রয়োগ করতে পারছে। তার জন্য দরকার মাথা-মন-হাত এক করে, পরিস্থিতির নিরিখে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা।

শর্মিলা মল্লিক

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:২৪

সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব জুড়ে বনিয়াদি শিক্ষার প্রথাগত পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের পক্ষে জোরালো দাবি উঠছে। দক্ষতাবৃদ্ধির শিক্ষা কাজের বাজারের উপযুক্ত করে মানবসম্পদের বিকাশ ঘটালেও, জীবনযাপনে সব সময় তার সম্যক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সমাজে অপরাধপ্রবণতা, হিংসা, অসহিষ্ণুতা, সব কিছুরই গতি ঊর্ধ্বমুখী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই কষ্টলব্ধ দক্ষতাও অনেক সময় তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। ফলে হতাশা হয়ে উঠছে অল্পবয়সিদের নিত্যসঙ্গী। দিল্লির একটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যাঁরা ইউনেস্কো, ইউনিসেফ-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশ্বের শিশুদের মধ্যে সামাজিক আবেগ বিষয়ে সচেতনতা এনে তাদের ‘দক্ষ শিক্ষার্থী’ করে তোলার লক্ষ্যে দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছেন। এই ‘দক্ষ শিক্ষার্থী’ কে? শ্রীমা সারদামণি দেবীর জন্মতিথিতে এ প্রসঙ্গই বা কেন?

দক্ষ শিক্ষার্থী সেই ছাত্র, যে তার অধীত শিক্ষাকে জীবনে অর্থপূর্ণ ভাবে প্রয়োগ করতে পারছে। তার জন্য দরকার মাথা-মন-হাত এক করে, পরিস্থিতির নিরিখে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। শুধু বই পড়ে আর ট্রেনিং নিয়ে দক্ষতা বাড়ালেই চলবে না, সঙ্গে পরিস্থিতি তলিয়ে বোঝার জন্য সৃজনশীলতা, সমানুভূতি, শ্রদ্ধাশীলতার মতো কিছু মূল্যবোধের অনুশীলনও আবশ্যিক। জ্ঞান অর্জন নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু সেখানেই থেমে গেলে চলে না, জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষেত্রটিও বিলক্ষণ বুঝতে হয়— তার পরিবেশ, পরিস্থিতি, মানুষজন ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কের সমীকরণও। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। নিজ জীবনের প্রাত্যহিক যাপনকে উদাহরণ করে তুলে মা সারদা সেই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। তাঁর দেখানো রাস্তাটা এখন কী ভাবে আধুনিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের এক মূলভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, আজকের দিনে শ্রীশ্রীমায়ের কয়েকটি উপদেশকে ধরে তা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে।

‘মন আলগা হলেই যত গোল বাধায়’, ‘সন্তোষের সমান ধন নেই’, ‘ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক’জনে?’, ‘সহ্যের সমান গুণ নেই’, ‘যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখো না, দোষ দেখবে নিজের’— শ্রীশ্রীমায়ের এই সব উপদেশ বহুশ্রুত, কিন্তু স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে এদের অন্তর্ভুক্তি এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। এই সব বাক্যবন্ধ শিক্ষাজগতে সামগ্রিক বিকাশ-প্রবক্তাদের মনের কথা, যাঁরা শিক্ষা বলতে শুধু বৌদ্ধিক উন্নতিকেই বোঝান না, সহৃদয় মন, উপযুক্ত মূল্যবোধ ও পরিবেশ সচেতনতার মিশ্রণে এক জন দায়িত্বশীল, আনন্দময় মানুষের কথাও ভাবেন। বিশ্বাস করেন, এতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত দক্ষতাই বাড়বে না, এমন এক বাতাবরণ সম্ভব হবে যেখানে সহযোগিতা, আদানপ্রদান ও সমমর্মিতার ভিত্তির উপরে দাঁড়াবে শিক্ষা। ভারতে যে নতুন শিক্ষানীতি ঘোষিত, সেখানে সকলকে যুক্ত করে, সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে স্থির থেকে, মানবিক মূল্যবোধে স্থিত এক পরিবেশে শিক্ষাকে বিন্যস্ত করার কথা বলা হচ্ছে। এই ভাবনার বাস্তবায়নে শ্রীমায়ের জীবন ও বাণী দিক দেখাতে পারে।

২০২৩-এ অর্গানাইজ়েশন ফর ইকনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (ওইসিডি) বিশ্বের ১৬টি দেশের দশ থেকে পনেরো বছর বয়সি স্কুলছাত্রদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করে। কিশোর-কিশোরীরা কতটা খোলা মনের তা দেখা হয় তাদের ঔৎসুক্য, সৃজনশীলতা ও সহ্যশক্তির নিরিখে; কাজের দক্ষতা বিচার করা হয় তাদের দায়িত্বজ্ঞান, আত্মসংযম, উদ্যম ও লেগে থাকার ক্ষমতা যাচাইয়ে, অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক মাপা হয় মেলামেশায় স্বাচ্ছন্দ্য, মতামত প্রকাশে দার্ঢ্য ও প্রাণশক্তির বিচারে, দলগত ভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রতিফলিত হয় তাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমানুভূতির মধ্য দিয়ে। শেষে দেখা হয় তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় তাদের মানসিক চাপ সামলানোর কৌশল, সদর্থক চিন্তাভাবনা, নিজের ও অন্যের আবেগ বোঝার চেষ্টাকে। দেখা যায়, যে সব ছেলেমেয়ে এই সব বিষয়ে ভাল, তারা অন্যান্য দক্ষতাতেও তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে। তারা সকলকে নিয়ে চলতে পারবে, হৃদয়ে সবার জন্য উদার উন্মুক্ত জায়গা ধরে রাখতে পারবে; তাদের হাতেই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সাফল্যের চাবিকাঠি।

শ্রীশ্রীমায়ের অতুলনীয় সমদর্শিতার মূলে অবশ্যই ছিল তাঁর অদ্বৈতজ্ঞানে পরিস্রুত আধ্যাত্মিক চৈতন্য। সেই উচ্চভাব বুঝতে পারি কি না পারি, এটুকু অন্তত বোঝার চেষ্টা করা যেতেই পারে যে, তাঁর দেখানো রাস্তায় প্রাত্যহিক চলাফেরা সবাইকে ভাল রেখে নিজেকে ভাল রাখতে সাহায্য করে; মন থেকে অনেক অকারণ দুশ্চিন্তা দূর হয়। সকলের কল্যাণকামনা করতে পারলে একটা বিশেষ ধরনের আত্মপ্রত্যয় আসে, যার সাহায্যে কঠিন পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যাওয়ার পথটা চোখের সামনে খুলে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ত্রিকালজ্ঞ দৃষ্টিতে মায়ের এই অপূর্ব সত্তা সকলকে চিনিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “ও সারদা, সরস্বতী— জ্ঞান দিতে এসেছে।” চৈতন্যে জারিত মানবতাবোধের অসাধারণ শিক্ষিকা শ্রীশ্রীসারদা দেবীর জীবনের আলোয় সেই জ্ঞান ও শিক্ষা আমাদের প্রার্থিত হোক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

humanity Humanism

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy