E-Paper

অন্তিম দিনের যথার্থ শুশ্রূষা

সন্ডার্স ছিলেন ব্রিটিশ নার্স, সমাজকর্মী ও চিকিৎসক, যিনি ১৯৬৭ সালে লন্ডনে সেন্ট ক্রিস্টোফার’স হসপিস প্রতিষ্ঠা করেন. সন্ডার্সের মতে, যন্ত্রণার যথার্থ উপশম করার অন্যতম শর্ত, ব্যথাতুর মানুষটির সম্মান ও মর্যাদার সুরক্ষা।

সৌভিক মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:২৯

অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার ‘বিশ্ব হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস’ হিসাবে পালিত হয়, এই বছর দিনটি ছিল ১১ অক্টোবর। এ দিন নানা পরিসরে শোনা যায় এক প্রশ্ন — বার্ধক্য বা অসুস্থতার জন্য যাঁদের মৃত্যু আসন্ন, তাঁরা কী ভাবে বাঁচবেন তাঁদের শেষ দিনগুলো? এর একটা উত্তর, ‘হসপিস’ ব্যবস্থা, যেখানে আরোগ্যের চাইতে রোগীদের শান্তি ও স্বস্তিময় জীবন, ব্যথা লাঘব এবং মর্যাদা রক্ষায় জোর দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় পরিবার, চিকিৎসক, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবীরা এক সঙ্গে যোগ দেন। আর যন্ত্রণা উপশমের শুশ্রূষা, বা ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ চিকিৎসার একটি বিশেষ শাখা, যার লক্ষ্য ব্যথা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রোগীর মানসিক ও আধ্যাত্মিক সহায়তা, এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি সিসিলি সন্ডার্সের ‘সামগ্রিক যন্ত্রণা’-র (টোটাল পেন) ধারণা। সন্ডার্স ছিলেন ব্রিটিশ নার্স, সমাজকর্মী ও চিকিৎসক, যিনি ১৯৬৭ সালে লন্ডনে সেন্ট ক্রিস্টোফার’স হসপিস প্রতিষ্ঠা করেন. সন্ডার্সের মতে, যন্ত্রণার যথার্থ উপশম করার অন্যতম শর্ত, ব্যথাতুর মানুষটির সম্মান ও মর্যাদার সুরক্ষা।

ভারতের প্রেক্ষাপটে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এ দেশে ক্যানসার রোগীদের মাত্র ২ শতাংশ প্যালিয়েটিভ কেয়ার-এর সুবিধা পাচ্ছেন (আইসিএমআর, ২০২৩)। পরিকাঠামোর অভাবের পাশাপাশি, একটি সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বও স্পষ্ট। পশ্চিমের চিকিৎসা নীতিতে রোগীর স্বাধিকার, অর্থাৎ বা নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতে এখনও রোগীর পরিবার মনে করে, আসন্ন মৃত্যুর কথা বলে রোগীকে ভীত বা বিষণ্ণ না করে প্রকৃত অবস্থা গোপন করাই ভাল। চিকিৎসকেরাও প্রায়ই পরিবারের মতামতকে অনুসরণ করেন। ফলে প্রশ্ন ওঠে— সত্য জানার অধিকার কার? প্যালিয়েটিভ কেয়ার যে হেতু হাসপাতাল-কেন্দ্রিক নয়, পরিবার-কেন্দ্রিক, তাই পরিবারের সদস্যরা প্রায়শই সম্মিলিত ভাবে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তির ইচ্ছার চাইতে পরিবার প্রায়ই অন্যান্য ধরনের চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেয়। যেমন, পরিবার যদি মনে করে যে কোনও রোগের কথা জানাজানি হলে সমাজে দুর্নাম বা বিদ্রুপের শিকার হতে হবে, তা হলে বিষয়টি তারা প্রকাশ করে না। তাতে চিকিৎসায় যেমন দেরি হয়, তেমনই রোগীর জন্য তাঁর শেষ দিনগুলোয় নিজের চিকিৎসা, পরিচর্যা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কমে আসে মরণাপন্ন মানুষটির। কুসংস্কার, লজ্জা, ধর্মবিশ্বাসের মতো বিষয়গুলো রোগীর ব্যথা প্রকাশের ধরনকেও প্রভাবিত করে।

ভারতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার চালু করার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল কেরল। সে রাজ্যের চিকিৎসক এমআর রাজাগোপালের ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি ব্যতিক্রমী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা ২০০৮ সালে রাজ্যের নীতিতে পরিণত করে কেরল সরকার। স্থানীয় সরকার ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’-এর পরিষেবাগুলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষিত নার্স ও স্বেচ্ছাসেবীরা বাড়িতে গিয়ে রোগীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দেন, যাতে রোগী শেষ দিনগুলো পারিবারিক যত্নের আবহে কাটতে পারেন। পাশাপাশি যন্ত্রণা উপশমের জন্য জরুরি ওষুধ, বিশেষত (ওপিঅয়েড) ওষুধগুলির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষিত নার্সরা কেবল চিকিৎসা করেন না, ব্যথা উপশম, মানসিক সমর্থন এবং পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে কম খরচে অনেক মানুষের কাছে এই পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়।

এই মডেল আজ সারা বিশ্বের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে স্বীকৃত। কেরলে ৬০–৭০ শতাংশ রোগীর কাছে প্যালিয়েটিভ কেয়ার পৌঁছে যায়, যেখানে জাতীয় গড় মাত্র ২ শতাংশ। ভারতের মোট মরফিন ব্যবহারের প্রায় ৭৫ শতাংশই কেরলে হয়। অর্থাৎ কেরল প্রমাণ করেছে যে, বড় হাসপাতাল, আইসিইউ বা দীর্ঘ ডাক্তার-রোগী সাক্ষাতের প্রয়োজন ছাড়াও অন্তিম জীবনে মানবিক যত্ন দেওয়া সম্ভব। কেরলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই নীতি গ্রহণ করেছে তামিলনাড়ু (২০১৯), কর্নাটক (২০১৬) এবং মহারাষ্ট্র (২০১২)।

ভারতে এখন কয়েকটি দিক বিশেষ ভাবে ভাবনার দাবি রাখে। প্রথমত, নীতি ও আইন সংস্কারের মাধ্যমে ব্যথানাশক ওষুধের নাগাল পাওয়াকে সহজ করা, এবং জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’-কে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। যদিও ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার (২০১২) এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১৭)-তৈরি হয়েছে, কিন্তু এগুলির বাস্তবায়ন এখনও অসম, অসম্পূর্ণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ থেকে গিয়েছে। এগুলিকে বাস্তবে রূপায়ণের ব্যবস্থা করা দরকার। যেমন, ‘হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার’-গুলিতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার নথিভুক্তির ব্যবস্থা তৈরি করা, এবং শয্যাশায়ী রোগীদের জন্য নিয়মিত বাড়ি পরিদর্শনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ও আশাকর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। আমরা যেন মনে রাখি, মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু মৃত্যুর অভিজ্ঞতা কেমন হবে, তা আমরা নির্ধারণ করতে পারি। অন্তিম দিনগুলিতে একটুখানি শান্তি, মর্যাদা ও মানবিকতার পরশ দেওয়া সম্ভব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Medical medical treatment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy