অনেক দিন আগের কথা। কোনও এক অনামা দেশে সন্ধ্যাবেলায় সভা বসেছে। সেই সভা মানুষের নয়, পোলট্রির। পোলট্রি মানে তখনও গেরস্তবাড়ির বা ছোটখাটো খামারের পোষা মুরগি। তাদের সভার কথা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই— তখনও প্রাণিজগতের উপর মানুষের ষোলো আনা আধিপত্য বহাল হয়নি, গৃহপালিত পশুপাখিরা নিজেদের ভালমন্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে, আলোচনা করে, দাবিদাওয়া ঠিক করে, জরুরি প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মিটিং ডাকে। সে-দিন সাধ্যমতো বড়সড় একটা হল ভাড়া করতে হয়েছিল, কারণ সভাটি ছিল বিশেষ জরুরি। আর ক’দিন পরেই ক্রিসমাস। ক্রিসমাস মানেই ঘরে ঘরে মহাভোজ। মুরগি-জীবনে যাকে বলে পরম লগন। আর সেই মহোৎসবের কথা মাথায় রেখেই তারা অত্যন্ত গুরুতর একটি প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করতে চাইছিল। প্রশ্নটি হল: উইথ হোয়ট সস শ্যাল উই বি ইট্ন? অর্থাৎ— কোন সস দিয়ে আমাদের খাওয়া হবে?
তো, ‘জনসভা’য় সে-দিন উপচে-পড়া ভিড়। সভার কাজও চলছে জোরকদমে। “আলোচনার জন্য নির্ধারিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞার প্রভূত বিচ্ছুরণ ঘটল এবং পোলট্রি হিসাবে পালিত বিহঙ্গজাতি এ-যাবৎ যে উন্নতি করেছে, তার জন্য সবার হৃদয় পরম তৃপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এমনকি খুদে মুরগিগুলোও এই আশ্বাস পেয়ে খুব খুশি যে, তাদের গলা ছেড়ে ডাকবার দাবিটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।” ঘড়ির কাঁটায় যখন দশটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি, সাম্প্রতিকতম বক্তার ওজস্বিনী বক্তৃতা শুনে শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত, সেই সময় মঞ্চে কথা বলতে উঠল এক মাঝবয়সি মোরগ। চিমড়ে মতো চেহারা, গলার আওয়াজখানাও কেমন ফ্যাকাসে। সভাপতির পাশে বসে সে প্রথম কিছুক্ষণ ঘ্যানঘেনে সুরে পোলট্রির নেতাদের সকলের নাম ধরে ধরে খুব প্রশংসা করে চলল। উপস্থিত সকলে এমনধারা ভাষণ শুনেই অভ্যস্ত, তাই তারা চুপচাপ বসে হাই তুলছিল আর ভাবছিল কখন সভা ভাঙবে। কিন্তু হঠাৎ বক্তাটি একটু নড়েচড়ে বসে বারদুয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল, “স্যর, আমি জানি আমাদের অধিকার সম্পর্কে এই সব জবরদস্ত এবং ঝকঝকে আলোচনার পরে নিজস্ব মতামত জানানোর কোনও হক আমার নেই (হইচই), এই মঞ্চে আজ সেই সব দারুণ বক্তৃতা তো আমরা শুনেই নিয়েছি (আরও হইচই), কিন্তু একটা কথা আমাকে বলতেই হবে— হয়েছে কি, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, যেটা আমাদের প্রাজ্ঞ নেতারা বোধহয় খেয়াল করেননি (চার দিক থেকে ‘হো হো’ ধ্বনি)— কথাটা হল গিয়ে এই...” বলে সে বেবাক চুপ করে গেল, দু’চারবার ঢোক গিলল, সামনে রাখা পাত্রটা থেকে এক চুমুক জল খাওয়ার চেষ্টা করল, পারল না কারণ অনেক আগেই জল ফুরিয়ে গিয়েছিল, তার পর এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল, “কথাটা হচ্ছে, আমি একেবারেই চাই না যে আমাকে খাওয়া হোক, কোনও ভাবে কি সেটা...”
যেই না এ-কথা বলা, অমনি সকলে একেবারে হইহই করে প্রবল আপত্তি জানাতে শুরু করল। সব কথা ভাল করে ধরা না গেলেও ওদের আপত্তির কারণটা খুব পরিষ্কার বোঝা গেল। সবাই বলতে চাইছিল যে বক্তার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই— মানুষ পোলট্রির হাঁসমুরগিদের খাবে বলেই পোলট্রি আছে, এই গোড়ার কথাটাই সে জানে না, তাই এমন ফালতু বকছে! অনেকেই ‘প্র্যাকটিকাল পলিটিক্স’ ‘প্র্যাকটিকাল পলিটিক্স’ বলে তাকে খুব কষে দাবড়ে দিল। আর সেই মোরগটি ঘাবড়ে গিয়ে নিজের রোগা শরীরটাকে আরও গুটিয়ে নিয়ে কোনও রকমে মঞ্চ থেকে সরে গেল, তার পরে নেই হয়ে গেল। অতঃপর সকলে নতুন উৎসাহে বাকি কাজ সম্পন্ন করল, ‘কোন সস দিয়ে আমাদের খাওয়া হবে’ সেই বিষয়ে সর্বসম্মত দাবি-প্রস্তাব সভায় গৃহীত হল। ঘোষণা করা হল যে, সেই প্রস্তাব মালিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
— গল্পটা একটু পুরনো। একটু, কেননা তার বয়স এখনও পুরো দেড়শো হয়নি। ইংল্যান্ডের জাস্টিস পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল উইলিয়াম মরিস-এর লেখা ‘অ্যান ওল্ড ফেব্ল রিটোল্ড’। নাম দেখে ঠকে গেলে চলবে না— কোনও প্রাচীন উপকথা থেকে এই গল্পের (অনু)প্রেরণা আসেনি, সে এসেছিল একেবারে সমকালীন রাজনীতি থেকে। সময়টা খেয়াল করা ভাল। কার্ল মার্ক্স বিদায় নিয়েছেন আগের বছর, ইংল্যান্ডে সে-সময় নানা ধরনের সমাজতন্ত্রী ভাবনা এবং সংগঠনের জোয়ার, মার্ক্সের অনুগামীরা তাঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে প্রবল। তাঁদের অনেকে অবশ্য— তখনই— মার্ক্সকে ব্যবহার করছেন নিজেদের ছাঁচে ঢেলে, প্রায়শই যা নিছক অপব্যবহারে পর্যবসিত। সেই প্রেক্ষাপটে ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন নামক একটি সংগঠন ১৮৮৪ সালের জানুয়ারিতে নাম (এবং অংশত চরিত্রও) বদলে হয়ে ওঠে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন। সেই মাসেই জন্ম নেয় তাদের সাপ্তাহিক মুখপত্র জাস্টিস। শুরু থেকে বছর দেড়েক ধরে সেই পত্রিকায় নিয়মিত এক বা একাধিক লেখা লিখেছিলেন উইলিয়াম মরিস (১৮৩৪-৯৬)। একাধারে স্থাপত্যবিদ, টেক্সটাইল ডিজ়াইনার, কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, সমাজকর্মী, ‘১৮৮০-র দশক থেকে তন্নিষ্ঠ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী ও মার্ক্সবাদী’। এসডিএফ নামক দলটিতে অবশ্য বেশি দিন টিকতে পারেননি তিনি, দলপতিদের অসহিষ্ণু দাপটের ঠেলায় বছর না ঘুরতেই তাঁরা কয়েক জন সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল তৈরি করেন, যার নাম সোশ্যালিস্ট লিগ। অচিরেই মরিসের অজস্র লেখা প্রকাশের পরিসর হয়ে দাঁড়ায় লিগের মুখপত্র কমনউইল। প্রসঙ্গত, নতুন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা ছিল এলিয়নর মার্ক্স-এর। তিনি কার্ল মার্ক্সের ছোট মেয়ে, উনিশ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের এক অগ্রণী অভিযাত্রী।
তা, শ্রমজীবী মানুষের জন্য, তাঁদের স্বার্থে সংগঠিত লড়াইয়ের যোদ্ধাদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকার সূচনা-সংখ্যায় এমন একটি লেখা কেন লিখেছিলেন উইলিয়াম মরিস? লিখেছিলেন একটা সুতীব্র তাড়না থেকে। সমাজ বদলানোর তাড়না। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নামে চার পাশে, এমনকি নিজের ঘনিষ্ঠ মহলেও অনেকের কথাবার্তায় ও আচরণে প্রতিনিয়ত ভীরু, অতিসতর্ক, দ্বিধাজড়িত মানসিকতার পরিচয় পেয়ে তিনি তখন ক্ষুব্ধ, অস্থির, অসহিষ্ণু। উত্তরোত্তর তাঁর মনে এই ধারণা জোরদার হয়ে উঠেছে যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ইমারতটি যেমন আছে তেমনটি রেখে দিয়ে, কেবল ইতস্তত চুনকাম করে বা দু’চারটে গবাক্ষের জাফরি পাল্টে দুনিয়া বদলানোর পথে এক পা-ও এগোনো যাবে না। আগে বলতে হবে, যা আছে, যা চলছে, সেটা আগাগোড়া অন্যায়, তাই তা চলতে পারে না। সত্যিকারের পরিবর্তনের এই গোড়ার কথাটা না বলতে পারলে সমাজতন্ত্রের কোনও মানে নেই।
রোগা, ক্ষয়াটে চেহারার ওই মোরগ নিজের মতো করে গোড়ার কথাটাই বলতে গিয়েছিল। তার নিপাট বক্তব্য: আমি খাদ্য হতে চাই না, বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু দেখা গেল, কেউ তার কথা কানে তুলতে রাজি নয়। রাজি নয়, কারণ কথাটা অবাস্তব। খাবে বলেই তো লোকে তাদের পুষেছে, খাইয়েদাইয়ে বড় করছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যুগ যুগ ধরে তারা পৃথিবীর পোলট্রিতে আসিতেছে চলে, খাদ্য হবে, খাদ্য হবে বলে, এখন হঠাৎ সে-সব ভুলে গিয়ে ‘আমি চাই না আমাকে খেয়ে ফেলা হোক’ বললে ধর্মে সইবে কেন? ধর্মে যত দূর সয়, তত দূরই তো যেতে পারি আমরা, আলোচনা করতে পারি নানা বিষয়ে— কী ভাবে আমাদের মারা হবে, আস্তে আস্তে সেদ্ধ করা হবে না চটপট ভেজে ফেলা হবে এবং, সবচেয়ে বড় কথা, কোন সস দিয়ে খাওয়া হবে। সেই আলোচনার ভিত্তিতেই কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিদাওয়া জানাতে পারি, স্মারকপত্র দাখিল করতে পারি। এটাই হল বাস্তবসম্মত কথা। এই ‘বাস্তববুদ্ধি’ মেনে নেওয়া উইলিয়ম মরিসের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তাঁর একাধিক জীবনী লেখা হয়েছে। তার মধ্যে দু’টির কথা উল্লেখ করা যাক। প্রথমটির নাম উইলিয়ম মরিস: রোম্যান্টিক টু রেভলিউশনারি (১৯৫৫), লিখেছেন স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ ই পি টমসন। দ্বিতীয়টির লেখক পল মেয়ার, ফরাসি ভাষায় তাঁর লেখা মরিসের জীবনীর ইংরেজি তর্জমা: উইলিয়ম মরিস, দ্য মার্ক্সিস্ট ড্রিমার (১৯৭৮)। কেবল জীবনীকাররাই নন, তাঁর বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, এমনকি সহমর্মীরাও সচরাচর তাঁকে স্বপ্নচারী বা রোম্যান্টিক বলেই অভিহিত করেছেন। কেউ কটাক্ষ হিসাবে, কেউ অভিবাদন সহকারে। সে-সব এখন ইতিহাস। তবে কিনা, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক জুড়ে দুনিয়ার যে হাল হয়েছে এবং তারইএক কোণে আমাদের বামপন্থীরা বাস্তববাদের জোয়াল কাঁধে নিয়ে ‘থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়’ জপ করতে করতে নিজেদের যে কানাগলিতে এনে ফেলেছেন, তা দেখলে উইলিয়ম মরিসের আধুনিক উপকথার ওই মোরগটি আরও এক বার দীর্ঘশ্বাস ফেলত।
আমরা অবশ্য তাকে কোনও গুরুত্বই দিতাম না। আমরা স্বপ্নচারী নই। আমরা জানি, বাস্তব দুনিয়া যাঁদের দখলে, আমরা তাঁদের জন্য বলিপ্রদত্ত। অতএব, পৃথিবীটাকে বদলানোর কথা মনেও আনা চলবে না। বরং, কোন সস দিয়ে আমাদের খাওয়া হবে সেই বিষয়ে গভীর আলোচনা করা যাক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)