পরিচয়পিপাসু: ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষায়, শ্রীনগর, ২৫ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।
ঢের দেরি টিউলিপের দিন শুরু হতে। চিনার পাতায় আগুনে রং ধরতে শুরু করেছে মাত্র। এক মাসের মধ্যে দাউ দাউ করবে। লালচকে বহুজাতিক ব্র্যান্ডের গ্লোসাইন বিজ্ঞাপনে স্বপ্নসুন্দর পুরুষ ও নারীরা হাঁটাচলা করছেন। ক্লক টাওয়ারে তিরঙ্গা আলো। গোধূলির মুখে নানাবিধ আলো জ্বলে উঠছে ডাল লেক চত্বরে। এই প্রাণবান আলোর রেশ থাকবে রাত বারোটা পর্যন্ত।
চিনার গাছ ঘেরা ডাল লেকের গভীরে পসরা বোঝাই ছোট নৌকাটি এসে আমার মখমল সজ্জিত শিকারার পাশের তক্তায় মৃদু ধাক্কা মারল। এখানকার জলবাণিজ্যের রেওয়াজ মাফিক, আশপাশ থেকে ছোট নৌকা আখরোট, কেশর, রঙিন পাথরখচিত গয়নার পসরা সাজিয়ে, বাদামের গুঁড়ো এলাচ আর কেশর দিয়ে বানানো জনপ্রিয় কাওয়া চা-এর কেটলি-বাহিত নৌকা, ভাসমান ম্যাগির দোকান, কাঠ কয়লার উনুনে কাবাবের লোভনীয় সম্ভার নিয়ে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে এসে যে হাউস বোটগুলিকে নিথর ও ভূতুড়ে দেখেছিলাম, আজ তার রেলিংয়ে দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গের ভেজা জামাকাপড় শুকোচ্ছে। ভূস্বর্গে মেঘের নীল ঘুড়ি উড়ছে আশ্বিনের উজ্জ্বলে।
বাতাস উজ্জ্বলতর, কারণ দীর্ঘ দশ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে উপত্যকার বিধানসভা ভোট শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালে ৩৭০ প্রত্যাহারের পরে এই প্রথম বিধানসভা ভোটও। উল্লেখযোগ্য ভাবে মানুষ নামছেন রাস্তায়, এমনটাই তো কথা ছিল। মাঝে লোকসভার ভোটেও কিছুটা নাড়াচাড়া পড়েছিল, কিন্তু তা আজকের মতো উৎসবের সুর বহন করে আনেনি। তবে উৎসবের মধ্যেই বিষাদ বোনা রয়েছে উপত্যকায়। শিকারা ঘাটের বিড়িচক্র যে ভাষ্য তৈরি করছে তা কিন্তু দেশের মূলস্রোতের আর্তনাদের থেকে ভিন্ন নয়। যেমন চার বছর আগেও হাজার টাকার মধ্যে বিদ্যুতের বিল আসত হাউস বোটগুলোতে। এলজি (লেফটেন্যান্ট গভর্নর)-র জমানায় স্মার্ট মিটার বসানোয় আজ বিল আসছে পাঁচগুণেরও বেশি। আগে একটা শিকারা বানাতে যা খরচ হত, এখন তার চারগুণ। মূল্যবৃদ্ধির পঙ্কে আটকে যাচ্ছে বৈঠা। ৩৭০ তোলার সময় সেনা দিয়ে মানুষের জীবন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ছ’মাস। সর্বক্ষণ পাহারা, ঘর থেকে বেরিয়ে কাম ধান্দা দূরস্থান, শিক্ষিত যুবারা নেট-বিচ্ছিন্ন ছিলেন মাসের পর মাস। আর আজ, বাজারে এমনই আগুন, পর্যটক আগের থেকে বাড়লেও কাশ্মীরের সাধারণ জনতার ফুটো পকেটে সেলাই এখনও পড়েনি।
শিকারা সমবায়ের এই মন, কাশ্মীরের সংখ্যাগুরু মনেরই প্রকাশ, কিন্তু তা খণ্ডচিত্রও বটে। অন্তত পাঁচ বছর আগের সঙ্গে তুলনায় সেটাই মনে হয়। ২০১৯-এ এবং তার আগে বার বার এই ভূস্বর্গে এসে যে সর্বগ্রাসী আতঙ্কের ছাপ দেখেছিলাম, তা এ বারে অনেকটাই যেন স্তিমিত। পুলওয়ামা-পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসবাদী কোনও বড় হামলা নেই, রাস্তাঘাটে পাথর ছোড়ার ফলে জব্দ নয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। হরতাল একেবারেই বন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা উর্বর জমি এবং শস্যের আশীর্বাদ ভয়ঙ্কর গরিবির হাত থেকে বার বার বাঁচিয়েছে কাশ্মীরকে। ৩৭০ প্রত্যাহারের ফলে জমি যত দিন না বেহাত হচ্ছে, বাঁচাবেও।
তবুও কাশ্মীরের নিসর্গ এতটাই চোখধাঁধানো, এখানে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাবরের হুমড়ি খেয়ে পড়া এতটাই প্রচল যে, এ বারের ভোটের প্রকৃত চাবি যে লুকিয়ে রয়েছে চিরঅবহেলিত জম্মুর হাতে, সেই হিসাবটা ঠিকমতো করা হয়ে ওঠে না হয়তো। জম্মুর রাজনৈতিক স্বর বহু যুগ ধরে অবহেলিত রয়েছে, সে কথাও খেয়াল থাকে না এই অঞ্চল নিয়ে তৈরি হওয়া যে কোনও রাজনৈতিক ভাষ্যে। কিন্তু ঘটনা এটাই যে, শুধুমাত্র জম্মু জেলাতেই ১১টি বিধানসভা আসন-সহ এই ডিভিশনের মোট ৪৩টি আসন (পুনর্বিন্যাসের পর) কিন্তু জম্মু কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ-মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করতে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে চলেছে।
জম্মুর ভোটবিন্যাস, তার চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক সামাজিক মিশ্রবর্ণ অনেকটাই জটিল এবং বহুস্তরীয় এ বারে কাশ্মীরের তুলনায়। কাশ্মীরের মতো একপেশে নয় এখানকার জনসংখ্যার চরিত্র। হিন্দু মুসলমান শিখ এবং অন্যান্য সম্প্রদায় রয়েছে, রয়েছে ওবিসি এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতির দ্বন্দ্ব। গুজ্জর এবং পাহাড়িদের দীর্ঘ দিনের অধিকারের লড়াই চলছে। আর এই পরিস্থিতিতে বিজেপি যা করে থাকে, সেই পরিচিত বিভাজন-রাজনীতির গবেষণাগার খুলে বসেছে জম্মুতে। পাহাড়িদের দীর্ঘ দাবি মেনে ভোটের আগে তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দিয়ে (যাদের বেশির ভাগই বর্ধিষ্ণু হিন্দু এবং শিখ), আবেগের স্রোত তৈরি করতে চাইছে ভোটবাজারে।
২০১৯-এ ৩৭০ প্রত্যাহারের পর ধীরে ধীরে কাশ্মীরের ছায়াযুদ্ধ রক্তপাত সন্ত্রাসবাদের ঠাঁই বদল হয়ে চলে এসেছে পীরপঞ্জালের দক্ষিণ অঞ্চলে অর্থাৎ উপত্যকা থেকে জম্মুর রুক্ষ ভূখণ্ডে। সন্ত্রাসবাদের এই কৌশল পরিবর্তন জম্মুর পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাষ্য তৈরির নিমিত্ত কাজে লাগিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু জম্মুকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলি এলাকার জাতিগত এবং জনসংখ্যার মিশ্রণের প্রেক্ষিতে দেখলে বোঝা যায় উদ্দেশ্য ধর্মীয় বিভাজনেরও। সাম্প্রতিক অতীতে বার বার জম্মু অঞ্চলের কাঠুয়া, রিয়াসি, পুঞ্চ এবং রাজৌরি জেলায় ঘটে চলেছে পাকিস্তানের মদতে সন্ত্রাসের ঘটনা। এখানকার নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদও কিছুটা লালিত হচ্ছে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের আবহে। স্থানীয় মানুষের এই অভিযোগও কানে এল, অনেক ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসবাদের মোড়কে দুই সম্প্রদায়কে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত কয়েক বছরে।
আসলে অমরনাথ আর বৈষ্ণোদেবী-নির্ভর মরসুমি পর্যটন ছাড়া জম্মুতে বার্ষিক কর্মসংস্থান দেওয়ার মতো কিছুই নেই। বেকারত্ব, অনুন্নয়ন অন্ধকার তৈরি করে। আর সেই অন্ধকারে বাড়বাড়ন্ত হয় হিংসা। শীতকালে দরবার মুভ-এর ফলে অন্তত পঞ্চাশ কোটি টাকার বাণিজ্য হত জম্মুতে। মহারাজা রণবীর সিংহের তৈরি করা সেই দরবার বদল, শীতে জম্মুতে এবং গ্রীষ্মে শ্রীনগরে প্রশাসন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই পদক্ষেপের মূল কারণ ছিল জম্মু এবং কাশ্মীর উভয়েই যাতে সমান ভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। এলজি তা বন্ধ করে দিয়েছে ২০২১ সালে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছোট বড় দোকানদার, বাণিজ্যিক সংস্থা, এবং যুবাশক্তি। জম্মু বনাম কাশ্মীরের একটি বয়ান তৈরি করতে পারলে বা উভয়ের সংযোগ কমিয়ে দিতে পারলে আসলে হিন্দু প্রধান এলাকার সঙ্গে মেরুকরণ সম্ভব হবে মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীরের। শাসক দলের সেই নকশাটি রয়েছে কি না, ভোটের বাজারে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পীরপঞ্জালে।
এর পাশাপাশি জম্মু ভূত দেখছে খুচরো শিল্পে অম্বানী আদানির সংস্থাগুলির অনুপ্রবেশের। বেশ কিছু অসন্তোষের পাশাপাশি এই বিষয়টি নিয়েও একাধিক পূর্ণ হরতাল হয়ে গিয়েছে শহরে এবং জেলাগুলিতে। ক্ষোভ নতুন আবগারি নিয়ে। অভিযোগ, স্থানীয় ব্যবসাদারদের ঘটি বিক্রি করার দশা। পর্যটন নেই, বেসরকারি সংস্থার লগ্নিতে আগ্রহ কম, ভরসা মূলত সরকারি চাকরি। সেখানেও নিয়োগ দুর্নীতির ধারাবাহিক মামলা চলছে। ২০১৯-এর পর কোনও খালি পদে লোক নেওয়া হয়নি বললেই চলে। অতিমারির দু’টি বছরে কফিনে পেরেক আরও মজবুত হয়েছে।
এই সব কিছুর মধ্যেই, সেনার এই সতর্ক জলপাইরঙা শাসনের মধ্যেই দু’পাশের আপেল উইলো গাছগুলোয় পাতা ঝরা শুরু হবে। ইস্কুল যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়াতে হবে শিশুদের। দাওয়া টিউবওয়েল বসানোর স্বপ্ন নিয়ে ভোটবাবুদের দিকে তাকাবেন কাশ্মীরবাসী। ফিরন, পশমিনা, আখরোট কাঠের গয়না বাক্স, মনোহর সুগন্ধের তেল, শুকনো ফলের দোকানি সুদিন কাছে আসার স্বপ্ন দেখে যাবেন। বেয়নেটকে তোয়াক্কা না করে ভালবাসার স্বপ্ন দেখবে ডেনিম যুবক-যুবতী। দেখবেন নিজের পরিচয় ফিরে পাওয়ার স্বপ্নও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy