Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পদ্মের পরাভবে কোন বার্তা
Mamata Banerjee

আঞ্চলিক দলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় মমতার সক্রিয়তা আরও বাড়বে

জোট দানা না বাঁধলে এবং নরেন্দ্র মোদী সেই পরিস্থিতির ‘সদ্ব্যবহার’ করার পথ পেয়ে গেলে মমতার দিকে আঙুল তোলার লোকেরও অভাব হবে না।

বিজয়ী: ভবানীপুর উপনির্বাচনের ফল বেরোনোর পর তৃণমূল কংগ্রস সমর্থকদের উল্লাস, ৩ অক্টোবর।

বিজয়ী: ভবানীপুর উপনির্বাচনের ফল বেরোনোর পর তৃণমূল কংগ্রস সমর্থকদের উল্লাস, ৩ অক্টোবর। ছবি: সুমন বল্লভ

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২১ ০৬:৫৭
Share: Save:

ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় নিয়ে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরও বোধ হয় কোনও সংশয় ছিল না। নজর ছিল ব্যবধানের দিকে। প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৭২ শতাংশ পেয়ে সেই আগ্রহের অবসান ঘটিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। মাত্র হাজার সাতেক ভোটের সুবাদে জমানত রাখতে পেরেছে বিজেপি।

গত বিধানসভা ভোটের ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় তিনটি কেন্দ্রের উপনির্বাচন এটাও বুঝিয়ে দিল, রাজ্যে বিজেপির অবস্থা আরও সঙ্গিন। জনসমর্থন পদ্ম পাতায় জলবিন্দুর মতোই টলমলে। আর মার্ক্সবাদী সিপিএমের তো সত্যিকারের জীবনসংগ্রাম! অন্তত এখন এটাই বাস্তবতা।

অতএব তৃণমূলে ঢোকার বা ফিরে আসার লাইন লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। যার আভাস মিলছে। মানুষের মনেও সাধারণ ভাবে এই ধারণা পোক্ত হবে যে, রাজ্যে মমতা ও তাঁর দল আপাতত বিকল্পহীন। পুজোর পরে আরও চারটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন তাই বিজেপির চাপ বিলক্ষণ বাড়িয়ে দিল।

মুখরক্ষার্থে শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা অবশ্য আগে থেকেই বলতে শুরু করেছেন, নন্দীগ্রামের ক্ষত ভবানীপুর দিয়ে কোনও দিন ঢাকা যাবে না। নন্দীগ্রামের ভোট-মামলা বিচারাধীন। তবু এইটুকু বলা যেতে পারে, সেখানে মমতার পরাজয়ের ব্যবধান ছিল দু’হাজারেরও কম। আর ভবানীপুরে গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর জয়ের যে ব্যবধান ছিল, এ বার মমতার ক্ষেত্রে চার শতাংশ ভোট কম পড়া সত্ত্বেও তা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

রাজনীতির বহতা স্রোত এ ভাবেই এগোয়! হ্যাঁ, ক্ষত পুরোপুরি মোছে না ঠিকই, তবে গভীরতা হ্রাস পায়। ’৮৯-এর লোকসভায় যাদবপুর কেন্দ্রে মমতার পরাজয় বা ’৮২-র বিধানসভা ভোটে কাশীপুর থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হেরে যাওয়া নিয়ে আজ ক’বার লোক চর্চা করেন? একাধিক বার পরাজয়ের ইতিহাস কি শুভেন্দুরও নেই? কিন্তু আজ তো তিনি বিরোধী দলনেতা— সংসদীয় প্রথায় কার্যত তিনি ‘শ্যাডো চিফ মিনিস্টার’!

নন্দীগ্রামে লড়ার সিদ্ধান্ত অবশ্য মমতা নিয়েছিলেন চকিতে। শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার পরে যে দিন তৃণমূল নেত্রী প্রথম নন্দীগ্রামে যান, তার আগের দিন ওই ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। ভবানীপুর রাখবেন কি না, সেটা নিয়েও তখন দোলাচল ছিল। এমনকি, পরের দিন ঘোষণা করার বিষয়টিও সে ভাবে স্থির ছিল না। মনে আছে, আমার যে সহকর্মী নন্দীগ্রামে মমতার ওই সভা রিপোর্ট করতে গিয়েছিলেন, তাঁকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলাম, মমতা খুব সম্ভবত নন্দীগ্রামে লড়বেন।

আবার পরে বুঝেছি, মমতা নিজেই এক সময় অনুভব করতে পেরেছিলেন, ভবানীপুর ছেড়ে শুধু নন্দীগ্রামে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি হয়তো সে দিন ঠিক করেননি। তাঁর মতো দুঁদে রাজনীতিকের এই অনুভব বড় কম কথা নয়! কেন তিনি এমন ভেবেছিলেন, মামলা চলাকালীন সেই আলোচনাও অনুচিত।

কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রাখলে পরিষ্কার হয়ে যায়, এ বারের ভবানীপুর মমতার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল কেন। বড় ব্যবধানে জয় না পেলে মুখ্যমন্ত্রী থেকেও তাঁর একটা খোঁচা রয়ে যেত। আর শুধু রাজ্যেই নয়, তার প্রভাব পড়ত বৃহত্তর বিরোধী মঞ্চেও। ভবানীপুর তাঁকে ‘নিরাশ’ করেনি।

বিজেপির দিক থেকে পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। ভবানীপুর কেন্দ্রে বহু ভাষাভাষীর বাস। তার মধ্যে গুজরাতি, শিখ, সিন্ধি, মরাঠি, রাজস্থানি থেকে শুরু করে বিহার, ওড়িশার মানুষও আছেন। তাঁরা বহু দিন এখানকার ভোটার। অ-বঙ্গভাষী ওই ভোটারকুলের সিংহভাগকে বিজেপি এত দিন ‘আস্থাভাজন’ বলে হিসাব কষে এসেছে। প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়ালকে প্রার্থী করার পিছনেও ওই ভাবনা কাজ করেছিল বললে খুব ভুল হবে না। তথাপি সেই ভোটও বিজেপি এ বার টেনে আনতে পারেনি।

বস্তুত, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ভবানীপুরে সংখ্যালঘু-প্রধান দু’টি ওয়ার্ড বাদ দিলে বাকি ছ’টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। এর কারণও সহজবোধ্য। আবার গত বিধানসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে তৃণমূল ছ’টি এবং বিজেপি দু’টি ওয়ার্ডে জিতলেও জয়ের ব্যবধান বুঝিয়ে দেয়, অ-বঙ্গভাষী ভোটের একটি ভাল ভাগ পেয়েছিল বিজেপি।

এ বার সেটাই হল না। ফল বিশ্লেষণ করলে প্রাথমিক ভাবে এই পর্যবেক্ষণ সামনে আসে।

তৃণমূল এ বার আটটি ওয়ার্ডেই জিতেছে। তাতে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকাগুলির ‘বিরাট’ ভূমিকা থাকা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল, অন্য দিকের অ-বঙ্গভাষী এলাকাগুলিতেও বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি কেন? গুজরাতি, মারোয়াড়ি প্রমুখ ভোটার যদি অধিক সংখ্যায় ভোট দিতে না-বেরিয়ে থাকেন, বা তাঁদের অধিকাংশ যদি মোদী-শাহের ‘পদ্ম’ ছেড়ে মমতার জোড়া ফুলে বোতাম টিপে দিয়ে আসেন, তা হলে বিজেপির পক্ষে তা কত দূর ‘শুভ’ সঙ্কেত, সময় বলবে।

এ কথাও ভুললে চলবে না, শুধু ভবানীপুরের জন্য ৩৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। বিজেপির তোলা রিগিংয়ের কোনও অভিযোগ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। বরং বিজেপির এক নেতা অন্য একটি দলের পরিচয়পত্র নিয়ে ‘অনুমোদনহীন’ একটি গাড়িতে এলাকায় ঢুকে জটিলতা বাড়িয়েছিলেন। সব মিলিয়ে তাই পরাজয়ের পিছনে বিজেপির যুক্তি খোঁজার জায়গাগুলিও এই ভোটে বেশ দুর্বল।

ভবানীপুর ছাড়া বাকি দুই কেন্দ্র জঙ্গিপুর ও সমশেরগঞ্জের উল্লেখও এ ক্ষেত্রে একটু প্রাসঙ্গিক। কারণ, ওই দু’টিতেও বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারেনি। সমশেরগঞ্জে প্রত্যাশিত ভাবেই কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থানে এবং জমানত খুইয়ে বিজেপি তৃতীয়। আর জঙ্গিপুরে জয়ী তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির ব্যবধান প্রায় ৯৩ হাজার। বলা বাহুল্য, এগুলি মমতার ‘ক্ষমতা’ হিসাবেই মান্যতা পাবে।

কিন্তু এ সব হল রাজ্য-রাজনীতির কথা। জাতীয় রাজনীতিতে মমতার অবস্থান এর ফলে আগামী দিনগুলিতে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এবং কী ভাবে, তা আজ খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি। কেননা ভবানীপুরের জয় থেকেই মমতা তাঁর ‘ভারত-অভিযান’ শুরু করতে চান।

মমতাকে যাঁরা জানেন, তাঁরা মানবেন যে, তাঁর আত্মবিশ্বাস প্রবল। নানাবিধ চাপের মুখে বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে কোণঠাসা করে দেওয়ার পরে সেটা আরও বেড়েছে। বাকি ছিল নিজের জয়। তা-ও সম্পূর্ণ। অতএব পর পর জয়ের দৃষ্টান্ত সাজিয়ে মমতা দাবি করছেন, বাংলায় তাঁরা একাই একশো! জাতীয় স্তরে আঞ্চলিক দলগুলির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বরাবর আগুয়ান তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে এটা তো কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি! সুতরাং তিনি ‘স্বধর্ম’ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, এমনটা নয়। আসলে এটাই তাঁর ভারত-বার্তা।

তবে তা করতে গিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার দূরত্ব যে ভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে বিরোধী জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সংশয়ী। এমনকি জোট দানা না বাঁধলে এবং নরেন্দ্র মোদী সেই পরিস্থিতির ‘সদ্ব্যবহার’ করার পথ পেয়ে গেলে মমতার দিকে আঙুল তোলার লোকেরও অভাব হবে না। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব প্রকাশ ও বাছাই করা বিশেষণ ব্যবহার করে তৃণমূল সেই পরিসর তৈরি করে দিচ্ছে, এটা ঘটনা।

তা বলে বাদবাকি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেতারা সকলে কংগ্রেস-অনুগত, এমনটাও কি জোর দিয়ে বলা যায়? শরদ পওয়ার, অখিলেশ যাদব থেকে স্ট্যালিন, শিবসেনা, ফারুক আবদুল্লা, দেব গৌড়া— কে কতটা ‘উদার’ হয়ে হাত বাড়িয়ে দেবেন? এখনও সেটা বোঝার সময় আসেনি।

যদি অন্য সবাই কংগ্রেস অর্থাৎ রাহুল গাঁধীকে বিরোধী জোটের সর্বসম্মত নেতা মানেন, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করবেন, বলা শক্ত। কিন্তু সেটা না-হলে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা নানা দিক থেকে অর্থবহ হওয়ার সম্ভাবনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE