E-Paper

নিজের তৈরি বিপদ

আইবিএম-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যন্ত্রমেধা-পরিচালিত ডিজিটাল প্রয়োগ এবং যন্ত্র নিজের থেকে অধিকাংশ বস্তু দেখতে এবং শনাক্ত করতে পারে।

শৈবাল কর

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৯

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা যন্ত্রমেধা নিয়ে চারিদিকে ভয়ানক হইচই চলছেই। বিবিধ প্রতিবেদনে যন্ত্রমেধা সংক্রান্ত আশা এবং আশঙ্কা প্রকাশিত হয়ে চলেছে নিয়মিত, যদিও দ্বিতীয়টিই বেশি— দু’-ধরনের আলোচনাই মানুষকে যথেষ্ট উদ্বেল করেছে। যদি এমন মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে যে, যন্ত্রমেধার কারণে অনেক দেশেই লাভের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি, তা হলে সরকারি নীতিতে যন্ত্রমেধা সম্বন্ধে অবস্থান ঠিক কী, তা নিয়ে প্রশ্ন করা প্রয়োজন।

একটি দেশে বেসরকারি ক্ষেত্র ইচ্ছেমতো যন্ত্রমেধা ব্যবহার করতে পারে কি না, সে বিষয়ে কিছু আইনি বিধিনিষেধও থাকা উচিত— কারণ এর ধাক্কায় যে বহু মানুষের রুজি-রোজগার প্রভাবিত হচ্ছে, তা এত দিনে স্পষ্ট। এর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান তো বটেই, বেসরকারি ক্ষেত্রকেও অনেক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে দেশ-বিদেশে। একটি প্রতিষ্ঠান যখন নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিপন্থী কিছু করে থাকে— যেমন ধরা যাক, তলায় তলায় অন্য কোম্পানি কিনে নেওয়া, অথবা নিজেদের উৎপাদনের সঙ্গে অন্য কোনও ক্ষেত্রকে সংযুক্ত করে একচেটিয়া কারবার করা— তখন কিন্তু অনেক আইন প্রযোজ্য হয়। যন্ত্রমেধা ব্যবহার অনেক সংস্থাকে অন্যায্য সুবিধা দেবে— অবৈধ না হলেও এতে যে সুস্থ প্রতিযোগিতা বাধা পাচ্ছে, বিশেষত স্টার্ট-আপ নামের নতুন ব্যবসাগুলো সবচেয়ে নড়বড়ে অবস্থার মুখে পড়ছে, এটা সরকারের নজর এড়িয়ে যেতে পারে না।

আইবিএম-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যন্ত্রমেধা-পরিচালিত ডিজিটাল প্রয়োগ এবং যন্ত্র নিজের থেকে অধিকাংশ বস্তু দেখতে এবং শনাক্ত করতে পারে। যন্ত্রমেধার মধ্যে যে কৃত্রিম বুদ্ধি প্রোগ্রাম করে দেওয়া হচ্ছে, তার সাহায্যে এর প্রয়োগগুলো মানুষের ভাষা বুঝতে পারে, এবং যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। নতুন তথ্য এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারার ক্ষমতায় এগুলো মানুষের চেয়ে এগিয়ে থাকবে, সেটাও স্বাভাবিক। শুধুই যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে ক্রমাগত বিশ্লেষণ করার কাজ মানুষের পক্ষে ক্লান্তিকর হতে পারে, কিন্তু যান্ত্রিক বুদ্ধির কাছে তা নয়। যন্ত্রমেধার আরও ক্ষমতা হল যে, এর প্রয়োগগুলো ব্যবহারকারী এবং বিশেষজ্ঞদের কাছে জীবনযাত্রার পরিকল্পনা থেকে কোথায় বিনিয়োগ করবেন, সব ব্যাপারেই বিস্তারিত সুপারিশ করতে পারে। বিভিন্ন কল্পবিজ্ঞানের গল্পে যেমন পড়া যায়— সত্যজিৎ রায়ের ‘কম্পু’র কথা মনে করা যেতে পারে— এক দিন কৃত্রিম বুদ্ধি তার স্রষ্টাকেই ছাপিয়ে যাবে, তার প্রকাশ এখন চাক্ষুষ। যন্ত্রমেধা যত তথ্য এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাধ্যমে শক্তিশালী হবে, মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ততই ফুরিয়ে যাবে তার কাছে। যন্ত্রমেধা দিয়ে যদি গাড়ি বা ট্রেন চালানো যায়, তা হলে মানুষের প্রয়োজন আর প্রশ্নাতীত থাকে কি?

সুতরাং, যন্ত্রমেধার কারণে কর্মক্ষেত্রে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, এই আশঙ্কা যদি অমূলক না হয় তা হলে সাবধান হতে হবে কর্মীদের। যন্ত্রমেধা ব্যবহার যেখানে প্রসার লাভ করেছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে, মালিকের সুবিধা হচ্ছে— কারণ এককালীন খরচের সাহায্যে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের কর্মী সমস্যা এর দরুন অনেকটা মিটিয়ে ফেলা যায়। সে ক্ষেত্রে কাজের বাজারে কী হতে পারে, সেটা অনুমেয়। অথচ, মানুষের তৈরি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে আটকাতে অধিকাংশ মানুষের কী করা উচিত, সে আলোচনা তেমন চোখে পড়ছে না। মনে রাখতে হবে যে, যন্ত্রমেধা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার প্রোগ্রাম যারা লিখেছেন তাদের খণ্ড খণ্ড জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা মিশিয়ে আজকের যন্ত্রমেধা অবয়ব পাচ্ছে। একে অদৃষ্টের পরিহাসও বলতে পারেন— কারণ যন্ত্রমেধা প্রথমেই প্রায় ৪০% কম্পিউটার বা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর চাকরি খাবে। যাঁরা পিছন থেকে সাপোর্ট দিয়ে থাকেন কম্পিউটার ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রয়োগে, তাঁদের কাজ যন্ত্রমেধা করতে পারবে অনেক কম সময়ে, প্রায় নির্ভুল ভাবে। মাঝারি দক্ষতার এবং বয়স্ক কর্মীকে অপ্রয়োজনীয় মনে করবে বেসরকারি ব্যবসা। হিসাবরক্ষকদের কাজ যাতে যন্ত্রমেধা-নির্ভর কম্পিউটার করে দিতে পারে, তার জন্যে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করছে বৈশ্বিক সংস্থাগুলি। অনেক আইনি চুক্তি নির্ভুল ভাবে লিখে দেবে যন্ত্রমেধা। মিডিয়ার ৩৫% কাজও নাকি আগামী ১০ বছরে এআই করতে পারবে মানুষের সাহায্য ছাড়াই।

গোটা শ্রমবাজারে কি তা হলে শুধুই ধ্বংস? নতুন কাজ সৃষ্টি হবে না? কিছু তথ্য বলছে, পৃথিবীতে বছরে এক কোটি কাজ হারিয়ে যাবে আর সত্তর লক্ষ সৃষ্টি হবে। তবে যা সৃষ্টি হবে, সেখানেও তুলনামূলক সুবিধা পাবেন তাঁরাই, যাঁরা যন্ত্রমেধা-নির্ভর কাজের পদ্ধতি জানেন। অবশ্য, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের একটা সুবৃহৎ অংশ অসংগঠিত, সামান্য কারিগরি দক্ষতার উপরে নির্ভর করে অনেক কিছু উৎপাদন করে থাকে; রয়েছে বিরাট কৃষিক্ষেত্রও। এই উৎপাদন বা পরিষেবা চট করে কৃত্রিম বুদ্ধির হাতের পুতুল হবে না, অন্তত সরাসরি।

আশার কথা এই যে, সব ব্যবসাই যে কোনও অবস্থায় যন্ত্রমেধার সঙ্গে সম্পর্কিত, তা নয়। কে বেশি প্রভাবিত, তা স্থির করার সহজ হিসাব হল বিশ্বায়নের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নির্ণয় করা। অর্থাৎ, বৈদ্যুতিন মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে যে অর্থব্যবস্থা, উৎপাদন আর পরিষেবা তাতে অংশগ্রহণ করে কি না। এই ব্যবস্থার কোনও কোণে যদি ব্যবসার ডিজিটাল পদচিহ্ন পড়ে থাকে, তা হলেই তা অন্তর্গত। যে-হেতু ইন্টারনেটের সংযোগ সব দেশে এক রকম নয়, দামেরও হেরফের আছে দেশভিত্তিক, ফলে কত জন অন্তর্গত আর কারা নয়, তার দেশভিত্তিক বিন্যাসেও পার্থক্য আছে। যেমন ভারতে এত ডিজিটাল বিপ্লবের পরেও মাত্র ১৫ শতাংশ উপভোক্তার কাছে ইন্টারনেটের সরাসরি লাইন মারফত যোগাযোগ রয়েছে। অবশ্য মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার ধরলে এই সংখ্যা হয়ে যায় ৪৫ শতাংশ। তুলনায় চিন, আমেরিকায় উপভোক্তা ৯০ শতাংশের উপরে। ইউরোপের উন্নত দেশে ১০০ শতাংশ।

পরিকাঠামোয় অভাব থাকলে ব্যবসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রমনির্ভর পদ্ধতি ব্যবহার করে, পুঁজি বা উন্নত কারিগরির পরিবর্তে। সুতরাং, যত ক্ষণ না ছোট বা মাঝারি ব্যবসা যন্ত্রমেধা ব্যবহার করার মতো অবস্থায় পৌঁছচ্ছে, তত ক্ষণ কোটি কোটি স্বল্প দক্ষতার কর্মীর কাজ হারানোর আশঙ্কা ক্ষীণ। আশঙ্কা নেই স্কুল কলেজ শিক্ষকদেরও। যে কাজে শুধু যান্ত্রিকতার সাহায্যে মানুষের মনের গভীরে পৌঁছনো যায় না বা তার বিশ্বাস অর্জন করা যায় না, সে কাজে যন্ত্রমেধার দক্ষতা তৈরি হতে এখনও সম্ভবত বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। পারবে যন্ত্রমেধা এক জন নার্সের মতো সহমর্মিতা দেখাতে? যন্ত্রের হাত দিয়ে কঠিন অস্ত্রোপচার করে দিচ্ছে এআই-নির্ভর রোবট, কিন্তু সেবার ভাষা তার জানা আছে কি? যাঁরা বিভিন্ন যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করেন কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে দৈহিক পরিশ্রম মিশিয়ে, তাঁদেরও ভয় নেই যন্ত্রমেধাকে। মানুষের আদালতে বিচার ব্যবস্থারও কোনও বিকল্প হয় না— যন্ত্রমেধাকে মানুষের মনের ভাষা সম্পূর্ণ শিখতে হলে রক্তমাংসের শরীর ধারণ করতে হবে।

শেষ অবধি কর্মীদের একটা কথা মনে রাখতে হবে। আজ যদি তাঁরা নিজেদের কাজে ফাঁকি দেন, যদি গ্রাহকের মনে তাঁদের প্রতি অসন্তোষ থাকে, তা হলে কাল তাঁরা সেই মানুষ কর্মীদের বদলে যন্ত্রমেধার দেওয়া পরিষেবা চাইবেন। মানুষের তখন ছুটি। এই পরিস্থিতি মানুষ আটকাতে পারে যথেষ্ট সচেতন হলে তবেই।

অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

AI Artificial Intelligence

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy