সময়-সময় আমাদের অনেকেরই মনে হয় যে এমন একটা ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’-এর মধ্যে আটকে পড়েছি, এবং নিজের ইচ্ছা বা স্বার্থবুদ্ধির বশে জড়িয়েও গেছি যে, ব্যবস্থাটা আমাদেরই বিচারে আমাদের সমগ্রের ভবিষ্যতের জন্য ভাল নয়। এই অনুভূতির উৎস হয়তো ধার্মিক চিন্তায়। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতটি স্মরণ করুন: “আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।” এখানে অবশ্যই ব্যবস্থা বলতে মানুষের সংসার, যা বহু বাসনার নিত্য জন্ম দিয়ে আমাদের ইচ্ছার দাসে পরিণত করে। আবার আমরা এটাও বুঝি যে এই সব ইচ্ছা, লোভ, বাসনা ছাড়া মানুষের সংসার চলে না। এই দ্বন্দ্বের অবস্থাটাকে রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে ‘অতি-ইচ্ছা’ ও ‘আধা-ইচ্ছা’র ‘সঙ্কট’ বলে আখ্যায়িত করে প্রার্থনা করছেন, ঈশ্বরের ‘কঠোর কৃপা’ যেন তাঁকে এই সঙ্কট থেকে মুক্ত করে। ইচ্ছাটা একই সঙ্গে ‘আধা’ এবং ‘অতি’ কেন? সাংসারিক যশ, প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা ইত্যাদি ‘প্রাণপণে’ চাই বটে, তবু মনের মধ্যে এই সব ইচ্ছা থেকে একটা দূরত্ব বোধ করি, কারণ নিজের বিচারবুদ্ধিতে বুঝি যে এই সব বাসনা দীর্ঘমেয়াদি চিন্তায় অন্যের জন্য বা এমনকি আমার জন্যও ভাল নয় (সাধারণ উদাহরণ: প্লেনে চড়া। প্লেনে চড়া পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির সমস্যা বাড়ায়, তবু নিজের ইচ্ছায় ও স্বার্থে চড়ি)।
বাইবেল ও কোরানে এই দ্বন্দ্ব ও তা থেকে মুক্তির ভাবনাটা একটি রূপকার্থের গল্প দিয়ে বলা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মের অন্যতম মসিহা য়োনাহ্ বা ইসলামের ইউনুস নবিকে এক বার একটি বিরাট মাছ গ্রাস করেছিল, তখন তিনি ওই মাছের পেটের ভিতরে বসেই ঈশ্বরের কাছে ক্রমাগত প্রার্থনা করে মাছটির উদর থেকে রক্ষা পান। একটি ইসলামি গানে আছে, “যখন ইউনুস নবীরে খাইল মাছেতে গিলিয়া/ ফেরেশতা পাঠাইলে তখন ইসমে আজম দিয়া/ দমে দমেতে হরদম/ প’ড়ে সে ইসমে আজম/ এই মাছের উদর হতে শেষে পেল পরিত্রাণ।”
বাইবেলের এই গল্পটি থেকেই ইংরেজিতে একটি সাধারণ বাক্য চালু হয়েছে, ‘দ্য বেলি অব দ্য বিস্ট’। আজ যখন সুবিধাভোগী শ্রেণিভুক্ত আমরা বাজারি দুনিয়ার ও মানুষের খাই-খাই সংসারের রমরমার বাইরে কেউই নই, তখন আমাদের সেই দুনিয়ার— এবং তার ভিত্তি ধনতন্ত্রের— সমালোচনাও ওই ‘বেলি অব দ্য বিস্ট’-এর মধ্যে বসেই করতে হয়। এই যে কোনও একটা বৃহৎ ব্যবস্থায় আটকা পড়েও নিজেকে তার থেকে মনে মনে দূরে রাখার চেষ্টা: ‘আমার যেমন বেণি তেমনি রবে চুল ভিজাব না’-গোত্রের মনোভাব। এর উৎপত্তি হয়তো মানুষের ধর্মীয় সাধনায়, কিন্তু মনোভাবটি এখন যে কোনও আধুনিক সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিরও ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও এক সমাজতান্ত্রিক ভগবানের কাছে যেন বলি, যে বাজারের মধ্যে আমিও আকণ্ঠ ডুবে আছি, স্যর, কিন্তু দেখবেন, ‘চুল ভিজাব না’! সমাজতত্ত্বের ভাষায় একে বলি, ‘অ্যানালিটিক্যাল ডিসট্যান্স’ তৈরি করা। খুব কষ্ট না করেও আধুনিক ধনতন্ত্রের দোষগুলো ধনতন্ত্রের মধ্যে বসেই সাদা চোখে দেখা যায়— আর্থিক বৈষম্য, আজকের অতি-ধনীদের অতি-ক্ষমতা, ভোগবাদের মাত্রা ছাড়ানো চেহারা, অন্য দিকে অনেক মানুষের সার্বিক দুর্দশা। মানি যে, শিক্ষিত সমাজে এখনও কতিপয় ‘রামকানাই’-এর মতো ‘নির্বুদ্ধি’ মানুষও আছেন, তবে সাধারণ ভাবে বলা যায় যে আজকের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা অনেকেই ‘মাছের উদর’-এর মধ্যে থেকে করেন। ‘চুল ভিজাব না’ তাঁদের বিশ্লেষণী ভঙ্গি। তাঁরা কিন্তু ভণ্ড নন।
সমালোচনামূলক চিন্তার গোড়ার কথাটি: বিশ্লেষণী দূরত্ব। আজ যেন একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাজারি ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের অতি-সম্প্রসারণ এবং তার সঙ্গে জড়ানো মানুষের ইতিহাসের একটি সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে চিন্তকরাও মতাদর্শ-নিরপেক্ষ ভাবে এমন জড়িয়ে গেছেন, ঘটনার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বজায় রাখার সেই পুরনো ‘স্ট্র্যাটেজি’ বা কায়দা— ‘চুল ভিজাব না’— আজ আর ভাল কাজ করে না।
মানুষের ইতিহাসে এই নিতান্ত সাম্প্রতিক পরিবর্তনটি হল মানুষের দীর্ঘায়ু হওয়া। আজকাল যখন শুনি কারও বয়স পঁচানব্বই বা প্রায় একশো, আমরা অবাক হই না। মানুষের আয়ু ও সংখ্যা আমাদের চোখের সামনে বেড়েছে, অনেকটাই আমার জীবৎকালে। ১৯০০ সালে পৃথিবী জুড়ে মানুষের সংখ্যা ছিল ১.৬ বিলিয়ন, দুম করে ২০০০-এ ৬ বিলিয়ন, এখন ৮ বিলিয়ন, বিশেষজ্ঞরা বলেন আগামী কয়েক দশকে বেড়ে নয় কি দশ বিলিয়ন হয়ে তার পর হয়তো কমতে শুরু করবে (সে অন্য প্রসঙ্গ)। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর বা তার নীচে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ছিল ৪৫ থেকে ৫০। এই আয়ু ও সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি, খাদ্যের জোগান, শিশুমৃত্যু ও প্রসূতিমৃত্যুর হার হ্রাস, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে বয়স্ক মানুষের জীবন প্রলম্বিত করার নানা খরচসাপেক্ষ ব্যবস্থার উদ্ভাবন। মানুষ কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে, পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘায়ু হয়নি। হয়েছে সম্পূর্ণ ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে— যেমন ১৯২৮ সালে আলেকজ়ান্ডার ফ্লেমিং-এর অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার, যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে অসংখ্য প্রাণ বাঁচিয়েছে।
বেশির ভাগ সম্পন্ন মানুষের বুড়ো বয়সে মৃত্যু, মানুষের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সাম্প্রতিক ঘটনা। অথচ দক্ষিণপন্থী থেকে বামপন্থীদের নানা আলোচনায় দেখছি, মানুষের ‘দীর্ঘায়ু’ যেন একটা স্বাভাবিক অধিকার (ন্যাচরাল রাইট) হয়ে উঠেছে। বিল গেটস থেকে অমর্ত্য সেন, মার্থা নুসবম, মার্ক্সবাদী চিন্তক, এমনকি যাঁরা মানুষের অর্থনীতির সঙ্কোচন চান তাঁরাও মনে করেন যে ভবিষ্যৎ যা-ই হোক, দীর্ঘ আয়ু পাওয়া এখন মানুষের একটি ‘হক’।
চিন্তার সমস্যাটা এখানে। মানুষ যদি ফসিল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি পুড়িয়ে সস্তায় শক্তি, বিশেষত বিদ্যুৎ আহরণ করতে না পারত, তা হলে এত মানুষকে এক সঙ্গে বাঁচিয়েও রাখা যেত না, আর মানুষকে এত দীর্ঘায়ুও করা যেত না। রাসায়নিক সারের কথাই ভাবুন, যার উপাদান হিসাবে অ্যামোনিয়া তৈরি করতে গিয়ে জীবাশ্ম-জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে। কানাডার বিশিষ্ট পণ্ডিত ভাকলাভ স্মিল-এর মতে, আজকের কৃষিতে এই রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলে পৃথিবীর শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ অনাহারে মারা যাবে। শুধু রাসায়নিক সারের ব্যবহারই নয়, এখন মানুষ যে পরিমাণ গরু, ভেড়া, ছাগল, মুরগি, মাছ খেতে চায়, পৃথিবী নিজে নিজে এত গরু, ছাগল, মুরগি তৈরি করে না। এই সব জন্তু, পাখির জীবনকে শিল্পায়নের আওতায় এনে মানুষই ‘ফুড ইন্ডাস্ট্রি’ তৈরি করেছে।
আজকের সবচেয়ে সংখ্যাবহুল পাখি, মানুষের তৈরি ব্রয়লার চিকেন। মাছ বহু দিন পর্যন্ত এই ‘ফার্মিং’-এর বাইরে ছিল, এখন অনেক মাছ যা আমরা খাই তা ‘চাষ’ হয়ে আসে। তা ছাড়া, একটি শিশুর জীবনে ত্রিশ বছর মোটামুটি সস্তায় যোগ করা যায়— জনস্বাস্থ্য, ওষুধপত্র, চিকিৎসার জোগান দিয়ে। কিন্তু এক জন পঁচাত্তরের মানুষকে পঁচানব্বই পর্যন্ত টানতে অনেক দামি প্রযুক্তি লাগে, উদ্বৃত্ত সামাজিক ‘ধন’ লাগে। আমরা ধরেই নিই যে মানুষের আধুনিক সভ্যতা যত গণতান্ত্রিক হবে, ততই বেশি বেশি মানুষ— হয়তো এক দিন সবাই— দীর্ঘায়ু হবে, এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় ‘এনার্জি’ বা শক্তি আহরণ করার মতো প্রযুক্তি মানুষ তৈরি করবেই!
এক বার আয়ু বাড়াতে পেরে আমরা কেউই এখন চাইব না, মানুষের আয়ু আবার কমে যাক! আগামী কয়েক দশক ধরে মানুষের সংখ্যা বাড়বে, মানুষ হিসাবে এদের অকালমৃত্যুও আমরা কেউই চাইব না। অথচ, এ পর্যন্ত মানুষের আয়ু বাড়ানোর যে সব ব্যবস্থা হয়েছে, তা যে মানুষের বর্তমান ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ধরে নিয়ে— পৃথিবীর জীববৈচিত্র ধ্বংস করে, পরিবেশের পক্ষে যে তা ধ্বংসকারী তার কথাও বিজ্ঞানীরা বলছেন। স্থানাভাবে সে আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের চিন্তায় আমরা কেমন প্যাঁচে পড়েছি দেখুন— জীববৈচিত্র সাধারণ ভাবে প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখে, তা ধ্বংস হলে তার পরিণতি আমাদের জন্য ভাল নয়; আবার মানুষ হিসাবে ‘মানুষের আয়ু কমে যাক’ এ কথা বলার চেয়ে ‘শুধু আমার নয়, সকলেরই আয়ুবৃদ্ধি হোক’ ভাবা ও বলা অনেক সহজ। চিন্তায় এখানে পৌঁছে দেখছি, ‘চুল’ না ভেজানোর কায়দা আর কাজ করছে না। আজকের ‘ক্রিটিক্যাল’ চিন্তার একটি গভীর বিপত্তিরই যেন এটি একটি তাৎপর্যময় চিহ্ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)