E-Paper

‘পুরুষলোক’-এর বিপন্নতা

‘পুরুষলোক’-এ প্রবেশাধিকার না পেয়ে মুষড়ে পড়ছেন বহু পুরুষ, নিজেকে ব্যর্থ মনে করে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন, এমনকি অস্তিত্বের সঙ্কটেও ভুগছেন।

প্রহেলী ধর চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৫ ০৫:৩৩

পুরুষ হিসাবে শ্রেষ্ঠ কে, সমাজমাধ্যমে তার একটি উত্তর তৈরি হয়েছে। ‘ম্যানোস্ফিয়ার’ বা ‘পুরুষলোক’ নামক একটি পরিসরেপ্রবেশাধিকার আছে যাঁদের, তাঁরাই পুরুষশ্রেষ্ঠ। অর্থ, পেশিশক্তি আর বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করার ক্ষমতার মতো অতি প্রাথমিক দু’তিনটি উপাদানই সেখানে পৌরুষের মাপকাঠি। এই সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত পুরুষের সংজ্ঞাকে সঙ্কুচিত করছে আরও বেশি আর্থিক সাফল্যে, পেশিবহুলতায়, সীমাহীন যৌন ক্ষমতায় কিংবা নারীকে আকর্ষণ করতে পারার সামর্থ্যে। সমস্যা হল, অধিকাংশ পুরুষের পক্ষেই এমন বিত্তবান, বীর্যবান, পেশিবহুল নারীশিকারি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়— বস্তুত, তেমনটা কাম্যও নয়। কিন্তু, সেই ‘পুরুষলোক’-এ প্রবেশাধিকার না পেয়ে মুষড়ে পড়ছেন বহু পুরুষ, নিজেকে ব্যর্থ মনে করে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন, এমনকি অস্তিত্বের সঙ্কটেও ভুগছেন।

এর একটা বড় কারণ হল, রক্ষক আর জোগানদার ছাড়া আর কোনও ভূমিকাতেই পুরুষ অস্তিত্বকে স্বীকার করেনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। সামাজিক অবদমনের ছকেই মেয়েরা মাতা, জায়া, কন্যার মতো একাধিক নামভূমিকায় স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁদের জুটেছে সমাজ-সংসারের নানাবিধ রোল-প্লে করার দায়িত্ব আর সম্মান রক্ষার দায়— পুরুষের সে সুযোগ ঘটেনি। নারীকে অবদমন করতে করতে পিতৃতন্ত্র আসলে পুরুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। তারই ফসল এই ‘পুরুষলোক’— এমন এক ভার্চুয়াল জগৎ, যা বাস্তব পৃথিবী থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত কতকগুলি মিথ্যা ধারণায় বিশ্বাস করায়। বোঝায় যে, একটু চেষ্টা করলেই একেবারে সংজ্ঞায়িত পুরুষ হয়ে ওঠা যাবে। আশা দেখায় যে, নিত্যনতুন মাল্টিভিটামিন আর স্টেরয়েড আসলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন, ছবির মতো পেশিনির্মাণের সহায়ক। শেখায়, কী ভাবে ঠিক-ভুল আর ন্যায়নীতির কাঠামোটাকে খানিক আলগা দিলেই শর্ট কাটে অনেক বেশি রোজগার করা যায়। ভাবতেই দেয় না, দীর্ঘমেয়াদে তার পরিণাম কতখানি ভয়াবহ হতে পারে।

কিন্তু যা আমাকে সংজ্ঞায়িত করে, যার অভাববোধ নিজের কাছে নিজের অস্তিত্বটাকেই অদৃশ্য করে দেয় অবিরাম, তাকে চ্যালেঞ্জ করে গোটা ভাষ্যটাকে উল্টে দিতে না-পারলে, প্রতিনিয়ত সেই একই আবর্তে পাক খেয়ে মরতে হয়। ‘পুরুষলোক’ ঠিক এই কাজটাই করে। নিত্যনতুন চমক দেখিয়ে, চ্যালেঞ্জের ভাবনাটা মনে আসতেই দেয় না। ফলে একটা সময়ের পর ঘোর কাটলে যখন দেখা যায় যে, এত আশা, সময়, শ্রম বা অর্থ বিনিয়োগেও নিজেকে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটি করে তুলতে পারলাম না, তখন অস্তিত্বের সঙ্কট আরও প্রবল, আরও প্রকট হয়ে ফিরে আসে। ‘স্টেট অব আমেরিকান মেন’-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, আজকের দিনের দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছেন। তাঁরা বলছেন, সংসারে এমন এক জনও নেই, যিনি তাঁকে ঠিক ভাবে চিনতে পারলেন।

এই ব্যর্থতার গ্লানি, অস্তিত্বের সঙ্কট সেই ‘ব্যর্থ পুরুষ’কে ঈর্ষান্বিত করে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত বা সফল পুরুষদের প্রতি; আর ধর্ষণাত্মক করে তোলে মহিলাদের প্রতি। এটি বিশ্বাস করায় যে নারীবাদ, লিঙ্গসমতা আর নারী-উন্নয়নের মতো বিষয়গুলিই সংসারে পুরুষের দুরবস্থার প্রধান কারণ। আর এর পরিণাম আমরা দেখতে পাই, পর পর ঘটে যাওয়া নানান অপরাধমূলক ঘটনাপ্রবাহে।

এক দশকেরও বেশি পুরনো উদাহরণ দিই। ক্যালিফোর্নিয়ার আয়লা ভিস্টা অঞ্চলের ২২ বছরের যুবক এলিয়ট রজার প্রথমে খুন করেছিল তার দুই রুম পার্টনারকে; তার পর বন্দুক নিয়ে রাস্তায়— গুলি করল পথচলতি তিন মহিলাকে। এর পর এলোপাথাড়ি গাড়ি চালিয়ে যে সামনে এল, তাকেই পিষে দিল রজার। আত্মহত্যা করার আগে মোট ছ’জনকে হত্যা আর চোদ্দো জনকে গুরুতর জখম করেছিল রজার। ঘটনার কিছু ক্ষণ আগে একটি ইউটিউব ভিডিয়ো বানিয়েছিল সে। তাতে বলেছিল, কোনও নারীই তার প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট নয়; কেউ তাকে পছন্দই করল না, ভালবাসা তো দূর। এই বারংবার প্রত্যাখ্যানের শাস্তি তাদের পেতেই হবে, বলেছিল রজার। এবং, শাস্তি পেতে হবে সেই সব পুরুষকেও, অনেক বেশি ধনী, বলিষ্ঠ কিংবা ক্ষমতাবান। কারণ সবাই তাদের পছন্দ করে, আর সেটাই রজারের এই দুঃসহ জীবনের কারণ। ‘পুরুষলোক’ কী ভাবে ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে পুরুষেরই, এলিয়ট রজারের ঘটনাটি তার মোক্ষম উদাহরণ। এবং, উদাহরণটি ব্যতিক্রমী নয় আদৌ।

সাম্প্রতিক কালে অতি আলোচিত সিরিজ় অ্যাডোলেসেন্স-ও একই গল্প বলে। ১৩ বছরের কিশোর জেমি মিলার হত্যা করে তারই এক সহপাঠিনীকে। কারণ, মেয়েটি তাকে যথেষ্ট ‘পাত্তা’ দেয়নি— সে মারকাটারি সুন্দরী বা আকর্ষণীয় না হওয়া সত্ত্বেও, স্কুলে জনপ্রিয় না হওয়া সত্ত্বেও। অমন সাদামাঠা একটা মেয়ের কাছে প্রত্যাখ্যান ১৩ বছরের কিশোরের কাছে তার পৌরুষের অবমাননা— তার অজানতেই ‘পুরুষলোক’ তার মনের মধ্যে পৌরুষের যে ছবি এঁকে দিয়েছে, এই ঘটনায় আহত সেই পৌরুষই। জেনি শাস্তি দেয় মেয়েটিকে।

রজার কিংবা জেনি এই সমাজেরই সন্তান, যারা জীবন দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের খানাখন্দগুলো আমাদের চোখের সামনে নগ্ন করে যায়। বলে যায় যে, চরম পিতৃতন্ত্র আর পৌরুষের আস্ফালন শুধু নারীসত্তাকে নয়, পুরুষের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Male

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy