আমার কলকাতার সত্তর দশকের স্মৃতি-স্কেপে তিনটে জিনিস জ্বলজ্বল করে। এক, লোডশেডিং-এর কলকাতা। দুই, কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি বা কেএমডিএ-র (তখন সিএমডিএ) খোঁড়াখুঁড়ি, যা থেকে জন্ম নিয়েছিল ‘কাটছি-মাটি-দেখবি-আয়’ নামকরণ। তিন, যুগ যুগ ধরে অর্ধসমাপ্ত দ্বিতীয় হুগলি সেতু, যাকে ‘ঘাড় ধরে গঙ্গাপার’ করাতে চেয়েছিলেন কোনও কবি। কিন্তু আজ বুঝি, ওই ‘কাটছি মাটি’-র আর এক কারিগর ছিল মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট, যার স্মৃতি আমার সত্তা আর কলকাতার ভবিষ্যতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ছিল। সোজা করে বললে, মেট্রো রেল প্রকল্প। দশ বৎসরাধিক ধরে খোঁড়াখুঁড়ির পর কলকাতা মহানগরীতে সারা ভারতে প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো চালু হওয়ার গৌরবের পাশাপাশি আমরা পেয়েছিলাম এক আশ্চর্য শব্দবন্ধ— পাতাল রেল। বাঙালির এক চূড়ান্ত রসবোধসম্পন্ন নামকরণ। কোনও সরকারি বা চাপিয়ে দেওয়া নাম নয়, উল্টে, বাঙালির রোজকার বাচনে এ নাম যেন চালু হয়ে গিয়েছিল প্রায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই। সম্প্রতি অসমর্থিত সূত্রে (সমাজমাধ্যমে!) জানা গেল, সত্যজিৎ রায় নাকি কলকাতার মেট্রোকে বলেছিলেন ‘হেল রেল’— ওই দীর্ঘসূত্রী খোঁড়াখুঁড়ি এবং তজ্জনিত যানজটের ইতিহাসকে মাথায় রেখেই। আর সেই থেকেই নাকি পাতাল রেল শব্দবন্ধের উৎপত্তি।
এই ছোট্ট সূত্রটাই আমার মস্তিষ্কে একটা স্মৃতিকাতরতার ধস নামিয়ে আনল। দেখলাম মেট্রোর প্রথম দিন থেকে আমরা কী ভাবে জড়িয়েছিলাম তার সঙ্গে।
মেট্রো রেলেরই সূত্রে, ‘পাতাল রেল’-এর বাইরেও আর একটা সৃজনশীল নামকরণ স্পষ্ট মনে আছে। ওই দশ বছরের কাটা মাটির পাহাড়ের উপর গড়ে ওঠা একটা গোটা পল্লির অস্তিত্বের কথা বোধ হয় সবার মনে নেই। হঠাৎ গজানো সেই গাঁ কাজ শেষ হওয়ার পরই অদৃশ্য হয়েছিল। সেই গাঁয়ের নামটি যিনি দিয়েছিলেন ‘কাশডুংরি পাতালটিলা’, তিনি যে মহাকর্মা ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই। পল্লিটির লোকেশন ছিল চৌরঙ্গির টাটা সেন্টারের বিপরীত ফুটে, সেখানে শরতে ধবধবে সাদা এক বুক কাশফুল ফুটে থাকার দৃশ্য দেখা যেত, আর নাকি অবরে সবরে অধুনা ঝাড়খণ্ড (তখনও বিহার রাজ্যের অংশ) থেকে আগত শ্রমজীবী মানুষের নাচগানের দৃশ্যও। এই সব কাব্যময় সমসাময়িক চটজলদি নামকরণ, এর পিছনে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধির ধারণা— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো কবিদের যথেষ্ট অবদান থাকার কথা। এই সব চুটকি খবরের সূত্রও ছিল সম্ভবত আনন্দবাজার পত্রিকাই, যেখানে এই দুই জন কবির ক্রিয়াশীলতা ছিল অনিবার।
এ প্রসঙ্গেই অনিবার্য ভাবে এসে যাবে আর এক গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতির টুকরো। দূরদর্শনে প্রচারিত, লোকসেবা সঞ্চার পরিষদের তৈরি, উস্তাদ ভীমসেন জোশীর সুরারোপে, লুই ব্যাঙ্কস-এর ধ্বনিতে, আর পীযূষ পান্ডের লিরিক্স নিয়ে, ভারতের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-কে তুলে আনার প্রয়াস ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা/ তো সুর বনে হামারা’। এই প্রায় ছয় মিনিটের ভিডিয়োটিতে, বাংলা তথা কলকাতার উপস্থাপন হয়েছিল এক ঝলক নদীমাতৃক বাংলার নৌকাকে ছুঁয়েই, তৎকালীন একেবারে আধুনিকতম মেট্রো রেলের দৃশ্যে। আর ১৯৮৮ সালের এই চিত্রগ্রহণে, মেট্রোর কামরা থেকে নামতে দেখা গেল কাদের? লক্ষ করব, নামছেন তাঁরা ওই অধুনা নীল-পথের সবচেয়ে নান্দনিক স্টেশন রবীন্দ্রসদন স্টেশনেই। নামছেন তৎকালীন কলকাতার ‘হু-জ় হু’। নৃত্যশিল্পী অমলা শঙ্কর ও গায়ক সুচিত্রা মিত্র, কবি-সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন, ফুটবলার চুনী গোস্বামী, সঙ্গীতকার আনন্দশঙ্কর, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ক্রিকেটার অরুণ লাল, ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়, ফুটবলার পি কে, হকিস্টার গুরবক্স সিংহ। আরও দু’-এক জনের পরিচয় আমার অজানা। এই দৃশ্যটি নানা ভাবে বাঙালির কাছে আজও গৌরবের। ঝাঁ-চকচকে মেট্রো রেল আর স্বয়ং রবি ঠাকুরের হাতের লেখা ও আঁকা দিয়ে সাজানো স্টেশনের ছবিটি তো রীতিমতো সাড়া-জাগানোই। আর এক স্বীকৃতি— যে কলকাতা তখন গানের-আঁকার-কবিতার-খেলাধুলার স্বর্গরাজ্য। ওই ক্ষুদ্র গানের কয়েকটি শটের মধ্যে দিয়ে কলকাতা মেট্রো এক অর্থে অমর হয়ে রইল বলাই যায়।
আসলে কলকাতার স্মৃতিস্কেপ, সে এক ‘এস্কেপ রুট’-ও বটে। কী থেকে এস্কেপ? এই যে, উন্নয়নভারে জর্জরিত, বহু ফ্লাইওভারখচিত এক্সপ্রেসওয়ে-অধ্যুষিত কলকাতার পথঘাট, অনেকটা অতিপ্রাপ্তির সঙ্গে পূর্বতন না পাওয়ার অসামঞ্জস্য?
হালে মেট্রো রেলের ঘটেছে অনেক রকম পরিবর্তন। চিরায়তা ব্লু লাইনের সঙ্গে নবাগতা অরেঞ্জ ইয়েলো পার্পল ও গ্রিন লাইনের সংযোগের পর পরই, অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত ভিড় ও-দিকে শ্বাসরোধ করছে যাত্রীর। প্রাচীনা ব্লু লাইনে নাকি ঘটে গিয়েছে ট্রেন-রেকের আকাল, আর তার সঙ্গে অন্যান্য দুর্যোগ মিলে মিশে হয়েছে নিত্য মেট্রোযাত্রীর দুর্ঘট অবস্থা— যদিও জানতে পারছি আপাতত কলকাতা মেট্রো সিস্টেম ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম ও চতুর্থ ব্যস্ততম র্যাপিড ট্রানজ়িট সিস্টেম, এবং এই মুহূর্তে তিয়াত্তর কিলোমিটার মোট দৈর্ঘ্যের লাইনে রেল চলছে।
এই মুহূর্তের গৌরবের নিরিখে প্রাচীন গৌরবটাও কিছু কম ছিল না। আর সেই গর্ব অনুভব করতেই করতেই অনুভব করি, গোটা কলকাতা মেট্রোর ইতিহাস এক অর্থে আমার শহরকেন্দ্রিক জীবন ইতিহাসও বটেই। আমরা সেই প্রজন্ম, যাদের জীবন ভারতের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোর সঙ্গে শুরুর দিন থেকে জড়িয়ে ছিল। আধঘণ্টার পথ কয়েক মিনিটে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ সেই ঝুলন্ত প্রাইভেট বাসের যুগের পক্ষে রীতিমতো আশীর্বাদ ছিল। বাড়ি যে-হেতু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডে, তাই ভবানীপুর (নেতাজি ভবন স্টেশন) থেকে এসপ্ল্যানেড প্রথম মেট্রো লাইনটি ১৯৮৪ সালে চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তাতে চাপা রীতিমতো বার্থরাইট হয়ে উঠল আমার। তখন আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ি। ১৯৮৪-তেই দমদম বেলগাছিয়ার অংশটিও চালু হয়। তার পর ক্রমে ক্রমে টালিগঞ্জ থেকে চাঁদনি চক অবধি বিস্তৃততর লাইন চালু হল। দশ বছরের তফাতে ১৯৯৫-তে টালিগঞ্জ থেকে দমদম টানা মেট্রো চালু হল। আর কবি সুভাষ অবধি টেনে নেওয়া লাইনটির পুরোপুরি চলমানতা তো এই হালে, ২০১০ সালের কথা। এই বাড়তি অংশগুলি মাটির উপরের মেট্রো। কাজেই তা আর পাতাল রেল নয়।
১৯৮৭-৮৮। আমার প্রিয়তম সহপাঠিনী নামত রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে। কলেজ পাড়া থেকে বেরিয়ে, হেঁটে মেট্রো স্টেশনে নামা। তার পর আড্ডা দিতে দিতে কত দিন যতীন দাস পার্ক স্টেশনে নামতে ভুলে যেতাম। আবার পরের স্টেশনে নেমে উল্টোবাগে ফিরে যাওয়া। মেট্রোর পাতালগহ্বর থেকে বেরোলেই নতুন টিকিট কাটতে হবে যে, তাই স্টেশনের ভিতরেই উল্টো দিকের ট্রেন ধরা। সে যুগে আমরা টিকিট কাটতাম লাইন দিয়ে। স্মার্ট কার্ড ছিল না, ছিল হলুদ শক্ত একটা টিকিট। সেই হলুদ টিকিট-সহ, মেট্রোরেল নব্বই দশকের কবিতাতেও সেঁধিয়ে গেল আমাদের। নব্বইয়ের কবি বন্ধুরা লিখলেন মেট্রো রেলের লুব্রিকেটেড মসৃণতার কথা, আমিও লিখলাম পাতালপ্রবেশ-পর্বে সীতার আদলে, মেট্রোগামিনীর গল্প। তার পর একদা লাল-নীল টোকেন নিয়ে নতুন যন্ত্রের খুপরিতে ফেলার দিনকাল এল। বহু পর এল স্মার্ট কার্ড।
শুরুরও তো শুরু ছিল। সেই সলতে পাকানোর সময়েও আমাদের জীবন ছিল মেট্রোময়। কোনও প্রাজ্ঞ বলেছিলেন, পথের পাঁচালীর দু’টি তুঙ্গমুহূর্ত আছে, এক, অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়া। দুই, দুর্গার ম্যালেরিয়াতে মৃত্যু। আসলে রেলপথ নির্মাণের সময়টাই বাংলায় খানাখন্দ, মাটি কাটা ও সে জমা জলে মশার সাম্রাজ্য বিস্তার ও ফলত ম্যালেরিয়ার মহামারি আকার ধারণেরও সময়। তাই এই দু’টি ঘটনার মধ্যে গভীর যোগাযোগের ইঙ্গিত বিভূতিভূষণের লেখায় পেয়েছিলেন সেই পণ্ডিত। আমাদের জীবনেও, মেট্রোর কল্যাণেই, সত্তরের দশকের শেষের দিকের কোনও এক সময় থেকে যে লংটার্ম মাটি কাটার যজ্ঞ চলেছিল, তা ছিল প্রায় কালিদাসের মেঘদূত কাব্য-র মতোই বেদনাভারাতুর ও বিরহময়। তা গোটা চৌরঙ্গি আশুতোষ শ্যামাপ্রসাদ বহমান বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ডের গর্তকে অগণিত বর্ষার সুপ্রচুর জলজমা নদীতে পদোন্নতি দিয়েছিল। অ্যানোফিলিস মশার আঁতুড়ঘর হয়ে এই সময়টা কলকাতার পাড়াকে-পাড়া ম্যালেরিয়া আক্রান্ত করেছিল। আমার প্রিয়জনেরাও কেউ কেউ জ্বরের প্রকোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার বছর ড্রপ করতে বাধ্য হন, কেউ বা আকারে আকৃতিতে গঙ্গারাম-প্রতিম হয়ে ওঠেন, ক্রমাগত পিলের জ্বর আর পাণ্ডুরোগে ভুক্তভোগী বাঙালির মডেলটি পাকা হয়। এই সব ত্যাগস্বীকারের মাধ্যমেই পেয়েছি আমরা, কলকাতার ও বহু দিন অবধি ভারতের একমাত্র র্যাপিড ট্র্যানজ়িটকে। কে ভুলবে জ্বরতপ্ত অগণিত সন্ধ্যার স্মৃতি, হাতে হারিকেনের লোডশেডিং-শৈশবের সঙ্গে সঙ্গে?
কলকাতার মেট্রো-নীল পথ আজও আমার সমূহ অবচেতনে জড়িয়ে থাকে। তার হাতে হাত ধরুক এসে কমলা, হলুদ, সবুজ, নানা নবীন পথ। আমাদের জীবন মসৃণতর হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)