E-Paper

বেড়ে চলেছে আধুনিক দাসত্ব

আধুনিক দাসত্ব আইনে সংজ্ঞায়িত নয়। জোর করে শ্রম, ঋণের দাসত্ব, বলপূর্বক বিয়ে ও মানুষ পাচারের মতো কাজকে আধুনিক দাসত্ব মনে করা হয়।

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৪২

রাষ্ট্রপুঞ্জ ২ ডিসেম্বর দিনটি ‘আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস’ বলে চিহ্নিত করেছে। ১৯৪৯ সালের এ দিনে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে বিশ্বব্যাপী দাসপ্রথা ও দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কনভেনশন হয়েছিল। মনে হতে পারে, দাসপ্রথা তো কবেই উঠে গেছে! ইতিহাস বলে, ১৭৯১-এ বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে প্রথম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ব্রিটেন ১৮০৭-এ, আমেরিকা ১৮০৮-এ আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেয়। আরও পরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। তা হলে দাসত্ব বিলোপের কথা আসছে কোথা থেকে? দাসপ্রথা আজও আছে— কিছু তার আগের রূপে, কিছু নতুন রূপে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংস্থাগুলি ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ও প্রথায় নিহিত পুরনো দাসপ্রথার স্থায়িত্বের কথা নথিভুক্ত করে বলেছে, এ ধরনের দাসপ্রথা সমাজের নিম্নবর্ণ, জনজাতিভুক্ত, সংখ্যালঘু ও মূলনিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ বৈষম্যের ফল।

আধুনিক দাসত্ব আইনে সংজ্ঞায়িত নয়। জোর করে শ্রম, ঋণের দাসত্ব, বলপূর্বক বিয়ে ও মানুষ পাচারের মতো কাজকে আধুনিক দাসত্ব মনে করা হয়। এ শোষণের এমন এক পরিস্থিতি— হুমকি, হিংসা, বলপ্রয়োগ, প্রতারণা বা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে মানুষ যা প্রত্যাখ্যান করতে বা ছেড়ে যেতে পারে না। জাতি, সংস্কৃতি, ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক দাসত্ব রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। রাষ্ট্রপু্ঞ্জের হিসাব বলছে, অর্ধেকেরও বেশি জবরদস্তিমূলক শ্রম আর এক-চতুর্থাংশ জোর করে বিয়ের উদাহরণ মেলে উচ্চ-মধ্যম বা উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে। জোরপূর্বক শ্রম নির্মূল করতে আন্তর্জাতিক শ্রম দফতর আইনত বাধ্যতামূলক একটি প্রোটোকল এনেছে, ২০১৬-র নভেম্বর থেকে তা কার্যকর। বাধ্যতামূলক শ্রমের ঐতিহ্যগত রূপ হল বন্ধকি শ্রম ও ঋণের দাসত্ব। এখন তা রূপ পাল্টে জবরদস্তিমূলক শ্রমের চেহারা নিয়েছে, যেমন, অভিবাসী শ্রমিকদের পাচার করা হচ্ছে। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ, নির্মাণশিল্প, খাদ্য ও পোশাক শিল্প, কৃষি, জোর করে পতিতাবৃত্তির মতো ক্ষেত্রেও এই শ্রমের দেখা মেলে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র সাম্প্রতিক হিসাবমতে, গত পাঁচ বছরে জোরপূর্বক শ্রম ও বলপূর্বক বিবাহ উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। ২০১৬-র তুলনায় ২০২১-এ আধুনিক দাসত্বের শিকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আরও এক কোটি, বিশ্বব্যাপী মোট পাঁচ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ জোরপূর্বক বিবাহ-দাসত্ব মেনে নিয়েছে। জবরদস্তি শ্রমে নিযুক্ত আট জনের মধ্যে এক জন শিশু, এই শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি বাণিজ্যিক যৌন শোষণের শিকার। বিশ্বব্যাপী প্রতি দশ জন শিশুর মধ্যে এক জন কায়িক শ্রমের কাজ করে।

জোরপূর্বক বাণিজ্যিক যৌন শোষণের শিকার পাঁচ জনের মধ্যে চার জনই নারী। প্রায় ৮৬ শতাংশ ঘটনা ঘটে বেসরকারি খাতে, ৬৩% শ্রম শোষণ ও ২৩% যৌন শোষণে। বাকি ১৪% ক্ষেত্রে দায়ী রাষ্ট্র-আরোপিত জোরপূর্বক শ্রম। শিল্প, পরিষেবা, কৃষি ও গৃহস্থালির মতো ক্ষেত্রগুলি একত্রে ৮৯% জোরপূর্বক শ্রমের জন্য দায়ী। জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি, অবৈধ কার্যকলাপের মতো ক্ষেত্রও আছে, আর আছে মানুষ পাচার। রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে মানব পাচার বলতে বোঝায় শোষণের উদ্দেশ্যে হুমকি বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি নিয়োগ, পরিবহণ, স্থানান্তর; শোষণ বলতে পতিতাবৃত্তি বা অন্য যৌন শোষণ, বলপূর্বক শ্রম বা পরিষেবা, দাসত্ব বা তার অনুরূপ কাজ। শোষণের জন্য পাচার করার কাজে ব্যক্তির সম্মতি অপ্রাসঙ্গিক; পাচার করা মানুষ যদি শিশু হয়, তবে বলপ্রয়োগ ছাড়া ঘটলেও তা অপরাধ।

আধুনিক দাসত্বের শ্রম থেকে বিশ্বব্যাপী যে মুনাফা হয় তার আর্থিক মূল্য আনুমানিক ২৩৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। পরিবারের জন্য খেটে মরছেন, এমন শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি থেকে চুরি করা অর্থ এটি। অভিবাসী কর্মীদের জন্য এর মানে হল, তাঁরা কম টাকা দেশে পাঠাতে পারবেন। সরকারও এতে রাজস্ব হারায়। আইএলও-র হিসাবমতে ২০২১-এ বিশ্বব্যাপী ২৭.৬ মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত ছিলেন, ২০১৬-২১’এর মধ্যে এই সংখ্যা ২.৭ মিলিয়ন বেড়েছে।

কোনও দেশই এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তা সবচেয়ে বেশি, তার পরে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা, আরব দেশগুলি। তবে ব্যাপকতার দিক থেকে আরব দেশগুলিতে জোরপূর্বক শ্রম সবচেয়ে বেশি (প্রতি হাজারে ৫.৩), তার পরে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া (৪.৪), আমেরিকা ও এশিয়া (৩.৫)। আফ্রিকার মরিটেনিয়া সর্বশেষ দেশ যে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেছে। আজ সেখানকার ২০ শতাংশ মানুষ দাস, সরকার এ পর্যন্ত মাত্র এক জন দাস-মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। আর আমাদের দেশের অবস্থান? ২০২৩-এর বৈশ্বিক দাসত্ব সূচকে ভারতে ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Slavery Human Trafficking

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy