E-Paper

কিসের দখল, কেনই বা

স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলনে সব নাগরিক সমান। সেখানে একের প্রতি অনেকের বশ্যতা নেই, নেই দেনা-পাওনার হিসেব। স্বার্থের খোপ-কাটা বোর্ডে এই খাপছাড়া খেলা ক’দিনই বা চলে?

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৭

তবে কি ধুত্তোরবাদীরাই ঠিক? পাথরের উপর জল গড়িয়ে যাওয়ার মতো, ‘বিচার চাই’ আন্দোলন কোনও রেখা না রেখেই শুকিয়ে যাবে? গত বছরের বাঁধ-ভাঙা বন্যা এ বছর যেন তিরতিরে ধারা। জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিলে, অভয়া মঞ্চ-এর জমায়েতে কিংবা রাত দখল কর্মসূচিতে ছিলেন প্রধানত আহ্বায়কদের সদস্য, সঙ্গীরা। কেন জুনিয়র ডাক্তারদের ‘ফ্রন্ট’ মিছিলের আড়ালে ভেঙে যাচ্ছে পরিচিত দলীয় নকশায়? কেন ‘রাত দখল’ কর্মসূচি ভাগ হচ্ছে আলাদা মঞ্চে, আলাদা ‘লোগো’ নিয়ে? কেন নাগরিক মিছিলে উঠছে দলীয় বিরোধিতার স্লোগান? প্রশ্ন উত্তরকে, আর উত্তর প্রশ্নকে ধাওয়া করছে, যেন ঘূর্ণিঝড়। বালির মতো বিঁধছে উপহাস— এর নাম নাগরিক আন্দোলন? এই দমবন্ধ, যন্ত্রণাবিদ্ধ সময়ে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো ঝরে কেবল এই বোধটুকু যে, এই আত্ম-সমালোচনা, নিজেদের চিরে চিরে দেখার এই প্রবণতা, এ কিন্তু নাগরিকেরই বিশেষত্ব। আজকের রাজনীতিতে আত্মসমীক্ষার লেশমাত্র নেই।

স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলনে সব নাগরিক সমান। সেখানে একের প্রতি অনেকের বশ্যতা নেই, নেই দেনা-পাওনার হিসেব। স্বার্থের খোপ-কাটা বোর্ডে এই খাপছাড়া খেলা ক’দিনই বা চলে? এমন কত আন্দোলনের ঢেউ উচ্ছ্বসিত হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ (২০১১), পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ (২০১৩), কিংবা ইরানে মেয়েদের হিজাব-বিরোধী লড়াই (২০২২)— এগুলির অভীষ্ট কি সিদ্ধ হয়েছে? যা চেয়েছিলেন, তা কি পেয়েছেন দরিদ্র, কৃষ্ণাঙ্গ, বা মেয়েরা? না। তবু তাঁদের ‘ব্যর্থ’ বলতে খটকা লাগে। তা হলে সার্থক কারা? যারা চুপ করে রয়েছে? নাকি, যারা ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করছে?

কী পেরেছে আর জি কর আন্দোলন, এই প্রশ্নকে দেখতে হবে আর একটু বড় একটা ফ্রেমে— কী পেরেছে ভারতে ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলন? গত তেরো বছরে অন্তত চারটে বড় ধর্ষণকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছিল সারা দেশকে— দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড (২০১২), হায়দরাবাদে দিশা কাণ্ড (২০১৯), উত্তরপ্রদেশের হাথরস কাণ্ড (২০২০) এবং কলকাতার আর জি কর কাণ্ড (২০২৪)। শাসক-বিরোধী ‘সেটিং’-এর নানা ইঙ্গিত যখন গণতন্ত্রকে ছেলেখেলায় পরিণত করেছে, তখন এই সব আন্দোলন একের পর এক রাজ্য সরকারকে বেসামাল করেছে। ধর্ষণের প্রতিবাদ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্র-নাগরিক সংঘাত-বিন্দু।

ধর্ষণ-হত্যার এই ঘটনাগুলির সময়ে প্রতিটি রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার ছিল— দিল্লিতে কংগ্রেস, তেলঙ্গানায় টিআরএস, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল। কিন্তু জন-আন্দোলনের মুখে সরকারের প্রতিক্রিয়া যে ভাবে ক্রমাগত বদলেছে, তাতে মনে হয় যেন একটিই দল আগের থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের ঘটনার মোকাবিলা করছে। জবাবদিহির দায় এড়িয়ে কৌশলে, চাপ তৈরি করে আন্দোলনকেই শাসন-দমন করছে। ফিজ়িয়োথেরাপির ছাত্রী নির্ভয়ার ধর্ষণ-হত্যায় দিল্লিতে ক্ষোভের বিস্ফোরণের জেরে এক বছরের মধ্যেই এক নাবালক বাদে পাঁচ অভিযুক্তের প্রাণদণ্ড ঘোষিত হয়। অনেকে রাস্তায় নামলে, আর মিডিয়া তা দেখালে, আইন মানতে বাধ্য করা যায় শাসককে, এমন একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। নির্ভয়ার ধর্ষকদের ফাঁসি হওয়ার (২০২০) আগেই হায়দরাবাদে সেই সম্ভাবনার মৃত্যু হল। তরুণী পশুচিকিৎসকের ধর্ষণের ন’দিনের মাথায় পুলিশ অভিযুক্তদের গুলি করে মারল। আদালত-নিযুক্ত কমিশন একে ‘এনকাউন্টার হত্যা’ ঘোষণা করে, দশ জন পুলিশকর্মীর শাস্তির সুপারিশ করে। কিন্তু তেলঙ্গানা হাই কোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে, আজও কারও শাস্তি হয়নি।

আইনের জমির বাইরে খেলতে যাওয়ার বিপদ বুঝেই যেন পরের বছর হাথরস কাণ্ডে পুলিশ গোড়া থেকেই ঘটনার রাশ হাতে নিল। ধর্ষিত দলিত কিশোরীর লাশ পুড়িয়ে দিল। আদালতে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করল, তাতে চার অভিযুক্তের তিন জন বেকসুর খালাস পেল, এক জনের যাবজ্জীবন জেল হল (২০২৩), যদিও ধর্ষণের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া গেল না। জনরোষ মোকাবিলার দুটো কৌশল নিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এক, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে জাতিদাঙ্গা ওস্কানোর মামলা করলেন। দুই, সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারায় অভিযুক্ত করে খবরের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন অন্য ‘স্টোরি’-র দিকে।

ক্রমে এনকাউন্টার হত্যার মতো, যথেচ্ছ রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেওয়াটাও রাজনৈতিক ব্যুমেরাং হয়ে উঠল— ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাশ টানল রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারা আরোপে। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৌশলী হলেন। প্রথমে আন্দোলনের দাবিকে নিজের বয়ান করে তোলার চেষ্টা করলেন, তিনিও রাস্তায় হাঁটলেন বিচার চেয়ে। কিন্তু হায়, গত বছর অগস্টে কলকাতার ধর্ষণ-হত্যা বাসে, সড়কে, চাষের খেতে হয়নি, হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। অতএব শুরু হল তৃণমূল নেতাদের ‘হোয়াট-অ্যাবাউটারি’— সিপিএম, বিজেপি কী করেছে? অন্য বয়ান তৈরি করছিল সংবাদের ছবি। হাথরসে পুলিশের পাহারায় জ্বলন্ত দেহের দৃশ্যের মতোই, কলকাতায় পুলিশি উপস্থিতিতে হাসপাতালে সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হতে দেখা গেল। নাগরিকের পাল্টা-বয়ান হয়ে উঠল রাত দখল, দ্রোহের কার্নিভাল। উর্দি-পরা দেহের বিপরীতে অনশনরত দেহ।

নাগরিকের বয়ানও বদলেছে। হায়দরাবাদে দাবি উঠেছিল, ‘এখনই ধর্ষককে প্রকাশ্যে ফাঁসি দাও, পুড়িয়ে মারো।’ পাঁচ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু দেখা গেল, তদন্তের প্রতি পদক্ষেপে আইনি পদ্ধতির অনুসরণ দাবি করেছে আন্দোলন। পাশাপাশি, রেফার ব্যবস্থার গলদ থেকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের কমিটির অভাব, নানা দাবি তুলেছেন ডাক্তাররা, মেয়েরা। অনেকে রাগ করেছেন, এ সবের সঙ্গে ধর্ষণের কী? ধর্ষণ শূন্যে হয় না। কর্মক্ষেত্র দুর্বৃত্তের দখলে থাকলে কে ছাড় পাবে? আর জি কর আন্দোলনের বিশেষত্ব এখানেই। শুধু শাস্তি নয়, সংস্কার। আইন নস্যাৎ নয়, আইনের শাসন।

এমন বিচারের দাবি মুখ থুবড়ে পড়ল, যখন জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে উৎপীড়িতের সুরক্ষার দাবিকে মুখ্যমন্ত্রী ঘুরিয়ে দিলেন উৎপীড়কের সুরক্ষার সওয়ালে। এই বয়ানের জোরে হাসপাতাল, মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে যারা সাসপেন্ড হয়েছিল, তারা ফিরেছে। এই যুক্তিতেই এসএসসি ‘দাগি’ শিক্ষকদের পক্ষে সওয়াল করেছে। পীড়নকারীকে ‘পীড়িত’ বলে তুলে ধরা, এ যেন আইনের শাসনের শীর্ষাসন। এর সামনে ‘বিচার চাই’ আন্দোলন দাবি তোলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। গত এক বছরে শাসক-মোকাবিলার কোনও নতুন সূত্র মেলেনি।

শাসকের এই অনমনীয়তা এক দিনে তৈরি হয়নি। নির্ভয়া কাণ্ডের এক সপ্তাহ পরে বর্মা কমিটি গঠন করেছিল কেন্দ্র। নানা নাগরিক সংগঠনের আশি হাজার প্রস্তাব খতিয়ে দেখে, ধর্ষণের আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল কমিশন। আর জি কর ধর্ষণ-কাণ্ডের মাত্র ২৪ দিন পর ‘অপরাজিতা আইন’ পাশ করল রাজ্য। আইন তৈরিতে নাগরিকের মতামত চাওয়া হল না, সমালোচনাও গ্রাহ্য করা হল না। কেন্দ্র, রাজ্য, সর্বত্র আজ বধিরের শাসন।

জন-আন্দোলনের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করা শাসকের ‘জয়’ তো বটেই। কিন্তু পরাজয় হল ঠিক কার? হিংসা কী, হিংসক কে, তার নির্ণয় হিংসিতকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। কোনটা ধর্ষণ, কোনটা তার বিচার, তা নির্ধারণের ক্ষমতা নারী ছাড়তে পারে না পুরুষের হাতে, দলিত ছাড়তে পারে না উচ্চবর্ণের হাতে, নাগরিক রাষ্ট্রের হাতে। অথচ, আইনের খসড়ায়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিধি-নিয়মে নাগরিকের কোনও কথা রাখতে নারাজ সরকার। অন্যায় বিধি কী করে ন্যায় দেবে? আজ মিছিলের দৈর্ঘ্য না মেপে, মাপতে হবে ‘বিচার’-এর সরকারি বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি। নাটকের মঞ্চ থেকে আদালতের এজলাস, সর্বত্র নতুন নতুন সূত্র পেশ করা দরকার, যাতে প্রশ্নের মুখে পড়ে অপরাধ আর ন্যায়-বিচারের এক তরফা আখ্যান। শুধু রাস্তা নয়, নাগরিকের দখল চাই ভাষার উপর। ‘ধর্ষণ’, ‘অভিযুক্ত’, ‘সুরক্ষা’, ‘বিচার’, প্রতিটি শব্দ ফের দখল করতে হবে নাগরিককে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Protest Politics RG Kar Case

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy