E-Paper

কবির আয়না কাঠের চিরুনি

চুলকে চেরা যায় তাই নাম চিরুনি। আদর করে অনেকে বলে চিরুন। চিরুন প্রায়ই হারায়। “আমার চিরুনটা দেখেছিস?” যেন পোষা বেড়ালটা হারিয়েছে। বস্তুর সঙ্গে সখ্য এমন পর্যায়ে যেতে পারে বটে।

তৃষ্ণা বসাক

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৫ ০৭:০৪

কাদম্বরী শুধু একটা জাম রঙের শাড়ি পরে আছেন, মাথার চুলে একটি বেশ বড় আকারের চিরুনি। যশোর থেকে তাঁর বাপের বাড়ির এক জন এনে দিয়েছে। যশোরে এটাকে বলে কাঁকুই, এখানে সবাই বলে চিরুনি। কাদম্বরী বিয়ের পর প্রথম প্রথম কাঁকুই বলে ফেলতেন, তা শুনে এ বাড়ির অনেকেই হাসত। ...সংস্কৃতে কঙ্কতিকা, তার থেকে কাঁকুই। চিরুনিটাই গ্রাম্য লোকদের বানানো। তাঁর বিদ্বান স্বামী সে সময় কত কিছু শেখাতেন তাঁকে!”— প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

চুলকে চেরা যায় তাই নাম চিরুনি। আদর করে অনেকে বলে চিরুন। চিরুন প্রায়ই হারায়। “আমার চিরুনটা দেখেছিস?” যেন পোষা বেড়ালটা হারিয়েছে। বস্তুর সঙ্গে সখ্য এমন পর্যায়ে যেতে পারে বটে। চিরুনি ছাড়া মেয়েদের একদণ্ড চলে না। ছেলেদেরও চলে কি? পানের দোকানের আয়নায় চুলে চিরুনি চালাতে দেখা যাবে অনেক ছেলেকেই। ফকির দরবেশের ঝোলাতে আর কিছু না থাক, আরশি আর চিরুনি থাকবেই। কিন্তু মেয়েদের চিহ্ন যেমন চিরুনি, তেমনটা নয় ছেলেদের। রাঙা মাথায় চিরুনি না হলে চলে? বর এসে তক্ষুনি নিয়ে যাবে ওই চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালে। তাই বুঝি লালঝুঁটি কাকাতুয়াও চিরুনির বায়না করে।

কাব্যে উপন্যাসে নারীত্ব নির্মাণে পুরুষ লেখকের একটা হাতিয়ার চিরুনি। ঘরে ঢুকলেই মনে পড়ে কে যেন ছিল ঘরে, চার দিকে তার চিহ্ন, তার মধ্যে অন্যতম চিরুনি।

“...ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক’রে,/ তাই খুললেম ঘরের তালা।/ একজোড়া আগ্রার জুতো,/ চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি/ শেলফে তার পড়বার বই,/ ছোটো হার্মোনিয়ম।”— ‘শেষ চিঠি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যৌনতার নির্মাণেও চিরুনি। ‘...মধ্যরাত্রে দর্পণের সামনে তুমি/ এক হাতে চিরুনি/ রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র/ যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন।” ‘তুমি যেখানেই যাও’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

অরণ্যের রাজকন্যা ভানুমতীর ছিল কাঠের কাঁকুই, যা সে লেখককে দিয়েছিল চুল আঁচড়াতে। “ভানুমতী নিজের সেই আয়নাখানি (সেবার যেখানা পূর্ণিয়া হইতে আনাইয়া দিয়াছিলাম) আর একখানা কাঠের কাঁকুই চুল আঁচড়াইবার জন্য আনিয়া দিল।” আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

আদি যুগে চিরুনি ছিল পাথরের, পরে বিভিন্ন পশুর হাড় দিয়েও চিরুনি বানানো হত, ছিল হাতির দাঁতের চিরুনিও। হরিণের শিং, কচ্ছপের খোলও বাদ যেত না। রাজকন্যাদের চিরুনি হত সোনা রুপোর। স্বয়ং দেবীও চুল আঁচড়ান বইকি!

“হে দেবী! …যত কিছু সুগন্ধি এই সংসারে আছে, সবই এই আমলকীতে আছে যার ফলে এইটি এতই সুগন্ধিত হয়েছে। কাজেই চুলের মধ্যে এটি লাগিয়ে চুলটা কঙ্কতিকা দ্বারা (কাঁকুই চিরুনি দিয়ে) আঁচড়ে পবিত্র গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে এসো।”— ‘দুর্গা মানস পূজা স্তোত্র’।

অপ্সরাদেরও চুল আঁচড়াতে চিরুনি লাগত, সে খবর পরশুরাম দিয়েছেন। ‘পুষ্কর সরোবরের তীরে বিশ্বামিত্র আর মেনকা কাছাকাছি বসে আছেন। মেনকা তাঁর কেশপাশ আলুলায়িত করে কাঁকুই দিয়ে আঁচড়াচ্ছেন, বিশ্বামিত্র মুখ ফিরিয়ে আত্মচিন্তা করছেন।” ‘কর্দম মেখলা’, পরশুরাম।

এখনও সাধারণ মেয়েদের ভরসা সেলুলয়েডের চিরুনি (দুই ভাই ইসাইয়াহ ও জন হায়াত উদ্ভাবিত), চুল আঁচড়াতে যেমন, তেমনই উকুন বার করতেও। “দুপুরের খাওয়া সেরে নূরজাহানকে নিয়ে ঘরের ছনছায় (দাওয়া) বসেছে হামিদা। নিজে বসেছে একটা জলচৌকিতে, জলচৌকির সামনে পিঁড়ি পেতে বসিয়েছে নূরজাহানকে। হাতের কাছে ছোট্ট বাটিতে একটুখানি নারকেল তেল, কোলে পুরানা, খানে খানে দাঁত ভাঙা কালো রঙের একখানা কাঁকুই আর লাল রঙের দুইখানা ফিতা। চুলের গোড়ায় গোড়ায় নারকেল তেল ঘষে অনেকক্ষণ ধরে বিলি দিয়ে, আঁচড়ে হামিদা এখন মেয়ের মাথার উকুন মারবে...” নূরজাহান, ইমদাদুল হক মিলন।

দাঁত ভাঙা চিরুনি আবার সাহিত্যের ‘রিয়ালিটি’রও প্রতীক! “একটুকু-তলানি-ওয়ালা লেবেল-উঠে-যাওয়া চুলের তেলের নিশ্ছিপি একটা শিশি, চলেছে সে তার হারা জগতের অন্বেষণে, সঙ্গে সাথি আছে একটা দাঁতভাঙা চিরুনি আর শেষ ক্ষয় ক্ষয়ে-যাওয়া সাবানের পাৎলা টুকরো। কাব্যটির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘আধুনিক রূপকথা’। তার ভাঙা ছন্দে এই দীর্ঘনিশ্বাস জেগে উঠবে যে, কোথাও পাওয়া গেল না সেই খোয়ানো জগৎ।” ‘সাহিত্যের স্বরূপ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শুধু রংহীন বাস্তবতা নয়, রঙিন ভালবাসার স্পর্শও সত্যি সত্যি মিশে আছে চিরুনির দাঁড়ায়। ও হেনরি-র ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’-তে জিম ডেলার জন্যে ঘড়ি বিক্রি করে চিরুনি কেনে, কিন্তু হায়! ডেলা তো ইতিমধ্যেই নিজের চুল বিক্রি করে ঘড়ির চেন কিনেছে। বাস্তবেও ভালবাসার উপহার চিরুনি। ছত্তীসগঢ়ের বস্তারে, বিশেষত মুরিয়া গোষ্ঠীর ছেলেরা অনেক দিন ধরে, যত্ন নিয়ে নিজেদের হাতে কাঠের চিরুনিতে সূক্ষ্ম নকশা ফুটিয়ে তোলে, উপহার দেয় মেয়েদের। সেই চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে বাঁধা বিনোদ বেণিতে বাঁধা পড়ে যায় চপল পুরুষ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Comb Literaure

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy