ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্ব জুড়ে ১৭ কোটি নতুন চাকরির বাজার যেমন সৃষ্টি করবে, তেমনই বেশ কিছু ধরনের কাজকে শ্রমবাজার থেকে অবলুপ্তও করে ফেলবে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে কাজের বাজারের পরিবর্তন নতুন কথা নয়। এর প্রাচীনতম উদাহরণ মেলে খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার সহস্রাব্দের চিন ও মিশরে। যেখানে প্রযুক্তিগত বেকারত্ব এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে, তার মোকাবিলার জন্য সংগঠিত কেন্দ্রীয় ত্রাণশিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ২৫০ বছর আগের শিল্পবিপ্লব বস্ত্রশিল্পের বাজারকে স্বয়ংক্রিয় ও মেশিনজাত করে বহু মানুষকে কর্মহারা করেছিল। ১৮০০ শতকের ইংল্যান্ডে কৃষিপণ্য উৎপাদন পদ্ধতির যান্ত্রিকীকরণ বহু মানুষকে অন্য জীবিকার সন্ধানে বেরোতে বাধ্য করে। নব্বইয়ের দশকে এ দেশের কাজের বাজারেও কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের আগমন কর্মক্ষেত্রের প্রভূত রদবদল ঘটায়। আজকের দিনে লিফটম্যান, সুইচবোর্ড-টেলিফোন অপারেটর, টাইপিস্ট-স্টেনোগ্রাফার, নথিরক্ষক ইত্যাদি পেশার কাজগুলি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে শ্রমবাজার থেকে প্রায় অবলুপ্ত। এর বিরুদ্ধে নানা সময়ে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। দার্শনিক থেকে রাষ্ট্রনেতা, অনেকেই প্রযুক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। যেমন— গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল, রোমান সম্রাট ভেস্পাসিয়ান, রানি প্রথম এলিজ়াবেথ, কার্ল মার্ক্স প্রমুখ। এবং সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং, আমরা চাই, না-চাই, সভ্যতার নিয়মেই প্রযুক্তির উন্নতি শ্রমবাজারের পরিবর্তন ঘটাবে। আজকের মুক্ত অর্থনীতির বাজারে যা আরও বেশি, আরও চটজলদি ঘটবে।
বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শ্রমবাজারের যে পদগুলিকে অবলুপ্ত করতে চলেছে, সেগুলিতে পুরুষকর্মীদের চেয়ে মহিলাকর্মীদের সংখ্যা অনেক বেশি। রাষ্ট্রপুঞ্জ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের কাজের বাজার প্রায় তিন গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ, মহিলাদের শ্রমবাজার মূলত নির্দিষ্ট কয়েকটি পেশাতেই কেন্দ্রীভূত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা যুক্ত টেলিমার্কেটিং, কেরানিবৃত্তি, সামগ্রিক অফিস দেখাশোনার কাজ, সেক্রেটারিয়াল কাজের মতো স্বল্প দক্ষতা ও সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য কাজে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা এঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো ক্ষেত্র, যা শ্রমবাজারের এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে; এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা যা সহজে প্রতিস্থাপিত হওয়ার আশঙ্কা নেই, তাতে মহিলাদের উপস্থিতি সারা বিশ্বেই উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। ২০২৩ সালের হিসেবে আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারতের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা এঞ্জিনিয়ারিং অধ্যুষিত চাকরিবাজারে মহিলাদের উপস্থিতি যথাক্রমে ২৪, ১৭ ও ১৪ শতাংশ। অনুমান করা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি খুব সহজেই মহিলাদের স্বল্প দক্ষতা-নির্ভর কাজের বাজার দখল করে নেবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০২২ সালের প্রতিবেদন, ইউনেস্কোর ২০২২ সালের রিপোর্ট কিংবা ম্যাকিন্সে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট-এর ২০১৯ সালের বিবৃতিতেও একই আশঙ্কা।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের জন্য এই পরিস্থিতি বিশেষ ভাবে চিন্তার। কারণ, এ সব দেশে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সংখ্যা এমনিতেই নগণ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের পর্যায়ক্রমিক শ্রমসমীক্ষার বাৎসরিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ দেশে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার মাত্র ৩১% (গ্রামাঞ্চলে ৩৬% ও শহরাঞ্চলে ২৪%)। এর মধ্যে, গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের মাত্র ৩% ও শহরাঞ্চলের মহিলাদের মাত্র ১১% বেতনভিত্তিক বা নিয়মিত মজুরিভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। বাকিরা (গ্রামাঞ্চলের ৩৩% ও শহরাঞ্চলের ১৩%) রয়েছেন নানা রকম বেতনহীন শ্রম, যেমন— কৃষিশ্রম, পারিবারিক ব্যবসা, পশুপালন, খুচরো শ্রম, সেলাই বা অন্যান্য হাতের কাজ, কিংবা অসংগঠিত ক্ষেত্র যেমন আয়া, পরিচারিকার কাজ, বিউটি পার্লার ইত্যাদিতে। অর্থাৎ হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, এ দেশের শ্রমবাজার মাত্র ৪ শতাংশ মহিলাকে নিয়মিত বেতন বা মজুরিভিত্তিক কাজের সংস্থান করতে পেরেছে। এই অতি নগণ্য মহিলা মানবসম্পদ নিয়ে ধুঁকতে থাকা দেশের শ্রমবাজারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগ্রাসন, মহিলাদের কাজের বাজারের মানচিত্রটি আরও ভয়াবহ করে তুলবে।
তা হলে উপায়? ইউনেস্কোর ২০২২ সালের প্রতিবেদন বলছে, প্রথমেই জোর দিতে হবে মহিলাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষার উপর। কারণ, কাজ বা বিনোদন— উভয় ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ব্যবহারে মহিলারা পুরুষদের থেকে আজও অনেক গুণ পিছিয়ে আছেন। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার না জানলে যে-হেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ক্ষেত্রটিও অধরা থেকে যাবে, তাই অতি দ্রুত মহিলাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে হবে। আজকের দিনে মোবাইলের ব্যবহার যে-হেতু ঘরে ঘরে, তাই মোবাইলকেই প্রাথমিক ডিজিটাল শিক্ষা প্রসারের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও ২০২৫ সালের টেলিকম কম্প্রিহেনসিভ মডিউলার সমীক্ষার হিসাব বলছে, মোবাইল ফোনের ব্যক্তিগত মালিকানার ক্ষেত্রেও এ দেশের মহিলারা, পুরুষদের থেকে ৫০ শতাংশ পিছিয়ে আছেন। যদি তাঁদের হাতে নিখরচায় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমটিকে প্রথমে তুলে দেওয়া যায়, তা হলে তাঁর ব্যবহারিক শিক্ষা বিস্তারের পথটিও সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, জোর দিতে হবে মহিলাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা, দক্ষ কারিগরি শিক্ষা এবং উচ্চতর স্পেশালাইজ়ড এডুকেশন-এ। যাতে তাঁরা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন এবং সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়, এমন কাজের বাজারে যোগ দিতে পারেন। মুশকিল হল, উচ্চতর শিক্ষাই হোক বা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষা— উভয়ের জন্যই একটা ন্যূনতম সময় পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যেতেই হয়। এ দেশে আজও মহিলারা গড়পড়তা একুশ বছর বয়সে মা হয়ে যান, বা নিমগ্ন থাকেন নানা সাংসারিক কাজকর্ম ও দায়দায়িত্বে। তাই দীর্ঘ দিন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তাঁদের পক্ষে বেশ কঠিন। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়-এর ২০২৩ সালের যে প্রতিবেদনটির কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তাতে দেখতে পাই, এ দেশের ৪৮% মহিলাই শ্রমবাজারে যোগদান করেন না সন্তান প্রতিপালন কিংবা সামাজিক ও পারিবারিক দায়দায়িত্ব সামলানোর জন্য। ডক্টর সলমন আখতারের ইন লিপস অ্যান্ড বাউন্স বইতে যাকে প্রাক্-অনুভূতি বলা হয়েছে, মেয়েদের সামাজিক দায়দায়িত্ব ঠিক তাই— জন্মলগ্ন থেকেই মেয়েদের মজ্জাগত। সমস্যা হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে-হেতু কেবল প্রদেয় তথ্যের উপর ভিত্তি করেই কাজ করে, তাই লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনের এই বদ্ধমূল ভাবনা, যা ব্যক্তি কিংবা পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক— সকল ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে, তা দূরীকরণে আশু ব্যবস্থা না করলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে তা আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
সম্প্রতি এক দিন বিউটি পার্লারে গিয়ে ব্যাপারটি বেশ প্রত্যক্ষ করলাম। বছর কুড়ির মেয়েটি বিউটিশিয়ান-এর কোর্স করতে এসেছে। দু’মাসের কোর্স। সকালবেলা হাতে-কলমে প্র্যাক্টিস আর বিকেলে সিনিয়র বিউটিশিয়ান-এর কাছে নতুন বিষয়ে ট্রেনিং। তা ট্রেনি মেয়েটির সে দিন প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। বিরক্ত বিউটিশিয়ান দিদি উঠে এসে ধমক লাগাতে জানা গেল, বাড়ি থেকে তার উপর কড়া নির্দেশ, সন্ধে সাড়ে ছ’টার মধ্যে ফিরতেই হবে। কারণ, ওই সময় তার ভাই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে যায়। বাবা-মা’র বয়স হয়েছে, মেয়ে ঘরে না ফিরলে লোকজন এলে বার বার দরজাই বা কে খুলবে আর রান্না করা, বিছানা পাতা, বাসন তোলা, এগুলোই বা কে করবে?
কোনও সমীক্ষা, প্রতিবেদন বা পরিসংখ্যানে যে প্রতিবন্ধকতার কাহিনি ধরা থাকবে না, তা-ই নিত্য বাস্তব। যে দেশের মেয়েদের আজও ট্রেনিং ফেলে বাড়ি ছুটতে হয় ভাই আড্ডা মারতে বেরোবে বলে, সে দেশের মেয়েদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে চাকরি না-হারানোর জন্য প্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি তৈরি হতে হবে এই পারিবারিক, সামাজিক এবং পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক অবস্থানের বিপক্ষে একা লড়ে যাওয়ার জন্যও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)