E-Paper

জরুরি অবস্থার সন্তান

‘জনতা’ জোটের জয়ের সিংহভাগ সুফল আসলে ঘরে তুলেছিল সদ্যবিলুপ্ত জনসঙ্ঘ— ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির পূর্বসূরি, সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ ০৫:৫৮
নেতা: কলকাতার ব্রিগেড প্যারাড গ্রাউন্ডে জনসভায় বক্তৃতা করছেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। ৫ জুন, ১৯৭৫

নেতা: কলকাতার ব্রিগেড প্যারাড গ্রাউন্ডে জনসভায় বক্তৃতা করছেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। ৫ জুন, ১৯৭৫

১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ একই সঙ্গে দু’টি ঘটনা ঘটল— একুশ মাস ধরে চলা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহৃত হল, এবং ঘোষিত হল লোকসভা নির্বাচনের ফল। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এল জনতা সরকার। মোট ভোটের ৪১.৩২% পেয়ে জয়ী হল ২৯৫টি আসনে; ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস বিধ্বস্ত, আসনসংখ্যা মাত্র ১৫৪। যে তথ্যটি তুলনায় কম চর্চিত, তা হল, ‘জনতা’ জোটের জয়ের সিংহভাগ সুফল আসলে ঘরে তুলেছিল সদ্যবিলুপ্ত জনসঙ্ঘ— ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির পূর্বসূরি, সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। ১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে জনসঙ্ঘের জেতা আসনসংখ্যা ছিল ২২; ১৯৭৭-এ তা বেড়ে দাঁড়াল ৯৩। জনতা-র অন্য জোটসঙ্গীদের মধ্যে চরণ সিংহের ভারতীয় লোক দলের আসনসংখ্যা হল ৫৬, সমাজবাদীদের ৫০, কংগ্রেস (ও)-র ৪৪।

লোকসভায় এই বিপুল জয় নিতান্তই একটি সংখ্যা। জরুরি অবস্থার শেষে সঙ্ঘ পরিবার এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যে জয়টি অর্জন করল, তার গুরুত্ব লোকসভায় চার গুণ আসন বৃদ্ধি দিয়ে মাপা যাবে না— এই প্রথম ভারতীয় রাজনীতিতে তারা স্বীকৃতি পেল একটি বৈধ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে। ১৯৭৫-এর ২৫ জুনের অর্ধ শতক পরে আজ ভাবলে মনে হয়, ভারতীয় রাজনীতিতে জরুরি অবস্থার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিঘাত এটাই— হিন্দু জাতীয়তাবাদকে গান্ধী হত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তির স্বীকৃতি দেওয়া।

এই উত্তরণের কাহিনির অবিসংবাদী নায়কের নাম জয়প্রকাশ নারায়ণ, সংক্ষেপে জেপি। একদা জওহরলাল নেহরুর একান্ত অনুগামী, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জেপি ১৯৫০-এর দশকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে যোগ দেন বিনোবা ভাবে-র সর্বোদয় আন্দোলনে। ৭২ বছর বয়সে, প্রায় দু’দশকের রাজনৈতিক বানপ্রস্থ কাটিয়ে ১৯৭৪ সালে জেপি ফিরলেন রাজনীতিতে— উদ্দেশ্য, নেহরু পরিবারের দাপটে কোণঠাসা গান্ধীবাদী আদর্শের পুনরুদ্ধার। সেই লড়াইয়ে তিনি পাশে পেলেন, এবং সঙ্গে নিলেন এমন এক রাজনৈতিক শক্তিকে, ১৯৪৮-এ গান্ধীহত্যার পরে বল্লভভাই পটেল যাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

বিহারে সম্পূর্ণ ক্রান্তি আন্দোলনে জেপি কেন সঙ্ঘ পরিবারের সাহায্য নিতে রাজি হয়েছিলেন, তার কারণ সহজ— নেতা হিসাবে জেপির কার্যত সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল, কিন্তু তার তুল্য সংগঠন ছিল না। তা ছিল সঙ্ঘের। কিন্তু, এই ভাগীদারি যে মুহূর্তের নয়, ক্রিস্টাফ জাফরেলো তাঁর দ্য হিন্দু ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডিয়ান পলিটিক্স (১৯৯৩) বইয়ে দেখিয়েছেন— জেপি-র সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের সংযোগের ইতিহাস অন্তত দেড় দশকের। ১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে সরসঙ্ঘচালক মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরস সঙ্ঘের মুখপত্র অর্গানাইজ়ার-এ লিখলেন, “জয়প্রকাশ নারায়ণ মহাত্মা গান্ধী, আচার্য বিনোবা ভাবে, এবং গুরুজি গোলওয়ালকরের মতো মহান নেতাদের কাজের ধারা বহন করে চলেছেন, কারণ তাঁদের মতোই নারায়ণও চরিত্রে সন্ন্যাসী, কিন্তু শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনতাকে পথ দেখাতে নির্দ্বিধ।” একই বাক্যে গান্ধী এবং গোলওয়ালকরের সহাবস্থান জেপি-কে খুব বিচলিত করেছিল বলে মনে হয় না, কারণ সঙ্ঘ যেমন গান্ধীকে শুধু হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী এক নেতার খণ্ডচিত্রে দেখতে স্বচ্ছন্দ ছিল, তেমনই জেপি-ও সঙ্ঘকে দেখেছিলেন প্রাচীন ভারতের পুনরুত্থানপন্থী, রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এক শক্তি হিসাবে— তাদের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, বরং বলেছিলেন, নতুন ভারত গড়ার এই রাজনীতি তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পাল্টেও দিতে পারে।

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বৈধতা অর্জনের প্রকল্পে গান্ধীর রূপকের ব্যবহার হয়েছে একাধিক বার, জেপির সম্মতিক্রমেই। ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ নামক বিপ্লবটিকে স্বাধীনতা সংগ্রামেরই দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায় হিসাবে দেখিয়েছেন জেপি-সহ অন্য নেতারা— সংগ্রামের প্রথম পর্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রশ্নজনক অনুপস্থিতিকে যাতে ঢেকে দেওয়া যায় এই পর্বের তৎপর অংশগ্রহণ দিয়ে, বৈধতা অর্জনের পথে এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সেই বৈধতার দুটো দিক— এক দিকে সঙ্ঘের প্রয়োজন এমন এক নেতার, হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের অন্তত একটি প্রান্তের সঙ্গে যাঁর সাযুজ্য থাকবে। আর অন্য দিকে, জনসঙ্ঘের প্রয়োজন এমন রাজনৈতিক সহযোগী, যার সঙ্গে এগোলে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক পরিসরে ঢোকা সম্ভব হবে। জেপি-র মাধ্যমে দু’টি সম্ভাবনাই সফল হয়েছিল। বিকেন্দ্রীকরণ এবং বৃহৎ শিল্পায়নের বিরোধিতা ছিল সঙ্ঘ এবং জেপি-র একত্রে দাঁড়ানোর জায়গা। আর অন্য দিকে, জেপি আন্দোলনের সাংগঠনিক শক্তি হিসাবে স্বীকৃতি জনসঙ্ঘকে এই প্রথম বার ভরসা দিল যে, অন্য দলের সঙ্গে জোট করলেও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচিতি। অর্গানাইজ়ার-ও জোর দিল অন্য কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলির সঙ্গে সহযোগিতার উপরে। ১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে ভোপালের বিধানসভা উপনির্বাচনে, এবং তার কয়েক সপ্তাহের মাথায় জব্বলপুরে লোকসভা উপনির্বাচনে ‘জনতা’ প্রার্থীর জয় জোট-ফর্মুলার গুরুত্ব স্পষ্ট করে দিল।

রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের, এবং মূলধারার বিরোধী রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ সফল করার কৃতিত্ব অবশ্য ইন্দিরা গান্ধীর। জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয় আরএসএস, এবং জামাত-এ-ইসলামি। সঙ্ঘের অভ্যন্তরে ফিরে এল প্রায় তিন দশকের পুরনো স্মৃতি— গান্ধী-হত্যার পরে নিষিদ্ধ হওয়ায় আরএসএস-এর রাজনৈতিক পুঁজির যে ক্ষতি হয়েছিল, ক্রিস্টাফ জাফরেলো দেখিয়েছেন, ১৯৭৫-এ তা এড়াতে বদ্ধপরিকর ছিলেন সঙ্ঘকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একাধিক চিঠি লেখা হয়, এমনকি প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হোক সঙ্ঘের সদস্যদের। প্রধানমন্ত্রী কর্ণপাত করেননি। ফলে, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আরএসএস-এর লড়াইয়ের প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল সংগঠনের আইনি বৈধতা পুনরুদ্ধার করা। সেই লড়াইটিকেই ‘স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই’ হিসাবে দেখানো সম্ভব হল, মূলত ইন্দিরার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে।

জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দিরা গ্রেফতার করলেন বিরোধী দলগুলির কার্যত সব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে। দলগুলি নিষিদ্ধ না হলেও নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে কার্যত দিশাহীন সেই বিরোধী পরিসরে বিরোধীদের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াল আবারও সঙ্ঘের শাখাগুলি। আন্ডারগ্রাউন্ড কার্যকলাপের পূর্ব অভিজ্ঞতা, এবং বিপুলসংখ্যক স্বয়ংসেবকের নেটওয়ার্ক নিয়ে সঙ্ঘ হয়ে উঠল কংগ্রেস-বিরোধী রাজনীতির প্রধান শক্তি— বৈধ শক্তি, যাকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার কোনও উপায় থাকল না অন্য দলগুলির। সাধারণ মানুষের চোখেও ভাবমূর্তি পাল্টাল স্বয়ংসেবকদের— কংগ্রেস যেন ঔপনিবেশিক শাসক, আর সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা তার বিরুদ্ধে দেশরক্ষার লড়াইয়ের সৈনিক। এবং, একই জেলে বন্দি থাকার কারণে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের সঙ্গে হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠল অন্য বিরোধী নেতাদের। বিরোধী পরিসরে জনসঙ্ঘের স্থান ক্রমে পোক্ততর হল।

১৯৭৫ সাল থেকেই প্রস্তাব উঠতে আরম্ভ করল যে, নিজস্ব দলীয় পরিচয় ত্যাগ করে চারটি প্রধান বিরোধী দল এক সঙ্গে জনতা মঞ্চ হিসাবে এগোতে থাকুক। প্রস্তাবটির মূল প্রবক্তা চরণ সিংহ। বিবিধ আপত্তি এবং অস্বস্তি কাটিয়ে ১৯৭৭-এ শেষ অবধি জনসঙ্ঘ রাজি হল জনতা জোটে যোগ দিতে। তত দিনে স্পষ্ট, দলীয় পরিচয় ছাড়লেও নতুন করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক পুঁজির ক্ষতি হবে না। দলের সংগঠনও অটুটই থাকবে। ভোটের ফলাফলও সেই বিশ্বাসের পক্ষেই রায় দিল।

জনতা সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮০ সালে, সরকারের পতনের পর, জোট ভেঙে বেরিয়ে এলেন হিন্দুত্ববাদীরা— তৈরি হল নতুন রাজনৈতিক দল, ভারতীয় জনতা পার্টি। ১৯৭৪-৭৭ সময়কালে জনসঙ্ঘ এবং আরএসএস তাদের হিন্দুত্ববাদী আজেন্ডাকে সচেতন ভাবে পিছনের সারিতে রেখেছিল— জনতা সরকারের আমলেই তা ফের সামনে আসতে আরম্ভ করে। বিজেপির সূচনাপর্ব থেকেই তার যাত্রা হিন্দুরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট অভিমুখে। জেপি-র বিশ্বাস— তাঁদের রাজনীতির সংস্রবে এসে আরএসএস-এর মন পাল্টাতে পারে— সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। নতুন পর্বে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ফিরে গেল তার স্বধর্মে। ফারাক হল, জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন, জরুরি অবস্থা আর জনতা রাজনীতি পাল্টে দিল তাদের গণ-পরিচিতিটিকে।

আরএসএস-এর শতবর্ষে ২৫ জুন তারিখটিকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসাবে পালন না করে পুনর্জন্ম দিবসও বলা যেতেই পারত। বস্তুত, সেটাই ইতিহাসের বেশি কাছাকাছি হত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Right Wings Hinduism Jayaprakash Narayan BJP Congress RSS

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy