E-Paper

প্রকৃতির কালমৃগয়া

বন্যা, যে কারণেই হোক, আদতে প্রকৃতির নিজেকে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে নতুন সৃষ্টির জন্য তরতাজা হওয়ার খেলা। ‘উৎপাত’, ‘আবর্জনা’ সরবে, জলাশয় ভরবে, ভৌম জলস্তর বাড়বে, পলি পড়ে মাটি উর্বর হবে।

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৫১

উত্তরবঙ্গে এই তাণ্ডব কখনওই অপ্রত্যাশিত নয়। ইসরো-র ‘ল্যান্ডস্লাইড অ্যাটলাস অব ইন্ডিয়া’ ধসের মুখে পড়তে পারে এমন যে এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করেছে, তাদের তালিকায় ভঙ্গুর ভূপ্রকৃতির দার্জিলিং বেশ এগিয়ে। নথিপত্র এবং বাসিন্দাদের পারিবারিক স্মৃতি সাক্ষী, ব্রিটিশ আমল থেকেই মোটামুটি বছর পনেরো অন্তর এখানে পাহাড় ভাঙত। কিন্তু গত চার দশকে সময়ের এই ব্যবধান ক্রমশ কমছে। এর মধ্যে ১৯৬৮ সালে এমনই কোজাগরী-কালে বিধ্বংসী বন্যা আর গত শতকেই মেঘ ভেঙে একাধিক প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টিকেও সভয়ে স্মরণ করেন পুরনো বাসিন্দারা। ডুয়ার্সের জঙ্গল ঘিরে প্রচুর নদী, তাদের বৈশিষ্ট্যই হড়পা বান, ১০-১২ সেমি বৃষ্টিতেই তেড়েফুঁড়ে ওঠা। তাই, বয়স্ক লোকেরা কিন্তু বন্যপ্রাণ সাঁতরাতে দেখার বা লোকালয়ে চলে আসার সঙ্গে অপরিচিত নন। তবে, মানুষের লোভে জলবায়ু সঙ্কটের অভিঘাত ভয়াবহতা বহুগুণ করেছে। সমাজমাধ্যমের দৌলতে খবর ছড়িয়েছে। বাঁশঝাড়ে গন্ডারের দেখা, জলে আটকে আছে হাতির পাল, মেচি নদীতে হাতির ছানা। গন্ডারের দেহ ফুলে ঢোল হয়ে ভাসছে জলঢাকায়, স্রোতের টানে বোল্ডারের ধাক্কায় লেপার্ড প্রাণ হারাচ্ছে— এমন সারি সারি মর্মন্তুদ দৃশ্য প্রবীণতমদেরও স্মৃতিতে নেই।

বন্যা, যে কারণেই হোক, আদতে প্রকৃতির নিজেকে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে নতুন সৃষ্টির জন্য তরতাজা হওয়ার খেলা। ‘উৎপাত’, ‘আবর্জনা’ সরবে, জলাশয় ভরবে, ভৌম জলস্তর বাড়বে, পলি পড়ে মাটি উর্বর হবে। এবং, প্রাকৃতিক চয়ন অনুসারে কমজোরি, দুর্বল প্রাণীরা বাদ যাবে, যারা স্বাস্থ্যবান তেজিয়ান লড়তে পারে তাদের ঝাঁকটাই বাঁচবে, শক্তিশালী জিন এগিয়ে চলবে এবং বাস্তুতন্ত্র সুস্থ থাকবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খবর কিন্তু বন্যরা আগাম জেনে যায়। তখন নিরাপদ আশ্রয়, উঁচু জমির দিকে চলন তাদের ডিএনএ-তে গাঁথা। অর্থাৎ, ওই সাময়িক পরিযাণের পথ পরিষ্কার রাখা দরকার। তাই বনে টিলা ছাড়াও, সেখানে পৌঁছতে কিছু পশু চলাচলের রাস্তা দরকার। এগুলি হবে ‘ইকো-সেনসিটিভ’ এলাকা। মানুষ ও সভ্যতা ঢুকবে না।

নির্ঘাত প্রশ্ন উঠবে, যেখানে মানুষেরই অস্তিত্ব-জীবিকায় সঙ্কট, সেখানে বন্যপ্রাণদের এত বাড়তি সুবিধা দেওয়া সাজে? এখানেই একটা কথা আবারও বলা জরুরি। পাপের প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাকার দর্শন নয়, কথাটা কাঠখোট্টা বাস্তব। বর্ষা পিছোচ্ছে, বর্ষণের চরিত্র বদলাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে একটানা রিমঝিমে শাওনধারা নয়, হঠাৎ চার দিক ঝাপসা করে কয়েক ঘণ্টার মুষলধারায় আসুরিক বর্ষণই ভবিতব্য হয়ে উঠছে। পাহাড়ে এর ধাক্কা সুতীব্র তো হবেই। পৃথিবীর যেখানেই বন্যপ্রাণসমৃদ্ধ এলাকা ভূতাত্ত্বিক ভাবে বিপর্যয়-প্রবণ, সেখানেই পশুদের বাঁচানোর আলাদা উপায় মজুত থাকে। না হলে প্রজাতিগুলির বিলুপ্তির সম্ভাবনা। আফ্রিকার বত্‌সওয়ানায় এমন বিশেষ উদ্ধার-ব্যবস্থা রয়েছে। উদাহরণ কাজ়িরাঙাও— ভূতাত্ত্বিক জটিলতায় সেখানে ফি-বছর বন্যায় গন্ডার, হরিণের শব ভেসে যায়। সহস্রাব্দের প্রথমেই এই অংশে অরণ্যের নিজস্ব ‘আপৎকালীন পরিষেবা’ স্থাপিত হয়েছে। ত্রাণ-পরিকল্পনা নিয়ে আগেভাগে সজাগ থাকেন সেনা, পেশাদার উদ্ধারকারী, পশুচিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবী। বুকজলে নেমে পশুকে উদ্ধার করে বিবিধ কৌশলে জঙ্গলে ফেরানো হয়। কিছু পশুকে জবরদস্তি তুলে আনতে গেলে প্রাণহানির আশঙ্কা, কিছু পশু আবার শাবকের গায়ে মানুষের গন্ধ লাগলে তাকে দলে ফেরায় না। এদের মানস জাতীয় উদ্যানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও রেখেছে অসম। এমনই পৃথক পরিকাঠামো ডুয়ার্সেও জরুরি, যাতে প্রতিক্রিয়া দ্রুততর হয়।

কাজ়িরাঙা সমস্যামুক্ত নয়। সেখানে জল বাড়লে পশুরা কার্বি আংলং পাহাড়ের দিকে ছোটে। সেই পশু চলাচলের করিডরেরই বাধা হাইওয়ে, পর্যটকাবাস। সরতে বললে ব্যবসায়ীরা ধর্নায় বসছেন। বন্যপ্রাণ করিডরে সবিশেষ মনোযোগে সুফল পেয়েছে মধ্যভারত। কী সুফল— অন্যত্র বিশদে বলা যাবে। এখানে এতটুকুই প্রাসঙ্গিক যে, সেখানেই পেঞ্চ টাইগার রিজ়ার্ভ-এর কাছে নয় কিলোমিটার পশু চলাচলের রাস্তার প্রকল্প প্রসঙ্গে অসন্তোষ দেখিয়েছেন স্বয়ং সড়ক পরিবহণমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, দরিদ্র ভারতে পরিবেশ-খাতে মানুষের করের টাকা কতখানি ঢালা উচিত, তা আরও আলোচনাসাপেক্ষ।

পরিবেশে বিনিয়োগ কেন জরুরি, তার উত্তর এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গের জনপদগুলিতে। নিরাপদ আশ্রয় ও পরিযাণযোগ্য পথের অভাবেই জলদাপাড়া-গরুমারার বানভাসিরা লোকালয়ে আসছে। চিলাপাতার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাইসন এক বৃদ্ধকে জখম করছে, কোচবিহারে শূকরের হানায় প্রাণ গিয়েছে। তোর্সার জলে জঙ্গলের কিংবদন্তি স্বর্ণমৃগ দেখা গিয়েছে, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে সাপ, গন্ডারের আতঙ্ক। ধূপগুড়িতে রেলসেতুর কাছে ঠাঁইনাড়া মানুষের আশ্রয়ের কাছের ঝোপেও ঝটপট করেছে গন্ডার, দু’পক্ষই যে শুকনো ডাঙার সন্ধানে।

এ সব ক্ষেত্রে বিপন্ন বন্যপ্রাণ নানা ভাবেই মানব-পশু সংঘাতের কারণ হতে পারে। কিছু হরিণ ভয়ে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করে দুর্ঘটনা ঘটায়। জংলি হাতিরা বিকল্প পথ খুঁজতে জানে, ঠিক যে ভাবে তিনটি হাতি তোর্সার বাড়ন্ত জল দেখে পাতলাখাওয়ার জঙ্গল থেকে ঘুরপথে চিলাপাতায় ফিরেছে। এরা সড়কে উঠে এলে কিন্তু ফলাফল বিরূপ হতে পারে। বুনো শূকরের দাঁত খুবই ভয়ের এবং গন্ডারের আচরণেরও আঁচ দেওয়া মুশকিল। জঙ্গলের ঘাসজমি ডুবলেও পশুরা লোকবসতিতে খাবার খুঁজতে আসবে।

দু’-একটি উদাহরণ দেখালেই পরিস্থিতি ঠিক কতটা গুরুতর হতে পারে, স্পষ্ট হবে। গত দশকে গুজরাতে অমরেলিতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়, ধারাপাত কমলে মহিলারা মন্দিরে ঢোকেন, রোজকার মতো। সিঁড়ি ভেঙে চাতালে উঠতেই মূর্তির সামনে থেকে লাফ দেয় ক্ষিপ্ত এক সিংহী।

ব্রহ্মপুত্রেরও রাগ বাড়ছে। কয়েক বছর আগেই কাজ়িরাঙার প্লাবন বনপ্রান্তের ধাবামালিক রফিকুল ইসলামের জীবনদীপটি নিবিয়েই দিচ্ছিল প্রায়। জাতীয় সড়কে রফিকুলের খাবারের গুমটি, পাশেই তাঁর ঘর। সকালে ঘুম ভেঙে তিনি দেখেন বিছানায় তাঁর পাশে ঘুমোচ্ছে রয়্যাল বেঙ্গল। তিনি দোকানের আশপাশে বন্যদের দেখতে অভ্যস্ত, ঠান্ডা মাথায় নিশ্চুপে বাইরে বেরিয়ে বন দফতরকে খবর দেন।

ডুয়ার্সে এখন বাঘ থাকার অবকাশ ক্ষীণ। কিন্তু লেপার্ডগুলোও কম নয়, তাদের ঘরদোরে ঢুকে পড়ার বদভ্যেস। শিলিগুড়ি-মিরিক সংযোগকারী যে সেতুটি দুমড়েছে, তার নীচে কুণ্ডলী পাকানো অজগরটিকে প্রথমে মৃত মনে করলেও আসলে নাকি অচেতন শুয়ে ছিল। সৌভাগ্য, প্রাণীটি নির্জীব ছিল, স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধার করে জঙ্গলে পাঠিয়েছেন বনকর্মীরা। কিন্তু আচমকা এই ধরনের শিকারি বা বিষধরদের মুখে পড়লে ঠিক কী করতে হয়, বাসিন্দাদের সেই তালিম দেওয়া আছে তো?

অতঃপর, বনসৃজন, জলাশয় রক্ষার তাগিদের যে দাবি জেগেছে সেটিই খড়কুটো। অরণ্য সংরক্ষণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা গেলে অতিবৃষ্টির বিপদ-প্লাবনকে অনেকটাই শুষে নেবে এ সব প্রাকৃতিক স্পঞ্জ। অন্য দিকে, বন্যপ্রাণ উদ্ধারে উত্তরবঙ্গেও প্রশিক্ষিত, প্রযুক্তিদক্ষ বিশেষ ইউনিট চাই। ক্ষতির মাপ, ত্রাণ-পুনর্বাসন, পরিত্যক্ত শাবকদের দুধ সংস্থান ইত্যাদি দীর্ঘ, ব্যয়বহুল, বিপুল কর্মযজ্ঞে গবেষক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পশু-ত্রাতা সংগঠন, এনজিও— সবাইকে লাগবে বন দফতরের। যেখানে সম্বৎসরই সংঘাত হচ্ছে, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দিয়ে সেই এলাকাকে মানবমুক্ত করে জাতীয় উদ্যানের নিয়মের আওতায় আনা উচিত। প্রবেশমূল্য ও পর্যটন বাবদ আয় বাড়াতে হবে, যা কাজে লাগবে জঙ্গলের, এবং জনগোষ্ঠীরও। সংরক্ষণ ও গোষ্ঠী উন্নয়নকে বিপরীতমুখী করে দিয়েই তো এত সমস্যা! প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণের উপযোগিতা এবং মূল্য সম্পর্কে বোধের উন্মেষ ঘটলে তবেই তা সম্পদ, আর আপদ ভাবলেই বিপদ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

flood landslide Wild Life

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy