প্রায় ২৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। এখনও মাঝেমধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছে! রবিবার রাতে কি ক্রিকেটই দেখতে বসেছিলাম? না কি অন্যকিছুকে ক্রিকেট ভেবে ভুল করেছি? মনে হচ্ছিল, স্পোর্টসের ‘গো অ্যাজ় ইউ লাইক’ হচ্ছে। ক্রিকেটারেরা দু’দেশের সেনাবাহিনীর উর্দি পরে মাঠে নেমেছে। টিভি-তে সেই যুদ্ধের রিয়্যালিটি শো দেখছি।
সেপ্টেম্বরের ৯ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত মরুদেশে যে এশিয়া কাপ হল, তা যে আদৌ ক্রিকেট ছিল না, রবি-রাতের পরে তা নিয়ে ধোঁয়াশার বিশেষ কারণ দেখছি না। বিশেষত, যখন পাকিস্তানকে হারানোর অব্যবহিত পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করলেন সেই জয়কে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সঙ্গে তুলনা করে। মনে হচ্ছিল, টুইটটা তৈরিই ছিল। স্রেফ বোতামটা টিপে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিকেরা অবশ্য এমন করেই থাকেন। কিন্তু একই সঙ্গে শিহরিত হচ্ছিলাম ভেবে যে, কী হত যদি তিলক বর্মা ওই ভয়াবহ চাপের মুখে অমন ডাকাবুকো ইনিংস না খেলতেন? যদি ভারত হেরে যেত? ১৪৬ রান তাড়া করতে গিয়েই পা পিছলে গিয়েছিল প্রায়। যদি পাকিস্তান আরও গোটা চল্লিশেক রান বেশি করত? ক্রিকেট-ঈশ্বর না করুন, তা হলে তো সূর্যকুমার যাদবকে কোতল করা হত! ভারতীয় দলকে ঝোলানো হত ফাঁসিকাঠে!
যেমন এখন সেই তোড়জোড় হচ্ছে ওয়াঘা সীমান্তের ওপারে। অধিনায়ক সলমন আঘা সমেত পাকিস্তান দল দেশে ফিরে যে কী অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে, রবিবার রাতেই সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে-আসা ক্রুদ্ধ কটূক্তিতে তা স্পষ্ট।
এই মরুদেশেই পাকিস্তানের কাছে ভারত হেরে যাওয়ায় গ্যালারির দেশভক্ত জনতার কাছে মহম্মদ শামিকে শুনতে হয়েছিল, তিনি মুসলমান বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইচ্ছে করে খারাপ বল করেছেন। সহজ ক্যাচ ফেলায় অর্শদীপ সিংহকে শুনতে হয়েছিল, ‘ব্যাটা খলিস্তানি’!
এ-ও আশ্চর্য যে, এমন মারহাব্বা ম্যাচ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পরে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্তরীয় নেতানেত্রীকে ভারতীয় দলকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করতে দেখলাম না। বিশেষত তাঁদের, যাঁরা এই সমস্ত মওকা সাধারণত ছাড়েন না। না কি খুব আশ্চর্য নয়? এমনটাই হওয়ার ছিল। ভারত জেতার পরে বিদ্যুতের গতিতে টুইট করে মোদী সেই জয়ের উপর নিজস্ব স্টিকার সেঁটে দিয়েছেন। সিঁদুরজলে দেশভক্তির কড়া অনুপান মিশিয়ে এশিয়া কাপ গুলে চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছেন। তারপরে কে আর এঁটো শালপাতা চাটতে যায়! অভিনন্দনেরও তো একটা রাজনীতি আছে। নাকি?
ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ বরাবর দু’দেশের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে সমর্থকদের বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের কারণ হয়ে থেকেছে। তার সঙ্গে সবসময়েই জড়িয়ে থেকেছে দু’দেশের বৈরিতার ইতিহাস এবং রাজনীতি। কিন্তু তা কখনও এই পর্যায়ে যায়নি। কী লিখলাম? ‘যায়নি’? ভুল লিখলাম। এই পর্যায়ে কখনও ‘নামেনি’। এবং চারপাশে যা দেখছি, এই অধোগতি রোখে সাধ্য কার?
কার্গিল যুদ্ধের পরেও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হয়েছে। তার অনন্ত চাপ থেকেছে দু’দেশের ক্রিকেটারদের উপর। দু’দেশের জনতা ‘বদলা’ চেয়েছে। টানটান সেই সমস্ত ম্যাচে বেশির ভাগ সময়েই ভারত জিতেছে। কখনও-সখনও জিতেছে পাকিস্তানও। কার্গিল-উত্তর সময়ে বিশ্বকাপের তুঙ্গ উত্তেজক ভারত-পাক ম্যাচ মোহালির গ্যালারিতে পাশাপাশি বসে দেখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ। কিন্তু তখনও দু’দলের ক্রিকেটারেরা পরস্পরের পারদর্শিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ছুটকোছাটকা বাক্য বিনিময় বা টীকা-টিপ্পনী খেলার অঙ্গ। কিন্তু খেলার আগে বা পরে প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাব না, সে দেশের ক্রিকেটকর্তা মঞ্চে থাকলে ট্রফি নিতে যাব না, ম্যাচ জিতে বিপক্ষকে নিয়ে হেলাফেলা করব, ফ্যাক ফ্যাক করে হাসব, খেলো করব, রোয়াকসর্বস্ব রসিকতা করব, কেন ট্রফি নিতে গেলেন না, পাকিস্তানি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব না দিয়ে উল্টে তাঁকে সর্বসমক্ষে হাস্যস্পদ করব— এ জিনিস ঘটেনি। আবার এমনও ঘটেনি যে, প্রতিপক্ষের উইকেট পড়ায় হাতের মুদ্রায় বিমান ধ্বংসের ভঙ্গি করে দেখাব যে, কেমন দিলাম। বা হাফ সেঞ্চুরি করে বিপক্ষের সমর্থকদের দিকে বন্দুকের মতো হাতের ব্যাট তাক করব। অথবা ম্যাচ রেফারির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করব এবং তাঁকে গোটা টুর্নামেন্ট থেকেই সরিয়ে না দিলে পরের ম্যাচ না খেলার গোঁ ধরে বসব (তারপরে অবশ্য গাঁইগুঁই করেও ম্যাচ খেলব। সেই ম্যাচ রেফারির নজরদারিতেই)।
এ সব অবুঝ গোঁয়ার্তুমি শিশুরা করে থাকে। এই সস্তা চটক, এই ‘গ্যালারি শো’ রাজনীতিকদের অনেকে করে থাকেন। তাঁদের সে প্রয়োজনও পড়ে। সাবালক ক্রিকেটারেরা করবেন কেন? করবেন তো করবেন, আবার পরে যুক্তি দিয়ে অনায়াসে বলবেন, শুরু তো ওরা করেছে! আমরা তো জবাব দিয়েছি শুধু। আবার বিপক্ষ অধিনায়ক সগর্বে বলবেন, অনেক সময় স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের চেয়েও অনেক বড় কিছু থাকে!
সত্যিই? থাকে? থাকে বোধহয়। খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের চেয়েও ঝাঁঝালো এবং কড়া হয়ে ওঠে দেশভক্তির জোলাপ। এতদিন জানতাম, উৎসবের মতোই খেলাও মানুষের সঙ্গে মানুষকে জোড়ে। খেলা মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে প্রতিযোগিতা ঘটায়। কিন্তু বিভাজন তৈরি করে না। এশিয়া কাপ সেই শিক্ষার গোড়ায় জল ঢেলে দিল। ঠিকই বলেছেন পরাভূত পাকিস্তান অধিনায়ক, ‘‘এর শেষ কোথায় আমি জানি না। এক একটা যুগে এক একটা দেশ ক্রিকেট শাসন করে। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান বারবার ভারতকে হারাত। এখন ভারত আমাদের বারবার হারায়। আবার এমন একটা সময়ও আসবে, যখন পাকিস্তান পরপর ভারতকে হারাবে। তখন কী হবে?’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ক্রিকেট কি এতদিনে তার প্রতি আমার নির্লজ্জ আসক্তির দাদন নিতে শুরু করল?
এই জীবনে যদি কিছুতে বেহায়ার মতো আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকি, তার নাম ক্রিকেট। রসিকতা করে নিজেকে বলি ‘ক্রিকেটামোদী’। টিভি খুলে (মাঠে গিয়ে ক্রিকেট দেখি না। প্রথমত, সমবেত চ্যাঁ-ভ্যাঁ’র চোটে বিরক্ত লাগে। দ্বিতীয়ত, টিভি-তে অনেক ভাল দেখা যায়। ম্যাচের পরের বিশ্লেষণের বোনাস-সহ) প্রথমেই দেখি কোন স্পোর্টস চ্যানেলে ক্রিকেট হচ্ছে। তার পরে দেখি, স্ক্রিনের কোনায় ‘লাইভ’ লেখা আছে কি না। সে পৃথিবীর যে প্রান্তে হোক, মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে যারা খুশি খেলুক, টেস্ট ম্যাচ হোক বা ওয়ান ডে অথবা টি টোয়েন্টি কিম্বা ‘বিগ ব্যাশ’ বা ‘হান্ড্রেড’। টিভি-তে সরাসরি ক্রিকেট সম্প্রচার আমায় নিশির ডাকের মতো টানে। গাড়ি থামিয়ে কলকাতার রাস্তায় গলি ক্রিকেট বা ময়দানে প্রথম বা দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব ম্যাচ দেখতে গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট প্রায় মিস্ করে যাওয়ার ইতিহাসও আছে। বেটিং-ফিক্সিং কাণ্ডের পরে আইপিএল নিয়ে যতই নেতিবাচক প্রচার হোক, যতই আশপাশের লোকজন বলুন, আইপিএল সহ্য করতে পারেন না, ওটা পাজামা ক্রিকেট, আমি আমার আসক্তির ধর্ম থেকে সরিনি। আইপিএল আমার দুগ্গাপুজো। আসছে-আসছে ভেবে উত্তেজনা হয়। শেষ হলে ‘উইথড্রয়াল সিম্পটম’ শুরু হয়। ২০০৮ সালে প্রথম আইপিএল কভার করেছিলাম। তার পরে শুধু টিভি দর্শক। কিন্তু বছরের ওই দু’থেকে আড়াই মাস আমার দেহঘড়ি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আইপিএলের সময়সারণি অনুযায়ী চলতে থাকে।
কারণ, ক্রিকেট আমার সামনে ঝলমলে আর রংদার সব চরিত্র এনে ফেলে। স্বপ্নসন্ধানীদের হদিস দেয়। পরিশ্রম, অধ্যবসায়, অনুশাসনের যোগফলে গলি থেকে জীবনের রাজপথে উত্তরণের কাহিনি শোনায়। ক্রিকেট আমায় শেখায় জয়ে তো বটেই, হারেও মহীয়ান হওয়া যায়। আধুনিক ক্রিকেটারেরা আমায় শেখান, প্রতিভা এবং স্বার্থশূন্যতার (নিজের নয়, দলের জন্য খেলব। তাতে একটা-দুটো সেঞ্চুরি না হয়ে মাঠে ফেলেই এলাম) মিশেলে একটা ঝিমঝিমে মিশ্রণ তৈরি হয়। সেটাই ক্রিকেটামোদীর আসল নেশা।
সেই নেশার টানেই রবিবার ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ঝাঁ-ঝাঁ করে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি পৌঁছেছিলাম। যাতে শুরু থেকে বসতে পারি। বুঝতে পারিনি, রাত কাবার হয়ে যাবে ম্যাচের পরের ম্যাচটা দেখতে দেখতে!
ভারত-পাক ফাইনাল যতটা উত্তেজক এবং রোমহর্ষক হওয়ার ছিল, ততটাই হল। কিঞ্চিৎ বেশিই হল। কিন্তু ম্যাচের পরের ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হল, এই তা হলে ক্রিকেট? এই-ই? জিততে তো সকলেই চায়। প্রতিপক্ষকে দুমড়ে দিয়েই জিততে চায়। কিন্তু জয় তো মানুষকে মহৎ করে। আর জিতলে তো মহান হওয়া আরও সহজ! ভারত সেটুকু ঔদার্য দেখাতে পারল না?
ম্যাচটা দেখতে দেখতেই অবশ্য মনে হচ্ছিল, ভারত যতটা না নিজেরা জেতার জন্য খেলছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি খেলছিল পাকিস্তানকে হারাতে। আবার পাকিস্তান যতটা না জয়ের জন্য খেলছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি খেলছিল গত দুই রবিবারের হার ভুলে অন্তত একটি ম্যাচে ভারতকে হারানোর জন্য। দুটোর মধ্যে খুব সূক্ষ্ম, প্রায় ছুঁচের মুখের মতো একটা তফাত আছে। মানসিকতার তফাত। ইতির মানসিকতার সঙ্গে নেতির মানসিকতার। সেই মানসিকতার তফাতটা এই টুর্নামেন্টের শুরু থেকে চোখে পড়ছিল। সেই কারণেই ক্রিকেটের চেয়ে বহিরঙ্গের কাড়ানাকাড়া বেশি জোরে বাজছিল। এই সমস্ত কোরাসে ফোকাস নড়ে যায়। নেতিতে নিমজ্জিত থাকলে লক্ষ্য ঝাপসা হয়ে যায়। তাতে নিজের উপর বেফালতু বেশি চাপ নিয়ে ফেলা হয়। যা নিয়েছিল ভারত। নিয়েছিল পাকিস্তানও।
ভারতীয় দল আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল তথা পাক ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা ফাইনালের মঞ্চে থাকলে তারা সে মঞ্চে উঠবে না। বাস্তবে হলও তা-ই। ম্যাচের পর সওয়া এক ঘণ্টা কেটে গেল। কমেন্ট্রি বক্স আর ম্যাচ-পরবর্তী বিশ্লেষণ টানতে পারছে না। রবি শাস্ত্রীর ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছে (এমনিতেই টসের পরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাননি পাক অধিনায়ক। সহ-ভাষ্যকার প্রাক্তন পাক পেসার ওয়াকার ইউনুসকে নিয়ে যেতে হয়েছে)। পাশে বসা ওয়াসিম আক্রমের কাঁধের উপর দিয়ে ডিঙি মেরে দেখছেন, মাঠে তখনও পুরস্কার বিতরণী শুরু হচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘‘এগুলো কী হচ্ছে! দর্শকেরা চলে গিয়েছে। গ্যালারি ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। এখনও শুরু হল না? যা দেরি হচ্ছে, তাতে তো গৌতম গম্ভীর আরও একটা কুড়ি ওভারের ম্যাচ খেলে নিতে পারত।’’ আক্রম টেনে আনলেন তিলকের ছক্কার পরে উত্তেজিত গম্ভীরের টেবিলে পরপর ঘুষি মারার দৃশ্য, ‘‘কী করছিল ও? আরে, দিনের শেষে এটা তো স্রেফ একটা ক্রিকেট ম্যাচ!’’
হ্যাঁ এবং না। ক্রিকেট ম্যাচ। আবার শুধু ক্রিকেট ম্যাচও নয়। কূটকচালে এবং সন্দিগ্ধু মন বলছিল, গম্ভীর সফল প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং অদ্যাবধি সফল কোচ ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বিজেপির প্রাক্তন সাংসদও বটে। সেই মন আরও বলছিল, শুরুটা ভারতই করেছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচের সময় পাক অধিনায়ক সলমনের সঙ্গে হাত মেলাননি ভারত অধিনায়ক সূর্যকুমার। ম্যাচের পরেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাননি কোনও ভারতীয় ক্রিকেটার। এহ বাহ্য, সেই ম্যাচ-পরবর্তী আলাপচারিতায় বিনা প্রশ্নেই সূর্যকুমার মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বলেছিলেন, তাঁরা পহেলগাঁওয়ের নিহতদের পরিবারের পাশে আছেন। যেমন এশিয়া কাপ জয়-পরবর্তী সাংবাদিক বৈঠকের শেষেও বিনা প্রশ্নেই বললেন, ‘‘কে জানে, এটা নিয়ে আবার বিতর্ক হবে কি না। কিন্তু এটা ভাল বিষয়। বিতর্কের কিছু নেই বলেই মনে হয়। কথাটা হল, আমি এই টুর্নামেন্টে আমার সমস্ত ম্যাচ-ফি ভারতীয় সেনাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ যার পাল্টা দিতে গিয়ে পাক অধিনায়কও সাংবাদিক বৈঠক শেষ করলেন এই বাক্য দিয়ে যে, ‘‘আমাদের দেশের যে সমস্ত মানুষ (ভারতের) হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আমরা এই টুর্নামেন্ট থেকে পাওয়া সমস্ত অর্থ তাঁদের দিয়ে দেব।’’
এ আর যা-ই হোক, ক্রিকেট নয়। ক্রিকেট এক অন্যরকমের বীরত্বের মঞ্চ। ক্রিকেট ভক্তের কথা বেশি ভাবে। সাধকের কথা বেশি ভাবে। পরিশ্রমীর কথা বেশি ভাবে। কম ভাবে রাজনীতির কথা।
শুরু থেকেই মাঠের বাইরে ভারতের এই দেখনদারি আগ্রাসনের খুব প্রয়োজন ছিল? বিশেষত, ক্রিকেট নামক এক মহান অনিশ্চয়তার খেলায়? এবং টি টোয়েন্টির মতো মহানতম অনিশ্চয়তার ফর্ম্যাটে? এতই যদি দেশভক্তি, তা হলে আদৌ খেলতে যাওয়া কেন এশিয়া কাপে? আর যদি যাওয়াই, তা হলে ক্রিকেটের শিক্ষাদীক্ষা এবং যাবতীয় প্রোটোকলকে শিকেয় তুলে দেওয়ার এই বেপরোয়া অবিমৃশ্যকারিতা কেন! পাক ক্রিকেটের মহাকর্তা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন আর ভারতীয় দল মাঠের মধ্যে শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছে। পুরস্কার বিতরণীর সঞ্চালক প্রাক্তন ক্রিকেটার সাইমন ডুলের জন্য মায়া হচ্ছিল। বেচারাকে পুরস্কার বিতরণী শেষ করতে হল এই বলে যে, ‘‘আমাকে জানানো হয়েছে, ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নিতে আসছে না। ফলে এই অনুষ্ঠান এখানেই শেষ!’’
এ তো জন্মশত্রুর সঙ্গে পাশাপাশি বসে নেমন্তন্নে পাত পেড়ে খাওয়া। তারপরে ন্যাপকিনে হাত-টাত মুছে তার সঙ্গে বাক্যালাপ না করে চলে আসার মতো। এ কি কোনও পূর্ণবয়স্ক দেশকে মানায়? কে জানে! তিনে-তিন হয়ে গিয়েছে বলে দেশ বীরের মর্যাদা দিচ্ছে। পাকিস্তানের কাছে একটা হার এই ক্রিকেটারদেরই মাটিতে আছড়ে ফেলবে। এ দেশে তো সচিন তেন্ডুলকরের কুশপুতুল দাহ করার, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বাড়িতে ইট-পাটকেল পড়ার ইতিহাসও রয়েছে।
এখন সুপবন বহিতেছে। সময় ভাল যাচ্ছে। ভারত হারতে ভুলে গিয়েছে। আইপিএল নামক এক সোনার ডিম-পাড়া হাঁস ভারতকে ক্রিকেটবিশ্বে দানব বানিয়ে দিয়েছে। আইসিসি-র মাথায় ভারতের শীর্ষ রাজনীতিকের পুত্র আসীন। ফলে ভারতের অঙ্গুলিহেলনে ক্রিকেটবিশ্বের ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ঘটনাচক্রে, ঠিক সেই সময়েই পাকিস্তানের রাজনীতির মতোই তাদের ক্রিকেটেও ডামাডোল শুরু হয়েছে। ভারতের সামনে পড়লেই তাদের ঠকঠকানি শুরু হয়। হাবেভাবে যতই মস্তানি থাকুক, চাপের মুখে ভেঙে পড়ছেন পাক ক্রিকেটারেরা। দেশের জনতা তাদের মুণ্ডপাত করছে। ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।
ভারত-পাকিস্তানের জনতা ভুলে যাচ্ছে, জেতার মতোই খেলোয়াড়দের হারারও একটা অধিকার থাকে। এই দেশভক্তির পাঁচন, এই আনখশির উচ্ছ্বাস, এই আরোপিত আগ্রাসন খুব সন্তর্পণে, কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে হারার সেই খেলোয়াড়ি অধিকারটা কেড়ে নিচ্ছে।
‘ক্রিকেটামোদী’ চিন্তিত। উদ্বিগ্ন। শঙ্কিত। তার কাছে দাদন চাইছে দেশভক্তি। এ বড় কঠিন সময়!